শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


‘ঘর নেই, খাবার নেই, বাথরুম নেই, গায়ে কাদা, চেহারায় আতঙ্ক, এ দৃশ্য সহ্য করার মতো নয়’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মিয়ানমার সরকারের জাতিগত নিধনের শিকার রোহিঙ্গা মুসলিমরা। জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। ধারণা করা হচ্ছে ইতোমধ্যেই ৫ লাখ মুসলিম আশ্রয় নিয়েছে টেকনাফে। যাদের অবস্থা খুবই নাজুক। খাবার নেই, নেই বিশুদ্ধ পানি। থাকার ঘর নেই। নামাজের জন্য নেই মসজিদ। অবস্থা পরিদর্শনে এবং সাহায্য নিয়ে সেখানে ছুটে যাচ্ছেন আলেম ওলামাগণ।

গতকাল অসহায় এ রোহিঙ্গাদের জীবন যাপন পরিদর্শনে গিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম। আওয়ার  ইসলামের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের সার্বিক পরিস্থিতি জানতে আজ তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কান্নাজরিত কণ্ঠে রোহিঙ্গাদের করুণ অবস্থার বর্ণনা দেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আওয়ার ইসলামের বার্তা সম্পাদক আতাউর রহমান খসরু

আওয়ার ইসলাম : বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সার্বিক পরিস্থিতি কেমন দেখছেন?

মুফতি ফয়জুল করীম : অমানবিক। দেখার মতো না। দৃশ্যপট সহ্য করার মতো না। খোলা আকাশের নিচে, থাকার ব্যবস্থা নেই, খাওয়ার ব্যবস্থা নেই, বাথরুমের ব্যবস্থা নেই, গায়ে ময়লা, কাপড়ে কাদা, চেহারায় ভয় ও আতঙ্ক, ক্ষুধা ও ক্লান্তির ছাপ, অনেক মানুষ বমি করছে, অসুস্থতার কারণে বেহুশ হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। না দেখলে বুঝবেন না। ভাষায় বলার মতো না … এ দৃশ্য কোনো মুমিন সহ্য করতে পারে না (এ পর্যায়ে তিনি আবেগি হয়ে পড়েন, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে)

আওয়ার ইসলাম : আপনাদের দল (ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ) ওখানে কী ধরনের সহযোগিতা করছে?

মুফতি ফয়জুল করীম : আল হামদুলিল্লাহ! ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ একদম শুরু থেকে অসহায় রোহিঙ্গা মুসলিমদের সহযোগিতা করে আসছে। আমরা মানবিক দৃষ্টি থেকে অসহায় মানুষের সাহায্য করা আবশ্যক মনে করি। তারপরও তারা মুসলিম। হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, মুসলিম মুসলিমের ভাই। সারা দুনিয়ার মুসলমান এক দেহেরে মতো। তাদের একজনের কষ্ট হলে অন্যজন স্থির থাকতে পারে না। সে হিসেবেই আমরা সাহায্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করছি। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সব সময় মানবতার পক্ষে কাজ করে। রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করাকে আমরা ঈমানি দায়িত্ব মনে করছি।

আওয়ার ইসলাম : রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় সরকারি ও বেসরকারিভাবে যে সহযোগিতা করা হচ্ছে তা কি যথেষ্ট?

মুফতি ফয়জুল করীম : না না বরং এটাকে কিঞ্চিৎ বলা যায়। তাদের যে পরিমাণ সহযোগিতার প্রয়োজন আমরা তার কিঞ্চিৎ পরিমাণ করতে পারছি। আরও অনেক বেশি সাহায্য সহযোগিতা করা প্রয়োজন। আমি মনে করি, সেনা বাহিনীর মাধ্যমে সরকারি উদ্যোগে বৃহৎ পরিসারে তাদের সাহায্য করা প্রয়োজন।

আওয়ার ইসলাম : রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ তৎপরতা নিয়ে আপনাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?

মুফতি ফয়জুল করীম : আমরা সাধ্যানুযায়ী কার্যক্রম সম্প্রসারণের চেষ্টা করছি। যেনো আরও বেশি সংখ্যক মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতার অধীনে নিয়ে আসা যায়।

এছাড়াও কয়েকটি ইবাদতখানা (মসজিদ) ও মক্তব প্রতিষ্ঠার ইচ্ছে আছে। প্রশাসনিক সমস্যা না থাকলে খুব তাড়াতাড়ি তা শুরু করবো। ইনশাআল্লাহ!

আওয়ার ইসলাম : অনেকেই রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মুহাজির-আনসার শব্দদ্বয় ব্যবহার করছে। একজন আলেম হিসেবে কি আপনি শব্দদ্বয়ের ব্যবহার যুক্তিযুক্ত মনে করেন?

মুফতি ফয়জুল করীম : আমি অবশ্যই মুহাজির-আনসার শব্দদ্বয়ের ব্যবহারকে যুক্তিযুক্ত মনে করি। হাকিকি অর্থে না হলেও রূপক অর্থে শব্দদ্বয়ের ব্যবহার ঠিক আছে। তারা মুসলিম হওয়ার অপরাধে দেশ থেকে বিতারিত হয়েছে এবং ঈমান-ইসলাম-জীবন রক্ষার জন্য মাতৃভূমি ত্যাগ করেছে, তাই তারা মুহাজির। আর এখানে যারা তাদের সাহায্য করছে তারা আনসার।

আওয়ার ইসলাম : আনসার ও মুহাজির শব্দদ্বয় ব্যবহারের বিশেষ কোনো তাৎপর্য আছে কী?

মুফতি ফয়জুল করীম : আনসার ও মুহাজির শব্দ দুটিই বিশেষ তাৎপযপূর্ণ। আমরা যখন শব্দ দুটি ব্যবহার করবো, তখন ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করবো। আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা. ও সাহাবিদের জীবনাদর্শ ও চরিত্র আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা হবে। আমরা তাদের থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করবো। আর আমাদের সব অনুপ্রেরণার উৎসই কুরআন-হাদিস ও রাসুল সা. এর জীবন।

আওয়ার ইসলাম : বর্তমান পরিস্থিতে মুসলিম উম্মাহর করণীয় কী?

মুফতি ফয়জুল করীম : মুসলিম উম্মাহর করণীয় হলো, যথাসম্ভব ঐক্যবদ্ধ হয়ে রোহিঙ্গাদের স্বভূমিতে ফিরে যাওয়া, তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়া ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান, আন্তর্জাতিক আদালতে সুচির বিচারের ব্যবস্থা করা; সর্বোপরি এই গণহত্যার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলা এখন মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব।

আন্তর্জাতিকভাবে সমস্যার সমাধান হওয়ার পূর্ব পযন্ত বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়া; বিশেষত বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা মুসলিমদের সর্বাত্মক সাহায্য-সহযোগিতা করা আবশ্যক।

আওয়ার ইসলাম : আন্তর্জাতিক আদালতে সুচির বিচার কেনো হওয়া প্রয়োজন এবং সে উদ্যোগ কারা নিবে?

মুফতি ফয়জুল করীম : যেহেতু রাষ্ট্রের নেতৃত্ব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার হাতে ন্যস্ত এবং সে তার নানা বক্তব্যে রোহিঙ্গা নিধনকে উৎসাহিত করছে, তাই তার বিচার হওয়া প্রয়োজন। শুধু সুচি নয়; যারা যারা এই হত্যাযজ্ঞের সাথে জড়িত আমি সবার বিচার দাবি করি।

এখন প্রশ্ন হলো বিচারের উদ্যোগ নিবে কে? আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের উদ্যোগ নিবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো। তাদের সহযোগিতা করবে মুসলিম বিশ্ব। আর বাংলাদেশ যেহেতু রোহিঙ্গারা  সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত, তাই বাংলাদেশ সরকারও সুচির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা দায়ের করতে পারে।

আমরা আগেও বলেছিলাম, এখনো বলছি সরকারের উচিৎ মিয়ানমারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং সুচির বিচারের জন্য তৎপর হওয়া।

আওয়ার ইসলাম : আপনার একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হচ্ছে, ‘রোহিঙ্গারা বাঙালি হলে, আরকান বাংলাদেশের অংশ’ এ কথার যুক্তি কী?

মুফতি ফয়জুল করীম : হ্যাঁ, কথাটি আমি বলেছি। আমার যুক্তি হলো, ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত  হাজার বছর ধরে রোহিঙ্গা আরাকান ভূমিতে বাস করছে। আরাকানে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রও ছিলো। এখন মিয়ানমার সরকার বলছে তারা বাঙালি। তারা বাঙালি হলে আরাকান বাংলাদেশের অংশ হওয়াই তো যৌক্তিক।

মিয়ানমার যদি আরাকানকে নিজের ভূমি দাবি করে, তাহলে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিয়ে তা করতে হবে। কেননা হাজার বছর ধরে এ ভূমির মালিকানা রোহিঙ্গাদের হাতে রয়েছে।

আওয়ার ইসলাম : এ মুহূর্তে আপনাদের নেতা-কর্মী সাধারণ দেশবাসীর প্রতি আপনার পরামর্শ কী থাকবে?

মুফতি ফয়জুল করীম : আমার আহবান থাকবে সবাই যেনো তার অবস্থান থেকে সাহায্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। শুধু ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের নয় আমি সমস্ত দেশবাসীর প্রতি আহবান জানাবো তারা যে যেভাবে পারে অসহায় ও আশ্রয়হীন মাজলুম মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসে।

বাংলাদেশের বাইরেও যেসব মুসলিম রয়েছে তাদেরও আহবান জানাবো, তারা যেনো মাজলুম অসহায় ও দুর্বল রোহিঙ্গাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে।


সম্পর্কিত খবর