বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১২ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

শিরোনাম :
‘মানতিক; যুগের চাহিদার সাথে মিলে না’ এ ধরেণের কথা অযৌক্তিক: মুফতি হিফজুর রহমান দাওরায়ে হাদিসের ফলাফল নজরে সানীর আবেদনের সময় বাকি ৩ দিন  বৃষ্টি প্রার্থনায় জামিয়াতুল আবরার রাহমানিয়ায় ‘সালাতুল ইস্তিসকা’  আদায় হাসপাতালে সৌদি বাদশাহ সালমান সোস্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত পাঠ্য তালিকার সাথে বেফাকের পাঠ্য তালিকার সম্পর্ক নেই: বেফাক সৈয়দপুরে তাপদাহে অতিষ্ঠ মানুষ, ‘হিটস্ট্রোকে’ ১ জনের মৃত্যু স্বর্ণের দাম আরও কমলো, ভরি ১ লাখ ১৪ হাজার ১৫১ টাকা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান ইরান-পাকিস্তানের ঢাবিতে বৃষ্টির জন্য ‘সালাতুল ইসতিস্কা’র অনুমতি দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ‘বৃষ্টির জন্যে সালাত আদায় করলেই অবশ্যম্ভাবী বৃষ্টি চলে আসবে—বিষয়টা তা নয়’

রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখে কেয়ামতের বিভীষিকার কথা মনে পড়ে: মাওলানা মামুনুল হক

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মিয়ানমার সরকারের অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। তাদের সহযোগিতা দেশের নানা প্রান্ত থেকে আলেমগণ ছুটে যাচ্ছেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর ছেলে, জামিয়া রাহমানিয়া’র মুহাদ্দিস মাওলানা মামুনুল হকও ছুটে গিয়েছিলেন অসহায় মানুষের পাশে। তারুণ্যের অনুপ্রেরণা এ আলেম তার অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন আওয়ার ইসলামের সঙ্গে। কথোপকথনে তার সঙ্গে ছিলেন আতাউর রহমান খসরু

আওয়ার ইসলাম : বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সরেজমিনে দেখে এসেছেন আপনি। সার্বিক পরিস্থিতি এখন কেমন?

মাওলানা মামুনুল হক : সার্বিক পরিস্থিতি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। সেখানে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের দেখলে কেয়ামতের বিভীষিকার বিবরণ যেনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাদের অনুভব ও অনুভূতি শক্তি লোপ পেয়েছে। দুঃখ-যাতনা অনুভব করার শক্তিও তাদের নেই। এমনকি শিশুরাও শোকে পাথর হয়ে গেছে। তারাও কান্না করছে না।

আওয়ার ইসলাম : এবার মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের মধ্যে নারী ও শিশুই বেশি। পুরুষের সংখ্যা খুব কম। তারা আসছে না কেনো?

মাওলানা মামুনুল হক : এর একটি কারণ, অনেক পুরুষই শহিদ হয়েছেন। এবার পুরুষদের টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে বলে অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী বলছেন। আরেকটা কারণ হলো, আরাকানের কোনো কোনো জায়গা থেকে বাংলাদেশের সীমান্তে আসতে প্রায় দশ-পনের দিন সময় লাগে। নিরাপত্তা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এতো দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে আসা পুরুষের পক্ষে কঠিন। এ কারণেও হয়তো তারা আসতে পারছে না। আত্মগোপন করে আছেন।

আওয়ার ইসলাম : রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সাড়া পড়েছে। মানুষের আবেগ ও সরকারের ভূমিকার মধ্যে মিল-অমিল কতোটুকু?

[caption id="attachment_50635" align="aligncenter" width="500"] রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় ছুটে চলা ...[/caption]

মাওলানা মামুনুল হক : না, মোটেই মিল নেই। রোহিঙ্গাদের বাস্তব অবস্থা ও জনগণের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে সরকারের ভূমিকা নেহায়েত বেমানান। স্থানীয়ভাবে যে কাজগুলো হচ্ছে তাতে সরকার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের চেয়ে মসজিদ, মাদরাসা ও আলেমদের ভূমিকা জোরালো। বড় রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতৃবৃন্দের ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য নয়।

সরকার শুধু উদ্বাস্তু শিবিরের জায়গা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাদের নিবন্ধন করছে। এর বাইরে তাদের কোনো উদ্যোগ নেই।

আওয়ার ইসলাম : সরকারের আর কী কী করার ছিলো বলে আপনি মনে করেন?

মাওলানা মামুনুল হক : সরকার যদি জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিতো, তাদের উদারতার সঙ্গে গ্রহণ করতে বলতো, তাহলে আশ্রিতদের কষ্ট অনেকাংশে কমে যেতো। রোহিঙ্গা এতো দূর থেকে কষ্ট করে আসছে, আসার পথে ট্রলারচালকদের জুলুমের শিকার হচ্ছে, তাদের জিনিসপত্রের উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছে না, পথ-ঘাট চিনছে না; এসব সমস্যাগুলো আর হতো না।

সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বিজিবি ও পুলিশ এখনো রোহিঙ্গাদের উদারভাবে গ্রহণ করছে না। এজন্য অনেক রোহিঙ্গা যেখানে নদী পথে বাংলাদেশে আসতে পারতো, তারা সমুদ্রপথে আসছে। এতে প্রতিদিনই ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটছে। মানুষ মারা যাচ্ছে। আমাদের চোখের সামনেও হয়েছে।

সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য থাকার জায়গা নির্ধারণ করে দিয়েছে। সামান্য জায়গার মধ্যে লাখ লাখ রোহিঙ্গা থাকছে। তাদের স্যানিটেশন ও খাবার পানির ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এতে তারা সীমাহীন ‍দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছে।

সরকার সামরিক বাহিনী নিয়োগ দিলে পারতো। তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাসহ সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়নে কাজ করতো।

আওয়ার ইসলাম : আপনি বললেন, আলেমরা জোরালো ভূমিকা রাখছে। এর বিপরীতে আমাদের দেশের সুশীল সমাজ হিসেবে যারা পরিচিত –যারা ক্রশফায়ারে ডাকাত মারা গেলেও মানববন্ধন করে- তারা চুপসে আছে কেনো?

মাওলানা মামুনুল হক : তারা চুপ করে আছে কেনো এটা একটা বড় প্রশ্ন। রোহিঙ্গা স্পটে গেলে প্রশ্নটা আরও তীব্র হয়। আমার মনে হয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাবে তারা চুপ করে আছেন। তাদের অনেকেই অনেক দেশের কাছে ‘দায়বদ্ধ’।

রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মুসলিম পরিচয়টি বড় হয়ে ওঠায়-ও তারা চুপ করে থাকতে পারেন।

আওয়ার ইসলাম : রোহিঙ্গাদের জন্য যারা কাজ করছে, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

মাওলানা মামুনুল হক : আমার পরামর্শ থাকবে, দূর-দূরান্ত থেকে অনেক বেশি জিনিসপত্র নিয়ে না যাওয়া এবং তাড়াহুড়া না করা। তাবুর খুব প্রয়োজন হয়। দূর থেকে ভালো মানের তাবু নেয়া গেলে তা নিয়ে যাওয়া। খুব বেশি কাপড় না নেয়া। কারণ, তারা কোথাও স্থির হওয়ার পূর্বে কাপড় বহন করতে চায় না। এটা তাদের জন্য কষ্টকরও। তারা আমাদের মতো কাপড় পরেও অভ্যস্ত না। মহিলাদের জন্য বোরকা, পুরুষদের জন্য লুঙ্গি গেঞ্জি নেয়া যেতে পারে।

সেখানে দু’ধরনের উদ্বাস্তু আছে। এক. যারা উদ্বাস্তু শিবির পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে নি। তাদের জন্য চলতি পথে বহনোপযোগী খাবার ও শিবির পর্যন্ত পৌঁছার ভাড়া বাবদ নগদ টাকা বা যানবাহনের ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবার খুব বেশি প্রয়োজন।

দুই. যারা শিবিরে পৌঁছে গেছেন। তাদের জন্য ঘর নির্মাণ করা, তাদের স্যানিটেশন ও খাবার পানির ব্যবস্থা করা, সংরক্ষণ করা যায় এমন খাবার উপকরণ যেমন চাল-ডাল-চিরা-মুড়ি ইত্যাদির ব্যবস্থা করা।

আওয়ার ইসলাম : এবার আসি আরাকানের স্বাধীনতার প্রশ্নে। স্বাধীনতাই রোহিঙ্গাদের একমাত্র সমাধান?

মাওলানা মামুনুল হক : এটা সত্য, রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান আরাকানের স্বাধীনতা ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়। কিন্তু বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় স্বাধীনতা খুব সহজ বিষয় নয়। রোহিঙ্গাদের মতো একটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করা অসম্ভব প্রায়। মিয়ানমার সামরিকভাবে শক্তিশালী একটি রাষ্ট্র এবং তার পেছনে আছে চীন-রাশিয়ার মতো শক্তিশালী দেশ।

আওয়ার ইসলাম : তাহলে সমাধান আসবে কিভাবে?

মাওলানা মামুনুল হক : সমাধান কূটনৈতিকভাবে চেষ্টা করতে হবে। সারা বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা করলে এ সমস্যার সমাধান হতেও পারে। যদি সব কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, তবে বাংলাদেশের একজন সাবেক বিডিআর প্রধানের পরামর্শ হলো বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অনুরূপ ভূমিকা নিবে। অর্থাৎ রোহিঙ্গা যুবকদের উপযুক্ত ট্রেনিং দিয়ে ছেড়ে দিবে। তারা তাদের ভাগ্য গড়ে নেবে। রোহিঙ্গাদের যেহেতু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাই তারা স্বভূমি ফিরে পেতে আপ্রাণ চেষ্টা করবে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ এটা করবে কারণ, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা দ্বারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত।

আওয়ার ইসলাম : বিশ্ব রাজনীতি ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান থেকে বাংলাদেশের সে ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ আছে?

মাওলানা মামুনুল হক : বাংলাদেশের সে সুযোগ নেই তা আমি বলবো না। রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার যে অত্যাচার ও জাতিগত নিধন চালাচ্ছে তা এতোটা প্রকাশ্য, নগ্ন ও খোলামেলা যে অস্বীকার করার সুযোগ মিয়ানমার ও তার মিত্রদের নেই। বৈশ্বিক ফোরামগুলোতে বাংলাদেশ এই হত্যাযজ্ঞ ও তার দ্বারা বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার প্রমাণ পেশ করবে। যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করবে।

দুটি পথই আছে, এখন হয় মিয়ানমার কফি আনান কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী নাগরিকত্ব ও ভোটারাধিকার দিবে। নতুবা বাংলাদেশের সামনে একাত্তরের ভারত হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবে না।

আওয়ার ইসলাম : মুসলিম দেশগুলো ত্রাণ ও আশ্রয় দিয়েই দায়িত্ব শেষ করতে চাচ্ছে। এটা জাতি হিসেবে কতোটা হতাশাজনক?

মাওলানা মামুনুল হক : খুবই হতাশাজনক। ত্রাণ ও আশ্রয় কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। এটা ওষুধ ছাড়া ক্ষত ব্যান্ডেজ করে দেয়ার মতো। এতে ক্ষত শুধু বাড়বেই। নিরাময় হবে না।

আমার মনে হয়, মুসলিম দেশগুলো ত্রাণ ও সহায়তার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সোচ্চার হওয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে দুয়েকটি দেশ ছাড়া অধিকাংশ দেশের ভূমিকা একেবারেই লজ্জাজনক।

আওয়ার ইসলাম : রোহিঙ্গা সমস্যাটি দীর্ঘ অর্ধ শতকের। অথচ এ ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের তৎপরতা ইস্যু কেন্দ্রিক মনে হয়। স্থায়ী সমাধানের জন্য আমরা দীর্ঘ মেয়াদে কি করতে পারি?

মাওলানা মামুনুল হক : রোহিঙ্গাদের স্বাধীকার প্রশ্নে মুসলিম দেশসমূহের সরকার তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সহযোগিতায় আলেমগণ তাদের শিক্ষিত করে তুলবে। যেনো এতো বিপুল সংখ্যক মুসলিম ও তাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম বিপন্ন না হয়।

‘ঘর নেই, খাবার নেই, বাথরুম নেই, গায়ে কাদা, চেহারায় আতঙ্ক, এ দৃশ্য সহ্য করার মতো নয়’

সীমান্তে আলেমদের পাশে পেয়ে কষ্টের মাঝেও উচ্ছ্বসিত রোহিঙ্গারা!


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ