বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


ঈদ না ইদ : একটি অপরাজিত লড়াকু বর্ণের ভালোবাসা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর 
কবি ও কলামিস্ট

প্রথমেই বলে নিই, ঐতিহ্যগতভাবে আমি ঈদ-এর পক্ষে। নৈতিক দিক থেকে ঈদ বা ইদ— কোনোটাতেই আমার আপত্তি নেই। তবে ভাষা নিয়ে উল্টো পথের যাত্রী হওয়াটাকে আমি কিছুটা নাপছন্দ করি।

মূল কথায় প্রবেশ করি। মোক্ষম প্রশ্ন যেটা হতে পারে— ঈদ-এর মধ্যে যে দীর্ঘ ই-কার রয়েছে, সেটা কি সত্যিকার অর্থেই আরবি বর্ণ ‘আইন’-এর প্রতিনিধিত্ব করে? আমার যতোদূর অবজার্ভেশন, বাংলাদেশের কেউ ঈদ উচ্চারণের সময় আরবি বর্ণ ‘আইন’ উচ্চারণ করে না। আজ পর্যন্ত আমি কাউকে বলতে শুনিনি। না করারই কথা। বাংলা ভাষায় কি আইন নামের কোনো বর্ণ আছে? নাকি বাংলা বর্ণের ধ্বনিতে আইনের কোনো ব্যবহার আছে? নেই। তাহলে কেন শুধু শুধু বাংলাভাষার একটি শব্দে আরবি ফ্লেভার কামনা করছেন?

আপনি যখন আরবি পড়বেন তখন ঈদকে আচ্ছারকম মাখরাজ আদায় করে পড়ুন— হলকের শেষভাগ হইতে উচ্চারিত হয়— আইন - হা...। যখন ‘আসসালামু আলায়কুম’ বলবেন তখন আইন উচ্চারণ করে বলুন। কেননা এটা পুরোটাই একটি আরবি বাক্য। আরবি বাক্যকে আরবির মতো করেই বলুন। ‘রহমাতুল্লাহি আলায়হি’তে আইন উচ্চারণ করুন। কে আপনাকে বাধা দেবে? কিন্তু আপনি যদি বলেন— ‘আলেম’ বলার সময় গলা খিঁচে ধরে নিচের দিকে টানতে হবে, সেটা তো বাংলাভাষার বিকৃতিসাধন ছাড়া আর কিছুই নয়। আরবি ‘আলেম’ শব্দ বাংলাভাষায় প্রচলিত হয়ে গেছে। অভিধানে তার স্থান দৃঢ় করে নিয়েছে। সুতরাং এক ভাষার মধ্যে আরেক ভাষার ব্যকরণ ব্যবহারের গুরুচণ্ডালি কায়দা কানুন আপনাকে হাসির পাত্র বানাবে কেবল।

ভাষার ব্যাপারে একটি মূলকথা জেনে রাখা প্রয়োজন:
অন্য ভাষার কোনো শব্দ যখন আপনার ভাষায় প্রচলিত হয়ে পড়ে, তখন সেটাকে আপনার ভাষার ব্যকরণ মেনেই ভাষার ভেতরবাড়িতে ঢুকতে হয়। তখন আর সেটা তার সত্ত্বাগত ভাষার ব্যকরণকে অনুসরণ করার অধিকার রাখে না। তাই যদি না হতো তবে আমাদের বলতে হতো— ঈদুন মুবারাকুন! কিন্তু আমরা বলি ঈদ মুবারক। এখানে আরবি কোনো ব্যকরণ মানা হয়নি, মানা হয়েছে বাংলা ব্যকরণ। যেমন আমরা বলি— শুভ বিবাহ, শুভ হালখাতা...!

একবার চিন্তা করেন, ঈদ যদি ঈ দিয়ে লেখার গোঁ ধরে থাকেন তাহলে ‘আবদুল্লাহ’ লেখার সময় কী করবেন? আ-এর তো কোনো আইন ভার্সন নেই। আবার ‘আল্লাহ’ও লেখা হয় আ দিয়েই। অথচ আরবিতে এটা হামজা দিয়ে লেখা হয়। আইন আর হামজা এক আ-এর মাঝে একাকার হয়ে যেতে পারলে ঈদ কেন ই-এর মাঝে বিলীন হতে পারবে না?

ধরলাম বাংলা ভাষায় ঈদকে ‘ইদ’ বলতে আপনি নারাজ, কারণ সেটি মূল আরবির সঠিক প্রতিনিধিত্ব করে না। তাহলে যারা ইংরেজি ভাষাভাষী তারা কী করবে? ইংরেজিতে ঈদকে Eid লেখা হয়। ইংরেজিতে না আইন আছে আর না হামজা, না আছে ঈ আর না আছে ই, সকলই E। তাদের ঈদ কি তবে বে-বরকতি হয়ে যাবে? যারা স্প্যানিশ, রাশান, ল্যাটিন, মান্দারিন ভাষায় কথা বলে, তাদের কী অবস্থা হবে? ঈদের জন্য কি তারা নতুন আরেকটি বর্ণ নির্মাণ করবে তাহলে?

সম্প্রতি কট্টরপন্থী একটা শ্রেণি তৈরি হচ্ছে অ্যারাবিকের বড় সমঝদার। এরা কারি সাহেবকে লিখে ‘ক্বরী’, রমজানকে লিখে ‘রামাদ্বান’, হেদায়েতকে লিখে ‘হিদায়াত’, ফরজকে লিখে ‘ফরদ’ বা ‘ফরদিয়্যাত’, ফজিলতকে বলে ‘ফাদিলাত’। আবার অনেক পণ্ডিত ইসলামিস্টকে দেখি আরবি শব্দ লেখার সময় আইন বা হামজা বুঝানোর জন্য শব্দের শুরুতে বা মাঝে উল্টা-সিধা উদ্ধরণ চিহ্ন (‘ ’) ব্যবহার করে থাকেন। কী অবাক কাণ্ড! যে শব্দগুলো বাংলাভাষায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, সেগুলোকে কেন আপনি আরবি মাখরাজ আর ব্যকরণ মেনে উচ্চারণ করবেন?

এই দুই শ্রেণির লোকদের অপরাধ দুই প্রকার
এক. তারা বাংলাভাষায় আরবি শব্দের বহুল ব্যবহারের টুঁটি চেপে ধরেছেন।
দুই. আরবি শব্দ উচ্চারণ অত্যধিক কঠিন, সাধারণ মানুষের জন্য আরবি উচ্চারণ সম্ভব নয়- এমন দুরাচার ধারণার প্রসার ঘটাচ্ছেন।
বাংলাভাষা নিয়ে এই ধরনের বিকৃতিসাধন পরিহার কাম্য।

পরিশিষ্ট
ঈদ দেখতে আমার কাছেও ভালো লাগে। এই একটা শব্দের জন্য হলেও ঈ বর্ণটা হর-হামেশা চোখে পড়ে। বাংলাভাষার একটা বর্ণকে বাঁচিয়ে রেখেছে এই একটি প্রবল প্রতাপশালী শব্দই। বাংলা একাডেমি কী বললো না বললো তাতে কিছু যায় আসে না, ভাষার ব্যকরণ ঠিক রেখে আপনি আরবি উর্দু, ফার্সি, ইংরেজি শব্দ বাংলাভাষায় ব্যবহার করুন, এতে বাংলাভাষা সমৃদ্ধ হবে। পৃথিবীর একক ভাষা বলতে কিছু নেই। সব ভাষাতেই নানা ভাষার নানা শব্দ ব্যবহার হচ্ছে। এটা ভাষার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, সে অন্য ভাষার প্রচলিত শব্দকে সহজেই ভালোবেসে নিজের করে নেয়। ভাষার কোনো সাম্প্রদায়িক দায় নেই। সে সতত বহমান, সর্বদা পরিবর্তনশীল। প্রতিটি ভাষায় নতুন শব্দ আসে, পুরোনো শব্দ সবার অলক্ষে হারিয়ে যায়। এটাই ভাষার নিয়ম।

দীর্ঘ ই-কার ‘ঈদ’কে ভালোবেসে দীর্ঘজীবী হোক। এই শব্দটি বাংলাভাষার একটি বর্ণকে এক অর্থে একাই বাঁচিয়ে রেখেছে, তাকে বিনম্র স্যালুট। নইলে অনেক আগেই ব্যবহারহীনতার ভয়ে লি-কারের মতো এ বর্ণটিও বিলুপ্ত হয়ে যেতো। অনেকেই মনে করছে আমি চায়ের লিকারের কথা বলছি। এটা চায়ের লিকার না রে ভাই, এটা বাংলাভাষার একটি অভাগা বর্ণ!

বাচ্চা পোলাপানকে জ্ঞান দেয়ার খাতিরে বলি— ওয়ান্স আপন আ টাইম... আমাদের সময়ে লি-কার নামে বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণে একটি বর্ণ ছিলো। একেবারে শেষের দিকে খণ্ড ত, চন্দ্রবিন্দু, বিসর্গের ভাই বেরাদর হিসেবে ছিলো। শেষ লাইনে গলাগলি ধরে থাকতো তারা। চেহারা দেখতে অনেকটা কাঠবিড়ালীর মতো ছিলো। শ’ খানেক বছর আগে হয়তো ব্যবহার হতো, কিন্তু আমাদের বাচ্চাকালেও বাংলাভাষায় এর কোনো ব্যবহার দেখিনি। ফলে ক্ষোভে, দুঃখে, অভিমানে সেটি কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। আর কখনো ফিরে আসেনি!

তুরস্ক ও এরদোগানের গোপন যুদ্ধ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ