রোকন রাইয়ান
নির্বাহী সম্পাদক
মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা ও বৌদ্ধদের গণহত্যার মুখে পালিয়ে আসা নতুন ৪ লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। পুরাতন মিলিয়ে বাংলাদেশে সরকারি হিসেবে বর্তমানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৩০ হাজার।
আশ্রয় নেয়া এসব রোহিঙ্গা নানারকম দুর্ভোগে দিন পার করছে। যদিও বাংলাদেশ শুরু থেকেই আন্তরিক এবং যথাসাধ্য তাদের খাবার ও থাকার ব্যবস্থা করছেন, বিশ্বের অনেক দেশও এগিয়ে এসেছে, তবুও সংখ্যাধিক্যে সেসবকে অপ্রতুলই বলছেন ক্যাম্প ঘুরে আসা বিশ্লেষকগণ।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শুরু থেকেই সেবাকর্মে সক্রিয় দেশ বিদেশের আলেমগণ। আর্থিক সাহায্য ও কায়িক শ্রম দিয়ে তারা পাশে থাকছেন রোহিঙ্গাদের। হাজারও কষ্ট দুর্ভোগের মধ্যেও সেগুলো অসহায় শরণার্থীদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলছে।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে এসেছেন বিশিষ্ট লেখক অনুবাদ ও মুহাদ্দিস মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন। তার নেতৃত্বে একটি টিম ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিল সেখানে। প্রথমে বান্দরবান পরে কক্সবারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাণ বিতরণ করেছেন তারা। দেখেছেন শরণার্থীদের দুর্ভোগ।
মাওলানা মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সবচেয়ে বেশি অর্থ ও শ্রম দিচ্ছেন আলেমগণ। যদিও আলেমরা প্রচারপ্রত্যাশী না হওয়ায় এগুলো মিডিয়ায় আসছে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের শ্রম ও সাহায্যই চোখে পড়েছে ক্যাম্পগুলোতে।
তিনদিনে দশ লক্ষ টাকা বিতরণ করেছেন মাওলানা মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীনের টিম
আমরা জমিয়তুল উলামার পক্ষ থেকে একটি টিম গিয়েছিলাম। তবে সেখানে তাবলিগ জামাত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নুসরত সবচেয়ে ভালো ও শৃঙ্খলিতভাবে হতে দেখেছি।
তাবলিগ জামাত রাতের বেলায় খুব নিরিবিলি ত্রাণ দিয়ে আসছে। তাদের অনুসরণ করে আমরাও তিনটা টিম পাঠিয়েছি একেবারে সীমান্তের কাছাকাছি থাকা রোহিঙ্গাদের কাছে। যেখানে অন্যদের যাতায়াতটা খুব সহজ ছিল না।
তাবলিগ জামাত ও আলেমদের কাজের ধরণগুলো এমন- রাতের বেলা দেখা যায় না এমন কাপড় পরে টিম করে বেড়িয়ে যায়, প্রতিটি তাবুর লোকদের ঘুম থেকে উঠিয়ে টাকা হাতে দিয়ে চলে আসেন। এছাড়া সুষ্ঠুভাবে সবার কাছে ত্রাণ পৌঁছানো অসম্ভব। কারণ ত্রাণ নিয়ে কেউ আসছে শুনলেই ছুটে আসবে সবাই। কেননা ওখানে প্রচুর ত্রাণ প্রয়োজন এবং অধিকাংশই ক্ষুধার্ত।
আরেকটি বিষয় হলো, ঢাকা থেকে বসে বসে মনে হবে ত্রাণ নিয়ে অনেক গাড়ি যাচ্ছে, লোকজন বিপুল পরিমাণ ত্রাণ পাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে চিত্রটা ভিন্ন। সেখানে দুই তিনদিন অবস্থান করলেই বোঝা যায় ত্রাণের পরিমাণ খুবই সামান্য। কারণ ত্রাণ প্রত্যাশী মানুষের সংখ্যা ধারণার চাইতেও অনেক বেশি।
আলেমদের মধ্যে যারা কাজ করছেন তারা সাময়িক ত্রাণের পাশাপাশি স্থায়ী কিছু করারও ব্যবস্থা করছেন।
যেমন স্থায়ী ক্যাম্প করে দেয়া, মসজিদ করা, নারী পুরুষ আলাদা গোসল করতে পারে তার ব্যবস্থা করে দেয়া, মক্তব, নলকূপ করে দেয়া, যারা কুরআন পড়তে পারে তাদের জন্য কুরআন শরীফের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলনের পক্ষ থেকে একটি লঙ্গরখানাও খুলেছে। এই চিন্তাগুলো খুবই জরুরি। কারণ মিয়ানমার যতদিন পর্যন্ত এদের কোনো ব্যবস্থা না করবে ততদিন তারা এখানেই থেকে যাবে। সুতরাং তাদের জন্য স্থায়ী কাজগুলো জরুরি।
যারা আগামীতে ওখানে সাহায্য করার চিন্তা করছেন তাদের জন্য পরামর্শ দিয়ে মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন বলেন, তাবলিগ জামাত বা ইসলামী আন্দোলন, জমিয়তে উলামাসহ অন্যান্য দল যারা স্থায়ীভাবে সরকারের পারমিশন নিয়ে ওখানে কাজ করছেন তাদের সঙ্গে যদি কাজ করা হয় তাহলে তাদের জীবন রক্ষার পাশাপাশি ঈমান রক্ষাটাও হবে।
তাবলিগ জামাতের কী পরিমাণ সাথী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করছে জানতে চাইলে মাওলানা যাইনুল আবিদীন বলেন, ওখানে নিয়মিত জামাত পাঠানো হচ্ছে। এটা নির্দিষ্ট নেই। প্রতিটি জামাত এসে তিনদিন করে গাশতের পাশাপাশি ত্রাণ বিতরণ করছে এবং চলে যাচ্ছে। আবার নতুন জামাত আসছে। এতে সুবিধা হলো তারা নতুন করে অর্থ ও ত্রাণ আনতে পারছে, কাজেও সুবিধা করতে পারছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শ্রম ও অর্থ দেয়া আলেমদের পরিমাণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা যত জায়গায় গিয়েছি চা খেয়েছি হোটেলে বা নামাজ পড়েছি দেখেছি বিপুল পরিমাণ বাইরের আলেম ওলামা। দশটা গাড়ি যদি যায় তার মধ্যে ৭ টাই আলেমদের।
অতীতের আলেমও সমাজকর্মের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, বরিশালে যখন সিডর হলো, তখন বিপুল পরিমাণ আলেম ওলামা সেখানে গিয়ে অর্থ ও শ্রম দিয়েছেন। এছাড়াও নেত্রকোণায় একবার বড় আকারের ঘূর্ণিঝড় হলো সেখানেও আলেম ওলামা ছুটেছেন। সে সময় ওই অঞ্চলের সবগুলো মাদরাসার ক্লাস বন্ধ রাখা হয়েছিল যাতে করে ছাত্র শিক্ষকরা ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্তদের সাহায্য করতে পারে। এছাড়াও সম্প্রতি যে বন্যা হয়ে গেল উত্তরবঙ্গে সেখানেও আলেমদের আধিক্য দেখা গেছে।
সেসময় নেত্রকোণার ঘূর্ণিঝড় আক্রান্তরা বলেছেন, রাজনৈতিক লোকেরা আসে অল্প কিছু নিয়ে আর বেশি বেশি ছবি তোলে। আপনাদের থেকেই আমরা কিছু পাচ্ছি।
মাওলানা যাইনুল আবিদীন বলেন, সব প্রাকৃতিক দুর্যোগেই আলেমরা সবার আগে এগিয়ে এসেছে। ছুটেছে সাহায্য নিয়ে। কিন্তু তাদের প্রতি মিডিয়ার অনিহার কারণে এসব ফুটে উঠেনি। এ জন্য দেখা গেছে কেউ কিছু তালগাছ লাগিয়েছে সে সাদা মনের মানুষ, কেউ কিছু বিড়াল পালে তাদের খাওয়ায় তিনি সাদা মনের মানুষ। মিডিয়া তাদের হাইলাইট করেছে।
তিনি আওয়ার ইসলামকে লক্ষ করে বলেন, আলেমদের এই দলিলগুলো তৈরি করতে হবে আপনাদের। আপনারা এগুলোতে হাত দিন। একটা ভালো প্রিন্টকপি প্রকাশ করুন এই কাজগুলো নিয়ে। যেন এই দলিলগুলো আমাদের সবার হাতে হাতে থাকে। অর্থ শ্রম লাগলে মানুষ সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসবে ইনশাল্লাহ।
শরণার্থী রোহিঙ্গাদের এই মুহূর্তের মনোভাব কী জানতে চাইলে মাওলানা যাইনুল আবিদীন বলেন, রাখাইনে রোহিঙ্গারা কখনোই ভালো ছিল না। কখনোই তারা মর্যাদাশীল জীবন যাপন করতে পারেনি। প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটা সময় তাদের উপর অন্যায় জুলুম ও নির্যাতন করা হয়েছে।
ভারত যখন স্বাধীন হয় তখন বলা হয়েছিল তাদের আলাদা রাজ্য দেয়া হবে কিন্তু তারা সেটি আজও পায়নি। তারা অবেহেলার শিকার হতে হতে সর্বশেষ ১৯৮২ সালে প্রথম বাংলাদেশে আসে। তখন জিয়াউর রহমান তাদের হুমকি দিয়ে ফেরত নিতে বাধ্য করেন। সেসময় হুমকি দেয়া হয়েছিল তোমরা এদের ফেরত না নিলে সামরিক ট্রেনিং দিয়ে রাখাইনে পাঠানো হবে।
এখনো হয়তো সেরকম কোনো হুমকি বাংলাদেশ কিংবা বিশ্ব থেকে আসত তবে মিয়ানমার অনেকটাই গুটিয়ে যেত। দুর্ভাগ্যক্রমে সেরকম কিছু দেখিনি আমরা। তুরস্ক, মালয়েশিয়া বিষয়টিতে তৎপর হলেও তারাও কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
আলেমদের নির্মাণাধীন মসজিদ
তবে রোহিঙ্গাদের এখনকার মানসিকতা হলো, নির্যাতনের শিকার হতে হতে তারা অনেকটাই নিষ্পৃহ হয়ে পড়েছে। তারা বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞ। কারণ বাংলাদেশ তাদের খাওয়াচ্ছে। সরকারের প্রশংসা করছে। তবে মনে মনে তো তারা নিজ দেশের স্বাধীনতা কামনা করতে ছাড়েনি। এই খুপড়ি ঘরে তো সারাজীবন কাটানো সম্ভব নয়।
আমরা নো ম্যান্স ল্যান্ডে গিয়েছিলাম- সেখানে একটা খালের পাড়ে সাড়ে ১২শ পরিবার রয়েছে। তারা বাংলাদেশে আসছে না এ অপেক্ষায় কোনো রকম আশ্বাস পেলেই যারা নিজ দেশে চলে যাবে। তাদের সামনে তো এ বিষয়টা পরিষ্কার আমাদের বাড়ি ঘর আছে, জমি জমা আছে এসব ছেড়ে আমরা বাংলাদেশের পাহাড়ে ঘুপের আড়ালে আছি।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে কোনো নেতা তৈরি হচ্ছে না কেন এমন প্রশ্নে মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন বলেন, মিয়ানমারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই ভঙ্গুর। সেখানকার ১ লাখ টাকা বাংলাদেশে সাড়ে তিন কি চার হাজার টাকা হয়। একটা চলনসই মুরগির দাম দশ হাজার টাকা।
সেই অর্থনীতির বাজারে রোহিঙ্গাদের টিকে থাকার গল্প আরও ভিন্ন। তাদের সরকারি ভাবে শিক্ষা বন্ধ করা হয়েছে অনেক আগেই। ২০১২ সাল থেকে কোনো মাদরাসা সেখানে চলতে পারে না। তারা নিজ শহরের বাইরে গিয়েও উচ্চ শিক্ষা অর্জন করতে পারে না। নিজ দেশেই তারা একঘরে করে রাখার মতো অবস্থায়।
তারা যেন প্রতিরোধ করতে না পারে এ জন্য বাড়িতে একটা ছোট্ট ছুরিও রাখতে দেয় না। এখান থেকে কিভাবে নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। এছাড়াও তাদের পেছনে সার্বক্ষণিক নাসাকা বাহিনী লেগে আছে। তাদের অর্থ ফসলে অর্ধেক ভাগ তাদের দিয়ে দিতে হয়। এভাবে একটা জাতি টিকে থাকা এবং সেখানে ভালো নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার আশা করা বোকামি। এ অবস্থার মধ্যে তারা ঘুরে দাঁড়াবে এটা কল্পনা করা বাতুলতা।
সেখানে আরসা বলতে যেটা বলা হচ্ছে, আমরা উলামায়ে কেরামের কাছে আলাপে জানতে পারলাম, তারা বললেন- এটাও মিয়ানমারের আর্মির সৃষ্টি। না হলে কেন তারা উমুক জায়গায় তমুক জায়গায় একটা ঢিল মেরে লাখো মানুষের সমস্যা করবে? শক্তি সামর্থ না নিয়ে কেন লাখো মানুষকে বিপদে ফেলতে মাঠে নামবে।
আরাকানি আলেমরা বলেন, আমাদের হাতে যেখানে কেউ গুলি ছুড়লে সেটা রক্ষার জন্য একটা কাঠও হাতে নেই এই অবস্থায় আমরা কি আমাদের শিশু নারীদের রেখে লড়াই করবো?
আরও পড়ুন
রোহিঙ্গা শিবিরের হিরো : গাজী ইয়াকুব
সীমান্তে আলেমদের পেয়ে কষ্টের মাঝেও উচ্ছ্বসিত রোহিঙ্গারা!
‘ঘর নেই, খাবার নেই, বাথরুম নেই, গায়ে কাদা, চেহারায় আতঙ্ক, এ দৃশ্য সহ্য করার মতো নয়’
রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখে কেয়ামতের বিভীষিকার কথা মনে পড়ে: মাওলানা মামুনুল হক
রোহিঙ্গাদের সহায়তায় টেকনাফ সীমান্তে শত শত আলেম