শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


‘কওমি স্বীকৃতি যেন কারও রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার না হয়’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কওমি মাদরাসা সনদের সরকারি স্বীকৃতি, অতীতের আন্দোলন সম্মেলন এবং ভবিষ্যত স্বকিয়তা রক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে আওয়ার ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়ার সিনিয়র মুহাদ্দিস ও যুব মজলিসের সভাপতি মাওলানা মামুনুল হক।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আওয়ার ইসলামের চিফ রিপোর্টার বশির ইবনে জাফর

আওয়ার ইসলাম: কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতির বিল জাতীয় সংসদে পাস হলো। এ আন্দোলনের সূচনাক্রম কেমন ছিলো?

মাওলানা মামুনুল হক: কওমি স্বীকৃতির আন্দোলনের শুরুটা আমরা পেয়েছি বেফাকুল মাদারিসের পক্ষ থেকে। স্বীকৃতির যে বিভিন্ন অফিসিয়াল কাগজপত্র তৈরি এবং তা নিয়ে কল্পনা-পরিকল্পনা- এটা দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত বেফাকুল মাদারিস করেছে।

এক্ষেত্রে বেফাকুল মাদারিসের মহাসচিব মাওলানা আবদুল জব্বার জাহানাবাদী রহ. নাম আগে আসে, তার আগে ছিলেন মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ.।

প্রাথমিক যে কার্যকলাপ তা ছিলো বেফাকের অবদান। পরে এটা একটা দাবিতে রুপান্তর হয়ে রাজপথে আমরা আমাদের কওমি ছাত্রজনতা সবাই যে সোচ্চার হই সেটা হয়েছে মূলত চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর।

কওমি সমালোচনার জবাব

যখন তারা ক্ষমতায় আসলো এবং যেহেতু সেখানে আমাদের কওমি উলামাদের বড় একটা ভূমিকা ছিলো সে হিসাবে তখন স্বীকৃতির প্রত্যাশাটা নতুন করে তৈরি হয়। তখন থেকেই কওমি সনদের স্বীকৃতির দাবিটা পর্যায়ক্রমে রাজপথে গড়ায়।

সে সময় ‘ছাত্র কনভেনশন’ এর ব্যানারে পল্টন ময়দানের প্রোগ্রামটি বেশ স্মরণীয়। এখানে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলের উলামায়ে কেরাম অংশ নেন এবং শায়খুল হাদিস রহ. প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন।

সেখানে তিনি একটিই বিশেষ কথা বলেন, চারদলীয় জোট বা সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদের  ন্যুনতম কোনো অবদান তার বিনিময়ে যেন কওমি স্বীকৃতি দেয়া হয়। এরপর এ দাবি নিয়ে তিনি আরো আন্দোলন করেছেন, মুক্তাঙ্গনে অবস্থান করেছেন।

মূলত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে শায়খুল হাদিস র. আন্দোলনটাই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ার মতো ছিলো। তখন এর সঙ্গে অনেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন তার মধ্যে মুফতি আমিনী রহ. বা চারদলীয় জোট সরকারে যেসব আলেম সংসদ সদস্য ছিলেন।

সেই সরকারের একদম শেষ মুহূর্তে অন্তিম সময়টায় তৎকালীনন চারদলীয় জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আলেমদের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ডেকে একটা ঘোষণা দেন কওমি মাদরাসার তাকমিলের সনদকে মাস্টার্সের সমমানের।

আওয়ার ইসলাম: ওই প্রক্রিয়াটা সফল না হওয়ার পেছনে সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়াটাকেই দায়ি মনে করেন নাকি ভিন্ন কোনো কারণ ছিলো?

মাওলানা মামুনুল হক: সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়াটা একটা বড় কারণ ছিলো। অফিসিয়ালভাবে এটি বাস্তবায়ন হওয়ার ক্ষেত্রে সময়টা যথেষ্ট ছিলো না।

তবে এরপর দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত কিন্তু তত্বাবধায়ক সরকার ছিলো প্রেসিডেন্ট ইয়াজ উদ্দীনের তত্ত্বাবধানে। সেটি ছিলো জোট সরকারেরই নিয়ন্ত্রণাধীন। ওই সময় আমরা লক্ষ্য করেছি আমলাতান্ত্রিক অনেক জটিলতা তৈরি করা হয়েছিল, যা না হলে স্বীকৃতি প্রক্রিয়া শেষ করা যেতো।

আওয়ার ইসলাম: বর্তমান সরকারের আমলে আলেম উলামারা যেভাবে চেয়েছেন ঠিক সেভাবে স্বীকৃতির বিল পাস হয়েছে, বিষয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মাওলানা মামুনুল হক: আসলে সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের আমলা সচিব বা কোনো কোনো ব্যক্তির ইচ্ছামাফিক এবং তাদের মতো করে স্বীকৃতির রূপরেখা বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে।

কিন্তু বেফাকুল মাদারিসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের সিংহভাগ উলামায়ে কেরাম ওই প্রক্রিয়াকে মেনে নেয়নি। সরকার এই বিষয়টা উপলব্ধি করতে পেরেছে। যা সরকারের একটা সফলতা।

সরকারের যে টপ মেনেজম্যান্ট, নির্দিষ্ট করে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথাই বলবো তিনি বিষয়টা এখানে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। বেফাককে বাদ দিয়ে বা ভিন্ন কোনো উপায়ে স্বীকৃতি বাস্তবায়ন করতে গেলে তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।

এছাড়া আলেমদের সাথে কিংবা ইসলামপন্থীদের সাথে সরকারের দীর্ঘদিনের যে বৈরিতা ছিলো তা দূর হয়ে একটা ভালো সম্পর্ক হোক সেগুলো বুঝেই সরকার সঠিক পথে অগ্রসর হয়েছে।

আওয়ার ইসলাম: শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশ বা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এ স্বীকৃতি কতোটুকু ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে?

মাওলানা মামুনুল হক: এ স্বীকৃতি দিয়ে মেধা বিকাশ বা উচ্চশিক্ষার বড় কোনো অবকাশ তৈরি হবে এমনটি আমি মনে করি না বরং আমাদের যে চলমান প্রক্রিয়া সেটা এভাবেই চলবে।

তবে স্বীকৃতির দ্বারা নতুন কোনো অর্জন বলতে এতোটুকুই যে, রাষ্ট্রীয়ভাবে খেদমত বা অবদান রাখার ক্ষেত্র তৈরি হবে।

আওয়ার ইসলাম: তার মানেবাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে এই স্বীকৃতি কাজে আসবে?

মাওলানা মামুনুল হক: হ্যাঁ, এ ক্ষেত্রে কিছু সুযোগ এখনই আছে এবং ভবিষ্যতে আরো কিছু সুযোগ তৈরি হবে।

যেমন সরকার যদি চিন্তা করে বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রগুলোতে যেখানে ধর্ম শিক্ষকের একটা অপশন থাকে- সেখানে কওমি মাদরাসার সনদধারীদের সংযুক্ত করতে পারে। সেখানে তাদের কাজে লাগানো যায়। এমন সুযোগ তৈরি হতে পারে।

আওয়ার ইসলাম: স্বীকৃতি হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেয়া হবে আলেমদের থেকে।  সেটাকে কিভাবে দেখছেন বা সেটা কিভাবে হতে পারে বা সেটা আদৌ হওয়ার দরকার আছে কিনা?

মাওলানা মামুনুল হক: এটা আসলে বড়দের একটা বিষয়। সরকার এই স্বীকৃতিটা দিয়েছে এবং সরকারের ভেতর থেকে এটার একটা চাহিদা আছে যে একটা সংবর্ধনা বাস্তবায়িত হোক।

এক্ষেত্রে সরকার যেহেতু উলামায়ে কেরামের কথা রেখেছে এবং তারা যেভাবে স্বীকৃতি চেয়েছেন সেভাবেই দিয়েছে। তাই সরকারের এ ইচ্ছাটা বা মনোবাসনাটা যদি পূর্ণ না হয় তবে সৌজন্যতার প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়।

সেক্ষেত্রে তো আমাদের উলামায়ে কেরাম এক রকম এটা খুবই স্পর্শকাতর জায়গায় উপনীত। তাই সৌজন্যতা রক্ষার জন্য হলেও তাদের একটা সংবর্ধানা দেবার প্রয়োজন। তাই একটা প্রোগ্রাম হয়ত আয়োজন করা লাগতেই পারে।

আওয়ার ইসলাম: স্বীকৃতির কারণে দীর্ঘদিনের যে একটা স্বকীয়তা ছিলো সেটা কি কোনোভাবে নষ্ট হতে পারে?

মাওলানা মামুনুল হক: হ্যাঁ নষ্ট হওয়ার একটা আশঙ্কা তো আছেই। যদি আলেম উলামা বা যারা শিক্ষাব্যবস্থা অর্থাৎ হাইয়াতুল উলয়ায় যারা দায়িত্বশীল তারা যদি এ ভূমিকা পালন করতে গিয়ে এখানকার অবস্থানকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক কোনো সুযোগ সুবিধা অর্জনের চিন্তা করে এটা আমাদের জন্য বড় একটা বিপদের কারণ হবে।

আমি এ জায়গাটাকেই সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করবো, আল হাইয়াতুল উলয়া বা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক যারা থাকবেন তারা যেন কখনোই এ ফোরামকে ব্যবহার করে বা এ ফোরামে অবস্থান করে সরকারি সুযোগ সুবিধা গ্রহণ না করেন। বরং এ ব্যাপারে তারা যেন সোচ্চার এবং সচেতন থাকেন।

আর যে বিষয়টি জোর দিয়ে বলবো তা হলো, ঐক্য। যদি আমাদের গোটা কওমিমহল ঐক্যবদ্ধ থাকে তাহলে ইনশাল্লাহ আমি বিশ্বাস করি কোনো সরকারই এ স্বীকৃতির মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।

আওয়ার ইসলাম: স্বীকৃতিটার পর বেশ আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে এ নিয়ে। তো সর্বশেষ আপনার কাছে জানতে চাই, এ আলোচনার রেশ কাটিয়ে উঠার জন্য আপনি সবাইকে কী বলবেন?

মাওলানা মামুনুল হক: আমার মনেনে হয়, স্বীকৃতির পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা-সমালোচনা থাকলে কোনো সমস্যা নেই। যটি সেটা নোংরা সমালোচনা না হয়।

বরং ‍ভালো আলোচনা-সমালোচনা যদি থাকে এবং সেটা যদি সুন্দরভাবে হয় তাহলে আমাদের দায়িত্বশীলদের পথ চলতে সহায়ক হবে।

আওয়ার ইসলাম: আওয়ার ইসলামের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ, আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য।

মাওলানা মামুনুল হক: আওয়ার ইসলাম পরিবারের সবাইকে বিশেষ করে আপনাকে এবং সম্পাদকসহ এখানে যারা কর্মরত আছেন এবং এর সকল পাঠকে আমার ব্যক্তিগত পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা রইলো।

সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও হস্তক্ষেপমুক্ত কওমি স্বীকৃতি বিরল ঘটনা: মুফতি ওয়াক্কাস

‘আলিয়া বা কওমির যে শিক্ষা এটাই ইসলামি শিক্ষা নয়’

-আরআর


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ