শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
খুলনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা নেতানিয়াহুকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ইসরায়েলি নাগরিক গ্রেপ্তার ‘উলামায়ে কেরামদের বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন অসম্ভব’ নিউইয়র্কে যাদের সঙ্গে বৈঠক হতে পারে প্রধান উপদেষ্টার গাজাজুড়ে ইসরায়েলের নৃশংস হামলা, নারী-শিশুসহ নিহত ২৮ ফিলিস্তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল প্রকার রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত 'ঢাবি ও জাবির হত্যাকাণ্ডে জড়িত খুনীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে' ঢাবিতে যুবক হত্যায় ছাত্রলীগ নেতাসহ ৩ জন আটক কওমী মাদরাসার ছাত্রদেরকে বিসিএস এ অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়া বৈষম্য: মুফতী ফয়জুল করীম শায়খে চরমোনাই  সাগর-রুনি হত্যার বিচারের দাবিতে ঢাকায় সাংবাদিকদের বিক্ষোভ সমাবেশ

আমরা বীরজাতি! ছিলাম, আছি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

নাসিম মুমতাজী
তরুণ আলেম ও প্রাবন্ধিক

হিন্দুস্তানের বাজারে এক সময় বিভিন্ন জায়গার হরেক রকম মালামাল পাওয়া যেতো ৷ রোম, পারস্য, চীন ও আরবসহ আরো অনেক দেশের বণিকদল এখানে বাণিজ্যকাফেলা নিয়ে আসতো ৷ নিজ নিজ দেশের পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে হিন্দুস্তানি পণ্য তথা ডাব, নারিকেল, মসলাপাতি, মৃগনাভী (সুগন্ধি জাতীয়) প্রভৃতি মালামাল ক্রয় করে নিজদেশের নিয়ে যেতো ৷

পারস্য তখন বিশ্বের একক পরাশক্তি৷ এজন্য পারসিকদের পণ্যের মূল্যায়ন করা হতো খুব ৷ দাম দেয়া হতো বেশি ৷ বণিকদেরও করা হতো সম্মান ৷ রোমানদের পূর্বেতিহাস স্মরণ করে তাদের পণ্যেরও বিশেষ কদর করা হতো ৷ বণিকদের দেখা হতো মর্যাদার চোখে ৷ চৈনিক দ্রব্যের মূল্যও ছিলো তদৃশ ৷ আর আরব্য পণ্যের চাহিদা ছিলো খুবই কম ৷ ওদের প্রতি কারো তেমন কদর ছিলো না ৷ আরবজাতিকে তখন বিশ্ববাসী তুচ্ছ করতো ৷ তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখতো ৷ তাদের ঘৃণা করা হতো ৷ গোত্রীয় বিভেদ ও হিংস্রস্বভাবের দরুন তাদের অসভ্য ও বর্বর হিসেবে গণ্য করা হতো ৷

আরবের মরুতে তখনও শিক্ষা-দীক্ষার অনুপ্রবেশ ঘটেনি ৷ গ্রাম্য মূর্খ আরববাসী তখনও সভ্যতার ছোঁয়া পায়নি ৷ তাদের মাঝে তখনও ‘মহামানব’ পদার্পণ করেননি ৷ আত্মঘাতি ভ্রাতৃযুদ্ধে তারা লিপ্ত ছিলো ৷ খুনাখুনি ও রক্তপানে মগ্ন ছিলো ৷ সে অন্ধকার যুগ থেকেই তারা ব্যবসা বাণিজ্যের লক্ষ্যে হিন্দুস্তানে যাতায়াত করতো ৷ তাদের কারো কারো এ দেশ ভালো লাগায় এ দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলো ৷

সময়ের পরিবর্তনে এক সময়ের মূর্তিপূজারী আরববাসী এখন স্বর্গীয় ধর্মের অনুসারী ৷ ঐশীগ্রন্থের অনুগামী ৷ গোত্রীয় বিবাদে লিপ্ত জাতি এখন বিশ্বজয়ী ৷ পৃথিবী তাদের এখন ভিন্ন নজরে দেখে ৷ শ্রেষ্ঠত্বের আসনে রাখে ৷ তারা এখন সম্মানিত ৷ সর্বমহলে সমাদৃত ৷ বিশ্বের দৃষ্টিতে মর্যাদাবান ৷ তদানিন্তন বিশ্বের পরাশক্তি রোম-পারস্য করতলগত করায় ও অত্যাচারীর খড়্গ-কৃপাণ ভেঙে দেয়ায় তাদের সম্মানের চোখে দেখা হয় ৷ দেয়া হয় অন্যের তুলনায় বেশি মর্যাদা ৷ তখন স্বভাবত হিন্দুস্তানে বসবাসরত পিতৃভূমির ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে ৷ সাথে সাথে নতুন ধর্ম সম্পর্কে জাগে ব্যাপক কৌতূহল ৷

ইতোমধ্যে সেখানে এক আরবদল বাণিজ্যকাফেলা নিয়ে এলো ৷ তারা সে নতুন ধর্মের অনুসারী ৷ তারা শুধু জাগতিক বাণিজ্যের উদ্যেশেই আসেনি, এসেছিলো পরকালীন বাণিজ্যের নিয়তেও ৷ তাদের অমায়িক ব্যবহার ও সুন্দর আচরণে মুগ্ধ হয়ে হিন্দুস্তানে বসবাসরত আরবসহ স্থানীয় আরো অনেক অধিবাসী ইসলামধর্ম গ্রহণ করেন৷

মাস ও বৎসরের আকারে সময় বয়ে চলতে লাগলো ৷ ততোদিনে হিন্দুস্তানে অনেক মুসলমান ৷ একবার হিন্দুস্তানের মুসলমানগণ স্ত্রী ও বাচ্চাদের রেখে হজব্রত পালনে গেলেন ৷ সমুদ্রের বুক চিড়ে তরতর করে এগিয়ে চললো তাঁদের জাহাজ ৷ কিন্তু বিধি রাম! মাঝপথে সমুদ্রঝড়ের কবলে পড়ে জাহাজ ডুবে যায় ৷ সকলেরই সলীলসমাধী হয় ৷

উমাইয়া খেলাফত আমলের তৎকালিন ইরাকের ভাইসরয় ‘হাজ্জাজ বিন ইউসুফ’ জাহাজ পাঠিয়ে দিলেন আরব্য নারী-শিশুদের আরবে নিয়ে যাওয়ার জন্যে ৷ তাদের নিয়ে জাহাজ রওনা দিলো ৷ সাথে স্থানীয় রাজার এক সরকারি জাহাজ ৷ সেটি উপঢৌকনবোঝাই ছিলো ৷ যা ‘লঙ্কারাজ’ পাঠাচ্ছিলেন ইরাকশাসকের নিকট ৷

আপনগতিতে জাহাজ দু’টি চলতে লাগলো ৷ কিন্তু ‘দেবল বন্দর’ (বর্তমান করাচি বন্দর) অতিক্রমকালে সিন্দুরাজের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসকের তত্বাবধানে তা লুণ্ঠিত হয় ৷ উপঢৌকন সব কুক্ষিগত করে নারী-শিশুদের বন্দী করা হয় ৷ আবদ্ধ রাখা বয় ভূগর্ভস্থিত গোপন কুঠুরিতে ৷

হাজ্জাজের নির্দেশে মাকরানশাসক ক্ষতিপূরণ ও বন্দীদের মুক্তিদাবী করেন ৷ কিন্তু শোষক রাজার দরবার হতে তা ঘৃণিতভাবে অগ্রাহ্য হয় ৷ পরিণামে রাজা ‘দাহিরে’র বন্দিশালা হতে হিন্দুস্থানী আরব্য মুসলিমদের মুক্ত করার অভিলাষে ছুটে এলেন তরুণ বীর, কিশোর সেনাপতি ‘মুহাম্মদ ইব্ন কাসিম আস-সাকাফী’ ৷ সিন্ধুরাজ্য পেরিয়ে মুলতান পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন তিনি ৷ উড্ডীন করলেন তাওহীদি ঝাণ্ডা ৷

এক এক করে অনেক দিন কেটে গেলো ৷ বছরকে বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলো ৷ সিন্ধুনদ বেয়ে হাজার-কোটি গ্যালন পানি গড়িয়ে গেলো ৷ হিন্দরা রামরাজ্য প্রতিষ্ঠায় ওঠে পড়ে লাগলো ৷ রাজা ‘জয়পাল’ ‘খায়বার গিরিপথ’ পাড়ি দিয়ে ‘কা’বা’ পর্যন্ত মূর্তিস্থাপনের প্রতিজ্ঞা করলো ৷ শুধু কি তাই! হিন্দুস্তানস্থ মুসলমানদের হিন্দুধর্ম গ্রহণে বাধ্য করতে লাগলো ৷ যারা ধর্মত্যাগ করে রামের দীক্ষা নিতো না, হত্যা করা হতো তাদের ৷ সে অত্যাচারিত রক্ষা করতে ও হিন্দুস্তানকে মূর্তির নাগপাশমুক্ত করতে এগিয়ে এলেন ‘সুলতান মাহমুদ গজনভী’ ৷

সুলতান গজনভীর মৃত্যুর পর উত্তরসূরিদের অযোগ্যতা ও অথর্বতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে ঘুরে দাঁড়ালো পৌত্তলিক সম্প্রদায় ৷ পূর্বসূরিদের প্রেতাত্মা চাপলো পৃত্থিরাজের ঘাড়ে ৷ পুরুত-ঠাকুরের কুপরামর্শে আধ্যাত্মিক সম্রাট মুঈনুদ্দীন চিশতি রহ. ও তাঁর অনুসারিদের সে উৎপীড়ন করতে লাগলো ৷ আর তখনই সেনাভিযানের মাধ্যমে তাদের রামরাজ্য গড়ার পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দিলেন ‘সুলতান শিহাবুদ্দীন মুহাম্মদ ঘুরী’ ৷

লোদি বংশের শাসনামলে রাজনৈতিক বিশৃংখলার সুযোগ গ্রহণ করতে চাইলো হিন্দু রাজপুতরা ৷ ঠিক তখনই পানিপথের যুদ্ধে লোদিদের পরাজিত করে শাসনক্ষমতা গ্রহণ করলেন মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ‘জহির উদ্দীন মুহাম্মদ বাবর’ ৷

মুঘলরা হিন্দুস্তানে মুসলমানদের নির্ভরতা ছিলো ৷ দীর্ঘদিনব্যাপী তাদের সাম্রাজ্য বহাল ছিলো ৷ মুঘলদের শেষ সময়ে অযোগ্য অথর্ব সম্রাটদের দুর্বলতা ও অদূরদর্শিতায় মারাঠি বর্গীদের লুণ্ঠন ব্যাপক আকার ধারণ করলে সাহায্যার্থে ছুটে আসেন ‘আহমদ শাহ আবদালী’ ৷ তবে তিনি হিন্দুস্তানে শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেননি ৷

অবশেষে ১৭৫৭ খৃস্টাব্দে কিছু জাতীয় গাদ্দারের চক্রান্তে হিন্দুস্তানের এই পবিত্র ভূমিতে ইংরেজ বেনিয়াদের দখলে চলে যায় ৷

রাজার জাত মুসলমানদের হতে সকল ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয় ৷ নেতৃবর্গ ও শ্রদ্ধাভাজন আলেমদের অনেককেই নির্বাসিত ও শহীদ করে দেয়া হয় ৷ বাকী মুসলমানদের দিন কাটতে থাকে অত্যন্ত পেরেশানি, অতিশয় দুশ্চিন্তা, চরম অস্থিরতা ও সীমাহীন উৎকণ্ঠার সাথে ৷ তারা তখন অভিভাবক ও আশ্রয়হীন ৷

একদিক হতে নিষ্পেষক বৃটিশ বেনিয়া ও ভারতমাতার সন্তান ও অপরদিক হতে আস্তিনের সাপ ভণ্ডপীর, ফেরাকে বাতেলা প্রভৃতির চতুর্মুখী আক্রমণ ৷ তখন আরব থেকে কোনো বিন কাসিম, আফগান থেকে কোনো মাহমুদ গজনভী, হেরাত থেকে কোনো মুহাম্মদ ঘুরী, নিশাপুর থেকে কোনো বাবর, পারস্য থেকে কোনো আবদালী এগিয়ে আসেনি তাদের সাহায্যে ৷ এহেন মুহূর্তে হিন্দুস্তানে ইসলামের পতাকা সমুন্নত রাখতে ও সাধারণ মুসলমানদের বাঁচানোর লক্ষ্যে তাঁদের উত্তরসূরিরা আযাদির ঝাণ্ডা উত্তোলন করলো ৷ বিশাল বিস্তৃত রক্তসাগর ও বিস্তির্ণ কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে একপর্যায়ে তারা ইংরেজ শ্বেতচামড়াঅলাদের স্বদেশে তাড়িয়ে বিজয়নিশান ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হলো ৷

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, হিন্দুস্তানের মুসলমানরা ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই স্বাধীন ৷ কোনোকালেই তারা পরাধীন ছিলো না ৷ কোনোযুগেই তাদের মাথা নত হয়নি ৷ তারা রক্ত দিয়েছে, ইজ্জত দেয়নি ৷ শির দিয়েছে, আমামা দেয়নি ৷ জান দিয়েছে, মান দেয়নি ৷ জীবন দিয়েছে, স্বাধীনতা দেয়নি ৷ তাদের উদ্ধত শির কেয়ামত অব্দি কেউ নত করতে পারেনি, ইনশাআল্লাহ! পারবেও না ৷

এযুগের দাবির, জয়পাল, পৃত্থিরাজ ও শিবাজী প্রমুখেরা যদি দুর্বল ভেবে আমাদের আযাদী হরণ করতে চায়, তাদের প্রতিহত করতে আমাদের মধ্য হতেই জন্ম নেবে বিন কাসিম, গজনভী, ঘুরী, বাবর ও আবদালী ৷

সময়ের পরিবর্তন ও ভাগ্যদোষে তখনকার রাজা এখন প্রজা এবং প্রজা হলো রাজা, কিন্তু ধর্মানুরাগ, স্বকীয়তা, দেশপ্রেম, নীতিবোধ ও আত্মমর্যাদায় ব্যবধান হয়নি সামান্যতম ৷

ঈদ না ইদ : একটি অপরাজিত লড়াকু বর্ণের ভালোবাসা


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ