বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫


ফিরে দেখা ২০১৭ : মুসলিম বিশ্বের আলোচিত ঘটনাগুলো

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

বিদায়ের পথে ২০১৭। বিশ্বব্যাপী বছরটি পূর্ণ ছিল নানান আলোচনায়। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের নানান ঘটনায় দেশের সকল সংবাদ মাধ্যমগুলো ব্যস্ত সময় পার করেছে এ বছর। কাতার সংকট, রোহিঙ্গা সমস্যা, জেরুসালেম ও ফিলিস্তন ইস্যু, সৌদির উদার নীতিতে ফিরে আসা ইত্যাদি আলোচিত ঘটনায় পত্রিকার পাতা ছিল বেশ গরম।

আওয়ার ইসলাম পাঠকদের জন্য ফিরে দেখা ২০১৭’র আজকের আয়োজন মুসলিম বিশ্বের আলোচিত ঘটনা সমুহ। লিখেছেন রকিব মুহাম্মাদ 

রোহিঙ্গা সঙ্কট

২০১৭ সালের সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইস্যু হলো রোহিঙ্গা সঙ্কট। মিয়ানমারের সুপরিকল্পিত রোহিঙ্গা নির্যাতন বা ‘গণহত্যা’ যা মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী এবং উগ্রবৌদ্ধ সম্প্রদায় দ্বারা আক্রান্ত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর চলমান সামরিক অভিযান।

গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা-পুলিশের তথাকথিত ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের প্রেক্ষিতে ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। ২০১৭ সালের অক্টোবরে কতিপয় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগ এনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক মুসলিম নিধন শুরু হয়। রোহিঙ্গাদের ওপর বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গণধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও শিশুহত্যাসহ অত্যধিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয় সেখানে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মিয়ানমারের এই অভিযানকে রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা হিসেবে অবহিত করেছে।

প্রাণ বাঁচাতে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম। কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) রিপোর্ট অনুযায়ী গত মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমার নাগরিকের সংখ্যা ছয় লাখ ৪৮ হাজার ৫৪০ জন।

অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকায় এ সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া ২৫ আগস্টের আগে মিয়ানমার থেকে আসা দেশটির বাস্তুচ্যুত নাগরিকের সংখ্যা দুই লাখ চার হাজার ৬০ জন।

জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট, প্রতিবেশী বাংলাদেশ, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ার সরকার ইতিহাসের বর্ররতম এই নির্যাতনের সমালোচনা করেছে। মিয়ানমার সরকার প্রধান, অং সান সু চি, বিশেষ করে তার নিষ্ক্রিয়তা ও নীরবতার জন্য এবং এই সামরিক অপব্যবহার প্রতিরোধে বলতে গেলে কোন কাজ না করার জন্য সমালোচিত হয়েছেন।

জেরুসালেম ইস্যু

গত ৬ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প কর্তৃক পবিত্র নগরী জেরুসালেমকে রাজধানী ঘোষণা করা হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘোষণার পরই ফিলিস্তিনসহ পুরো মুসলিম বিশ্ব ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাৎক্ষণিকভাবে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায় আরব বিশ্বের নেতারা। দেশে দেশে শুরু হয় প্রতিবাদ মিছিল। ট্রাম্পের সমালোচনা ও নিন্দা জানায় যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানিসহ পশ্চিমা বিশ্ব।

ট্রাম্পের স্বীকৃতির বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভোট হয়। তাতে ট্রাম্পের জেরুজালেম ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করা হয়। জেরুসালেম ইস্যুতে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগানের ভূমিকায় ছিল সবচেয়ে বেশি বলে ধারণা করা হয়। তিনি ওআইসির জরুরি মিটিং ডাক দেয় এবং তার েনেতৃত্বে পূর্ব জেরুসালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী ঘোষণা করা হয়। জেরুসালেম ইস্যু নিয়ে মুসলিম বিশ্ব ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট এর মাঝে এখন পর্য ন্ত কোনও প্রকার  সুষ্ঠু সমাধান হয়নি।

কাতার সংকট

২০১৭ সালের জুন মাসে সৌদি আরব, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর ছাড়াও আরও কয়েকটি দেশ কাতারের ওপর সন্ত্রাসবাদে সমর্থন দেয়ার' অভিযোগে এনে সঙ্গে কূটনৈতিক ও অন্যান্য সম্পর্ক ছিন্ন করে

উপসাগরীয় অঞ্চলের ছয়টি আরব দেশ কাতারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিলে এই সংকটের সৃষ্টি হয়। কাতারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী এবং ইরানকে সমর্থন করার অভিযোগে এসব দেশ কাতারের সাথে পরিবহন যোগাযোগও ছিন্ন করে।

আরব বিশ্বের চারটি দেশ কাতারের কাছে তাদের ১৩টি দাবির একটি তালিকা পাঠিয়ে বলেছিল এগুলো না মানলে তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা যাবে না। সৌদি আরব, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইন কাতারের কাছে দাবি জানিয়েছিল, আল জাজিরার সম্প্রচার বন্ধ করতে হবে।

তারা কাতারের কাছে আরও দাবি জানিয়েছে ইরানের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ সীমিত করতে হবে এবং তুরস্কে তাদের সেনা ঘাঁটি বন্ধ করতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে এসব দাবির কোনো মীমাংসা করা যাবে না বলে জানিয়েও দিয়েছিল ওই আরব দেশগুলো। এখন পর্যন্ত এই সংকটের কোনও সুরাহা হয়নি।

সৌদির উদার নীতি গ্রহণ

সৌদি আরবের যুবরাজ ও আগামীর বাদশা মুহাম্মদ বিন সালমান দেশ পরিচালনায় উদারনীতি গ্রহণের ঘোষণা দেন। বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে এখনো। সেখানে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি, স্টেডিয়ামে খেলা দেখা, সিনামা হল খুলে দেওয়াসহ আধুনিক অনেক বিষয় বাস্তাবায়নে কাজ চলছে।

এ লক্ষে যুবরাজ মুহাম্মদ ভিশন ৩০ নামের প্রকল্পও হাতে নিয়েছেন। গণমাধ্যমে এসব প্রকাশের পর আলোচনা সর্বত্র সৌদির আলোচনায় চোখে পড়ে। কেউ সহনীয় মনোভাব কেউ বা তীর্যক ভাষায় সমালোচনা করেন এসব পদক্ষেপের।এছাড়াও, হঠাৎ করেই সৌদি সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে ডজন খানেক প্রিন্সসহ বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রীকে আটক করেও সৌদি যুবরাজ খবরের শিরোনাম হয়।

গো হত্যার গুজব ছড়িয়ে মুসলিম হত্যা

কথিত গো-হত্যার অভিযোগ এনে বিগত বছরে ভারত মুসলিমদের ওপর নির্যাতন ও হত্যা চালানো হয়। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তার হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের সময়ে গরু জবাইকে কেন্দ্র করে প্রায় দেশের প্রতিটি রাজ্যে মুসলিমদের ওপর অমানবিক নির্য়াতন করা হয়।

এসব ঘটনায় দেশজুড়ে শতাধিক মুসলিম হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হন।

গরু বিক্রি এবং জবাইর ক্ষেত্রে কড়াকড়ির ফলে বিভ্রান্তি এবং উত্তেজনায় ভারত জুড়ে মুসলিমদের সংশয় ও ভয় সৃষ্টি হয়। এছাড়াও, তিন তালাক, তাজমহল ও বাবরি মসজিদসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকার ও উগ্রবাদী হিন্দুদের বিতর্কিত ভূমিকায় মোদি সরকার বারাবার সমালোচিত হয়।

কাশ্মীর উত্তেজনা

২০১৭ সালের মে মাসে কাশ্মীর সীমান্তে দুই ভারতীয় জওয়ানকে শিরচ্ছেদ করে হত্যার ঘটনায় কাশ্মীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। ভারত ও পাকিস্তানের ও স্থানীয় বিদ্রোহীদের মধ্যে উত্তেজনা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনার জের ধরে কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক অভিযান শুরু করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনী।

এছাড়াও, এপ্রিল মাসে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বুদগাম জেলায় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। এরপরে জীপের সামনে বাম্পারে টায়ার বসিয়ে তার ওপর রশি দিয়ে এক তরুণকে বেঁধে নিয়ে যায় নিরাপত্তা বাহিনী। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।

এতে তুমুল প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে দেশজুড়ে। এরকম কয়েকটি ঘটনায় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে টান টান উত্তেজনা কাজ করে।

খতমে নবুওয়াত ইস্যুতে পাকিস্তান উত্তাল

অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে পাকিস্তান পার্লামেন্টে খতমে নবুওয়াতের প্রতি সংশয় পোষণ এবং খতমে নবুওয়াতের ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় শপথে পরিবর্তন প্রস্তাব করে একটি বিল সংসদে উপস্থাপনের চেষ্টা হয়। সংসদে উত্থাপিত হওয়ার পূর্বেই তা ফাঁস হয়ে যায়। বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর দেশটির ইসলামপন্থী দলগুলো এর তদন্ত ও বিচার দাবি করে।

খতমে নবুওয়াত বিরোধী আইন পাশের প্রশ্নে উত্তাল হয়ে উঠে পাকিস্তান। পাকিস্তানের ধর্মীয় দলগুলো পার্লামেন্টে খতমে নবুওয়াত বিরোধী আইন পাশ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। তারা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিচারের দাবি জানায়। আন্দোলনকারীরা আইনমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিও তোলে।

পাকিস্তান সরকার এ বিষয়ে একটি উচ্চতর তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। জনগণকে তদন্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত ধৈর্য্য ধারণের আহবান জানান। শেষমেষ বিতর্কিত আইন পাশ থেকে বিরত থাকে পাকিস্তান সরকার, সাথেসাথে আইনমন্ত্রীও পদত্যাগ করে।

সাত মুসলিম দেশের ওপর ট্রাম্পের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা

ডোনাল্ট ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমদের ওপর বৈষম্য বড়ে যায়। ট্রাম্পকে সবাই ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধচারী হিসেবেই জানে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর  মুসলিম-প্রধান ৭টি দেশ থেকে নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী, অভিবাসী ও ভ্রমণকারী প্রবেশে যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

যে সাতটি দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে, সিরিয়া, ইরাক, ইরান, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান আর ইয়েমেন।

হামাস-ফাতাহ’র সমঝোতা

গত অক্টোবর মাসে  ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ও প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতাহ আন্দোলন জাতীয় সংহতি চুক্তি করে। মিশরের সহায়তায় রাজধানী কায়রোয় তিনদিনের আলোচনা শেষে এ সমঝোতা হয়েছে প্রধান দুই দলের।

প্রায় এক দশক ধরে দু দলের মধ্যে যে মতপার্থক্য চলে আসছিল তা নিরসনের জন্যই মূলত কায়রোয় এ বৈঠক হয়। ২০০৭ সাল থেকে হামাস ও ফাতাহর মধ্যে প্রচণ্ড চলে আসা রাজনৈতিক বিরোধ সমাঝোতার মাধ্যমে মিটে যাওযার আশা করা হয়। মুসলিম বিশ্ব এই সমাঝোতাকে স্বাগত জানায়।

এরদোগানকে হত্যার ষড়যন্ত্র

মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী নেতা তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তায়্যিব এরদোগানকে হত্যা করার পরিকল্পনা হয়। চরমপন্থী সংগঠন নাইন রেভ্যুলোশনারি পিপলস লিবারেশন পার্টি (ডিএইচকেপি-সি) এ হামলার গভীর ষড়যন্ত্র করে। গ্রিক সফরের সময় এ হামলার ষড়যন্ত্র করা হয়।কিন্তু তুর্কি নিরাপত্তা বাহিনী সেই প্রচেষ্টা বানচাল করে দেয় এবং একজন সন্ত্রাসীকেও আটক করতে সক্ষম হয়।

বামপন্থী এই সংগঠনের হত্যাচেষ্টা বানচাল হয়ে যাওয়ার পর মুসলিম বিশ্বে হালচাল সৃষ্টি হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এরদোগানকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।

মসজিদে হামলায় নিহত ৩০৫

মিশরের সিনাই প্রদেশের একটি মসজিদে হামলার ঘটনা পুরো বিশ্বকে মাথানত করে দেয়। সে হামলায় এক দিনেই ৩০৫ জন মুসল্লি প্রাণ হারান। হামলায় কমপক্ষে ২৭ শিশুও নিহত হয়।

হামলাকারীরা প্রথমে মসজিদটির মূল দরজা ঘিরে ফেলে। একইসঙ্গে তারা মসজিদটির ১২টি জানালার সামনে অবস্থান নিয়ে মুসল্লীদের ৭টি গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এরপরই নামাজরত মুসল্লীদের উপর বোমা হামলা শুরু করে সন্ত্রাসীরা। পরে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসা মুসল্লীদের উপর গুলি চালায় তারা।

পুরো বছরের আরও পর্যালোচনা পড়তে আওয়ার ইসলামের সঙ্গেই থাকুন

আরআর


সম্পর্কিত খবর