বুধবার, ০৮ মে ২০২৪ ।। ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫


মুসলিম জাতি কেন আজ খ্রিস্টান বর্ষপঞ্জি মানতে বাধ্য হচ্ছে?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

তারেকুল ইসলাম
রাজনৈতিক বিশ্লেষক

বর্ষবরণের সাথে সম্পর্কিত থার্টি ফার্স্ট নাইট ও মঙ্গল শোভাযাত্রা— এ দুটোই আমাদের মুসলিম জাতীয় চেতনা ও ইসলামি মূল্যবোধের বিরোধী। নতুন বছরকে যদি স্বাগত জানাতেই হয়, তাহলে সেটা বিশেষ কোনো খ্রিস্টান ও হিন্দু ফেস্টিভ্যাল উদযাপনের মধ্যদিয়ে নয়।

কথা হচ্ছে, আজকে আমাদের জীবনযাপনে সর্বত্র খ্রিস্টান বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করতে হচ্ছে বলেই নতুন বছরকে স্বাগত না জানিয়ে উপায় থাকে না। ইটস অ্যা ম্যাটার অব ফ্যাক্ট, নট সামথিং স্ট্রেইঞ্জ। তার মানে এই নয় যে, ইসলামি মূল্যবোধের পরিপন্থী থার্টি ফার্স্ট নামের ডার্টি নাইট ও মঙ্গল শোভাযাত্রা উদযাপন করে বর্ষবরণ করতে হবে।

ইংরেজি বর্ষপঞ্জিকে গ্রেগরিয়ান বা খ্রিস্টান বর্ষপঞ্জিও বলা হয়। কারণ ১৫৮২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি খ্রিস্টান পোপ (১৩) গ্রেগরি কর্তৃক এই বর্ষপঞ্জি প্রবর্তিত হয়। মনে রাখা জরুরি যে, যিশু খ্রিস্টের স্মরণেই কিন্তু খ্রিস্টাব্দ বা খ্রিস্টান বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করা হয়েছিল।

মুসলিম জাতির জন্য ইসলামি বর্ষপঞ্জি অনুসরণের রাজনৈতিক গ্রাউন্ড কোথায়? ১৯২৪ সালে খেলাফতব্যবস্থার বিলুপ্তির পর থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বা ওয়ার্ল্ড অর্ডারে মুসলিম সভ্যতার অবস্থান ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করে। কোনো সভ্যতার নিজ বর্ষপঞ্জি অনুসরণের বিষয়টি সেই সভ্যতার বৈশ্বিক প্রভাব ও আধিপত্যের ওপর নির্ভর করে বলে আমি মনে করি।

যেমন, ইসলামি বর্ষপঞ্জি বা হিজরি বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন খোলাফায়ে রাশেদার দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর রা.। তিনি তখন অর্ধজাহান শাসন করছিলেন। তখন বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব না থাকলে ইসলামি বর্ষপঞ্জি বা হিজরি সনের প্রবর্তন করা সম্ভব হতো না।

এই উপমহাদেশজুড়ে মোঘল সম্রাট আকবর যখন ক্ষমতার সিংহাসনে ছিলেন, তখন তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করা।

কিন্তু আজ কেন আমরা মুসলমানরা পাশ্চাত্যের খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করতে বাধ্য হচ্ছি? কেন ইসলামি বর্ষপঞ্জি অনুসারে আমরা আন্তর্জাতিক ও রাষ্ট্রীয় অভ্যন্তরীণ কাজকর্ম করতে পারছি না।

কারণ বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন ও অনুসরণের সাথে বৈশ্বিক পর্যায়ের ক্ষমতাসম্পর্ক জড়িত বলে আমি মনে করি। আর ওয়ার্ল্ড অর্ডারে মুসলিম বিশ্বের ক্ষমতাহীনতার কারণেই আজ খ্রিস্টানদের বর্ষপঞ্জি, পোশাক-আশাক, রাষ্ট্রদর্শন, বিজ্ঞান—সবকিছু মুসলমানদের অনুসরণ করে চলতে হচ্ছে। এটা মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের চরম লজ্জাজনক ব্যর্থতা!

তাছাড়া, এখন তো আমরা পাশ্চাত্যের মডার্ন স্টেট বা আধুনিক সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর অধীন। খ্রিস্টানিটির গর্ভ থেকে যেই মডার্নিজমের জন্ম, সেই মডার্নজিম এমন একটা মডার্ন ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্রের ধারণা দেয়, যার সাথে খ্রিস্টান সভ্যতার রয়েছে ঐতিহাসিক মিল-সম্পর্ক; পক্ষান্তরে আর সব সভ্যতার সাথে রয়েছে নানামাত্রিক ভিন্নতা ও দ্বন্দ্ব।

কিন্তু আমরা মুসলমানরা পাশ্চাত্যের মডার্ন স্টেটক্র্যাফট বা রাষ্ট্রদর্শন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গ্রহণ করার কারণে পাশ্চাত্যের অনেক কালচার ও দর্শনের সাথে সমন্বয় করে চলাটা আমাদের জন্য বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ এক কঠিন সত্য বৈকি!!

যতদিন পাশ্চাত্য থেকে ভিন্ন হয়ে মুসলিম জাতি নিজেদের মূল্যবোধসম্পন্ন স্বতন্ত্র রাষ্ট্রদর্শন ও রাষ্ট্রকাঠামো, কিংবা ওয়ার্ল্ড অর্ডারে পরাশক্তি হিসেবে তাদের আধিপত্যকেন্দ্র সৃষ্টি করতে পারবে না, ততদিন পর্যন্ত পাশ্চাত্যকে সমঝে চলতে হবে। নইলে বোমা মেরে ইরাক-আফগানিস্তান-লিবিয়ায় পরিণত করে মুসলিম জাতি ও সভ্যতাকে ধ্বংস করতে থাকবে।

ফলত পাশ্চাত্য সভ্যতা বিশ্বব্যাপী আধিপত্য ও ক্ষমতার ছড়ি ঘুরাতে সক্ষম হচ্ছে বলেই মুসলমানরা বাধ্য হচ্ছে খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করতে। এই হলো আমার মোদ্দা কথা।

ষড়যন্ত্রেরকবলে ভারতের মসজিদ মাদরাসা : দেওবন্দের জরুরি বৈঠক

১৯২৪ সালে মুসলিম জাতির আন্তর্জাতিক খেলাফতব্যবস্থার বিলুপ্তির পর দুনিয়াব্যাপী পাশ্চাত্য খ্রিস্টান জাতির নয়া আধিপত্য তৈরি হয়। তাদের নির্মিত নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার বা নয়া বিশ্বব্যবস্থার অধীনে চলে আসে মুসলিম দেশগুলো। খেলাফতের পতনের পর মুসলিম দেশগুলোকে ভাগাভাগি করে একে একে দখল করে নেয় ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলো।

যাই হোক, পাশ্চাত্য খ্রিস্টানিটির গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া মডার্ন রাষ্ট্রদর্শন ও রাষ্ট্রকাঠামো অনুসরণের ফলে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে খ্রিস্টান বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা ছাড়া উপায়ান্তর নেই।

আফসোস করে বলতেই হয়, মুসলিম জাতি আজ অর্ধজাহান শাসন করা তাদের খলিফার প্রবর্তিত ইসলামি বর্ষপঞ্জি না মেনে খ্রিস্টান পোপের প্রবর্তিত খ্রিস্টান বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করছে। অথচ আজ যদি পাশ্চাত্য সভ্যতার পতন হয় এবং পরিবর্তে ওয়ার্ল্ড অর্ডারে মুসলিম সভ্যতার একক আধিপত্য তৈরি হয়, তখন যদি দুনিয়াব্যাপী খ্রিস্টান বর্ষপঞ্জির পরিবর্তে ইসলামি বর্ষপঞ্জি চালু করা হয়, আমি নিশ্চিত— খ্রিস্টান বিশ্ব কোনো বছরই ইসলামি বর্ষপঞ্জিকে বরণ করে নেবে না। ইসলামি উদযাপন থেকে তারা ঠিকই বিরত থাকবে, কারণ তারা নিজ সভ্যতার মর্ম ও মূল্য বোঝে।

কিন্তু সমস্যা তো আমাদের মুসলমানদের। আত্মভোলা, অসচেতন ও ইতিহাস-অজ্ঞ বলেই তারা পাশ্চাত্য সভ্যতার খ্রিস্টান কালচারে আবিষ্ট হয়ে পড়েছে।

আর হ্যাঁ, বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে এটাও সত্য যে, আমরা বাংলা বর্ষপঞ্জি কিংবা ইসলামি বর্ষপঞ্জি মেনে কাজকর্ম করি না। খ্রিস্টান বর্ষপঞ্জিই আমাদেরকে মেনে চলতে হয়। তবে সুখের কথা হলো, বিশেষত কওমি মাদরাসায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইসলামি বর্ষপঞ্জি তথা হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। এজন্য কওমিদের মধ্যে ঔপনিবেশিক গোলামির মন-মেজাজ ও চরিত্র দেখা যায় না।

গ্রিক মূর্তি ও কওমি স্বীকৃতি; শপথ থেকে স্বপথে


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ