শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


গ্রিক মূর্তি ও কওমি স্বীকৃতি; শপথ থেকে স্বপথে

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আতাউর রহমান খসরু
আওয়ার ইসলাম

বিদায়ী বছর ২০১৭ সালের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুটি বিষয় বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছিলো- তাহলো সুপ্রিম কোর্টের সামনে গ্রিক মূর্তি স্থাপন ও কওমি মাদরাসার শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিষয়দুটি। বছরের শুরুতে দেশের রাজনীতিতে আলোচনা ও উত্তেজনার রেশ দেয় সুপ্রিম কোর্টের সামনে গ্রিক মূর্তি স্থাপন এবং বছরের মধ্যভাগে এসে তাতে লাগাম টেনে ধরে কওমি মাদরাসার শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি।

ধর্মপ্রাণ মানুষের দাবি প্রেক্ষিতে কোর্টের সামনে থেকে সরেছে গ্রিক মূর্তি। যদিও তা আরেকটি স্থানে বসানো হয়েছে বলে কিছুটা অসন্তুষ্টি রয়েছে জনমনে।

স্বীকৃতি বিষয়ে কওমি ধারার লাখো শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের প্রত্যাশা ছিলো সরকার তা চূড়ান্ত আইনি রূপ দিতে তা সংসদে পাশ করা হবে। কিন্তু সেই প্রত্যাশা এখনো পূর্ণ হয়নি।

গ্রিক মূর্তিতে উত্তাল দেশ

আদালতপ্রাঙ্গনে মূর্তি স্থাপন করা হয় ২০১৬ সালের শেষভাগে। ডিসেম্বর ২০১৬তে গ্রিকমূর্তি স্থাপনের বিভিন্ন সংবাদ গণমাধ্যমে আসতে শুরু করে। কিন্তু এ নিয়ে ইসলামি দলগুলো প্রায় দুই মাস কোনো ধরনের প্রতিবাদ বা আন্দোলন করে নি।

ফেব্রুয়ারিতে এ বিষয়ে প্রায় এক সঙ্গে প্রতিবাদ ও আন্দোলনে নামে হেফাজত ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ সব ইসলামী দল।

ফেব্রুয়ারির শেষভাগ থেকে পুরো মার্চ জুড়ে রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে চলতে থাকে গণমুখী আন্দোলন। এতে খানিকটা বেকায়দায় পড়ে সরকার। বিশেষত মসজিদ ভিত্তিক গণআন্দোলন শুরু হওয়ার পর সরকার তাতে জামাত-বিএনপির জড়িয়ে পড়ার আশংকা করে। তখন প্রধানমন্ত্রী নিজে তা সমাধানের উদ্যোগ নেন।

মূর্তি ইস্যুতে সরকার প্রথম চুপ, পরে অপসারণের দাবির সমালোচনা করলেও আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করলে সুর পাল্টে ফেলে। বিষয়টি আদালতের ইখতিয়ারভূক্ত বলে বিবৃতি দেয় সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীগণ। কিন্তু তাতেও আন্দোলন না থামায় প্রধানমন্ত্রী নিজে তা সমাধানের উদ্যোগ নেন।

তিনি প্রথমে এক অনুষ্ঠানে আদালতের সামনে শাড়ি-পরানো গ্রিক মূর্তি স্থাপনের সমালোচনা করেন। অবশেষে ১১ এপ্রিল গণভবনে কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি প্রদান অনুষ্ঠানে মূর্তি অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় স্বস্তি ফেরে ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রাণে এবং তাকে অভিনন্দন জানায় এ ঘোষণার জন্য।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার প্রায় ১১দিন পর ২৫ এপ্রিল রাতের আঁধারে গ্রিক মূর্তি অপসারণ করা হয়।

তবে পরদিন জানা যায়, মূর্তিটি আগের জায়গা থেকে কয়েকশো ফিট দূরে তা পুনর্স্থাপন করা হয়েছে। এ সংবাদ পেয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাতের মধ্যভাবে প্রেস ক্লাবের সামনে অনশন শুরু করে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় অন্যান্য ইসলামি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ মানুষ। কিন্তু রাতের শেষভাগেই তাদের উচ্ছেদ করে পুলিশ। আটকও করে নিয়ে যায় কয়েকজনকে।

শান্ত হলো কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতিতে

কওমি মাদরাসার শিক্ষা সনদের মান বা স্বীকৃতি কওমিপড়ুয়া লাখো শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবি। এ দাবি কয়েক দশকের পুরাতন হলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসলে জোটের অন্যতম শরিক ইসলামী ঐক্যজোট এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

ইসলামী ঐক্যজোটের উভয়াংশের নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টায় ২০০৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কওমি শিক্ষা সনদের মান ঘোষণা করেন এবং এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু এরপর পর্যাপ্ত সময় না থাকায় স্বীকৃতির বিষয়টি আর সামনে অগ্রসর হয় নি।

দীর্ঘদিন ধরে দাবির প্রেক্ষিতে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় এসেই কওমি মাদরাসার শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি দেয়ার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতি অনেকের অনাস্থা এবং কওমি মাদরাসার প্রতিনিধিত্বকারী সকল বোর্ডের সমন্বয় না থাকায় সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি নিতে অস্বীকৃতি জানায় উলামায়ে কেরামের বড় একটি অংশ।

এ সময় দুটি নাম সামনে আসে। তাহলো, আল্লামা আহমদ শফী ও আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। শীর্ষ এ দুই আলেমের মাঝে দূরত্বে পিছিয়ে যাচ্ছিলো কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি।

এ বিষয়ে আওয়ার ইসলামে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আল্লামা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বলেন, আল্লামা আহমদ শফীর পা আমার মাথার সমান। তার এ বক্তব্যে বরফ গলতে শুরু করে এবং অবশেষে গত ২৮ মার্চ শিক্ষামন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে বাংলাদেশের কওমি মাদরাসার প্রতিনিধিত্বকারী ৬ বোর্ডের নেতৃবৃন্দ স্বীকৃতি গ্রহণ ও প্রজ্ঞাপন জারি বিষয়ে একমত পোষণ করেন।

সে মতে ১১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে আলেমদের এক সমাবেশে কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি এবং দাওরায়ে হাদিস (তাকমিল) কে ইসলামি স্টাডিজ ও অ্যারাবিকে মাস্টার্সের সমমান প্রদানের ঘোষণা দেন।

১২ এপ্রিল ৩২ সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়। যার নামকরণ করা হয় রাবেতাতুল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ। পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়্যা বাংলাদেশ রাখা হয়। ৩২ সদস্যের কমিটিকে স্বীকৃতি ও শিক্ষা সনদের মান প্রদান করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে ১৩ এপ্রিল।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় সন্তোষ প্রকাশ করে দেশের উলামায়ে কেরাম এবং ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিবাদ জানায় বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এবং তথাকথিত সুন্নী জামাত। স্বীকৃতি বাতিলের দাবি জানিয়ে আদালতে একটি রিটও করে সুন্নী জামাত। যা ২২ মে খারিজ করে দেয়া হয়।

১৬ এপ্রিল হাটহাজারীতে প্রথম বৈঠক মিলিত হয় ৩২ সদস্যের কমিটি। এ বৈঠকেই পরীক্ষা বিষয়ক উপ-কমিটি গঠন করা হয় এবং গহরডাঙ্গা বোর্ডের মাওলানা শামসুল হককে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

কিন্তু তার শারীরিক অসুস্থতার দরুন বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার মাওলানা আবু ইউসুফকে এবং সর্বশেষ ২৪ মে মাওলানা ইসমাইল বরিশালীকে ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে নিয়োগ দেয়া হয়।

স্বীকৃতি প্রদানের পর ১৩ মে প্রথমবারের মতো সারা দেশে একযোগে দাওরায়ে হাদিস (তাকমিল) পরীক্ষার অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৬ বোর্ড থেকে ১৯৩৯৩ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। ১ জিলহজ ২৫ জুলাই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়।

কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতির এক মাসের মধ্যে ৬ বোর্ডের সমন্বয় করে একটি পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ এবং মাত্র ২ মাসে তার ফলাফল প্রকাশ করে কওমি শিক্ষাবোর্ডগুলো তাদের শক্ত সামর্থের কথাই জানান দিয়েছিলো। কিন্তু এ ব্যস্ততায় পিছিয়ে পড়েছিলো মূল স্বীকৃতি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া।

পরীক্ষাগ্রহণের কাজ শেষ হওয়ার ১১জুন আল্লামা আহমদ শফীর চিঠি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন হাইআতুল উলয়ার প্রতিনিধি দল। এ সময় প্রধানমন্ত্রী তাদের দ্রুততম সময়ে তা সংসদে উত্থাপনের আশ্বাস প্রদান করেন।

এরপর দীর্ঘদিন আলোচনার বাইরে চলে যায় স্বীকৃতি ইস্যুটি। দীর্ঘ বিরতির পর ২ অক্টোবর ঢাকার পীরজঙ্গী মাদরাসার এক বৈঠকে হাইআতুল উলয়ার (খসড়া) গঠনতন্ত্র অনুমোদিত হয়। কিন্তু এতে কয়েকটি বিষয়ে আপত্তি তোলে বেফাক ব্যতীত অন্য ৫ বোর্ড।

তারা হাইআতুল উলয়াকে বিশ্ববিদ্যালয় না করাসহ ৫টি দাবি উত্থাপন করে এবং তা আদায়ের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন। বিষয়টি নিয়ে বেফাক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সঙ্গে ৫ বোর্ডের নেতৃবৃন্দের একাধিক বৈঠক সম্পন্ন হয়।

তাদের তৎপরতায় বেফাক সাময়িক নমনীয়তা দেখায় এবং তাদের প্রায় সব দাবিই মেনে নেয়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু সব দাবির ব্যাপারে চূড়ান্ত হওয়ার কথা ছিলো গত ৬ ডিসেম্বর মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার অনুষ্ঠিত হাইআতুল উলয়ার বৈঠকে।

সে বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয় না করা ব্যতীত ৫ বোর্ডের সব দাবি প্রত্যাখান করা হয় এবং আশ্চর্যজনকভাবে ৫ বোর্ড তাদের দাবির ব্যাপারে কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসে।

হাটহাজারির বৈঠকের পর হাইআতুল উলয়ার গঠনতন্ত্র কোন পর্যায়ে রয়েছে এবং তা কবে নাগাদ চূড়ান্ত হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে মন্ত্রী সভায় উঠবে সে বিষয় নতুন করে কিছুই জানা যায় নি।

তবে হাইআতুল উলয়ার কাজের গতি ও সরকারের মনোভব বলছে, অত্যন্ত আওয়ামী সরকারের এ মেয়াদে সংসদে উঠছে না কওমি শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি বিল।

ফিরে দেখা ২০১৭ : মুসলিম বিশ্বের আলোচিত ঘটনাগুলো


সম্পর্কিত খবর