শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ।। ৫ আশ্বিন ১৪৩১ ।। ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
উত্তপ্ত খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি খুলনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা নেতানিয়াহুকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ইসরায়েলি নাগরিক গ্রেপ্তার ‘উলামায়ে কেরামদের বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন অসম্ভব’ নিউইয়র্কে যাদের সঙ্গে বৈঠক হতে পারে প্রধান উপদেষ্টার গাজাজুড়ে ইসরায়েলের নৃশংস হামলা, নারী-শিশুসহ নিহত ২৮ ফিলিস্তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল প্রকার রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত 'ঢাবি ও জাবির হত্যাকাণ্ডে জড়িত খুনীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে' ঢাবিতে যুবক হত্যায় ছাত্রলীগ নেতাসহ ৩ জন আটক কওমী মাদরাসার ছাত্রদেরকে বিসিএস এ অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়া বৈষম্য: মুফতী ফয়জুল করীম শায়খে চরমোনাই 

অন্তরালে...

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুস্তকীম বিল্লাহ মাসুম

কাঁদিস না সাদিকা৷আমি আছি তো! কিচ্ছু হবে না মায়ের৷

কথাগুলো যেন রাতের বুক চিরে বেরিয়ে এলো সাদিকের কণ্ঠ থেকে৷ সাদিকের বাড়ি বাঁশখালি গ্রামের উত্তর দিকে৷ ওদের গ্রামের নাম বাঁশখালি হলেও সেখানে বাঁশের কোন অভাব নেই৷ওদের নিজেদেরও একটা বাঁশঝাড আছে়৷ তবুও গ্রামের নাম বাঁশখালি হওয়ার কারণটা অন্য দশজনের মত সাদেকেরও অজানা৷

মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ও৷ মা খাদিজা বেগম আর ছোট বোন সাদিকাকে নিয়েই ওর পুরো পৃথিবী৷
বাবা মারা গেছেন গত বছর আশ্বিনের শেষ দিকে৷বাবা থাকতে সাদিকরা জোসনার রাতগুলোতে উঠোনে মাদুর পেতে বসত এবং গল্প করত বাবার সাথে৷মাঝে মাঝে বাবা এমন সব মজার মজার গল্প বলতেন যে, ওরা ভাইবোন হাসতে হাসতে কুটিকুটি হত৷গভীর রাত পর্যন্ত চলত তাদের এই আড্ডা৷

সেদিনও ছিল জোসনা রাত৷উঠোন ছিল চাঁদের আলোয় ভেজা৷ বাবার গল্পটাও জমে উঠেছিল বেশ৷আড্ডাটা আরো কতক্ষণ চলত কে জানে! অবশেষে মায়ের মিষ্টি বকুনিতে বাধ্য হয়েই সেদিনের মত শেষ করতে হয়েছিল৷
কিন্তু কে জানত, শেষ হওয়া এই গল্পের আড্ডাটা আর কখনই শুরু হবে না!

রাতে কী ঘটেছিল কেউ জানে না৷কিন্তু প্রতিদিনের মত সেদিন ভোরে বাবা আর ফযরের নামায পড়তে ওঠেননি৷ঘুমের মাঝেই হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি৷

আগের মত জোসনা রাতগুলো এখনো ফিরে ফিরে আসে৷দূর আকাশের চাঁদটা এখনো ক্ষণেক্ষণে হাসে৷খেজুর পাতার সেই মাদুরটা ঘরের কোণে পড়ে আছে এখনো৷শুধু বাবা নেই৷ নেই সেই গল্পের আড্ডাটাও৷
বাবার শোকে শয্যাশায়ী হলেন মা৷এই শোক কাটিয়ে উঠতে প্রায় তিনমাস লেগে গেল৷

ধীরে ধীরে আবার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন৷ নতুন উদ্যমে ফের শুরু হল জীবনের পথচলা৷
এটাই প্রকৃতির নিয়ম৷জগত সংসার কখন কারো অপেক্ষায় থেমে থেকেছে, এমন কথা আজো শোনা যায়নি৷সম্ভবত শোনা যাবেও না কোনদিন৷ এভাবেই হয়,হয়ে আসছে৷

তবে এখনো বাবার বিরহে মায়ের চোখ মাঝে মাঝেই ভিজে ওঠে৷ নারী অস্তিত্বের কতটা জায়গা জুড়ে স্বামীর অবস্থান, সেটা শুধু একজন বিধবায় উপলব্ধি করতে পারে৷ সাদা শাড়ীর আঁচলে লুকিয়ে রাখা কষ্টগুলো কজনই বা বোঝে৷ এটাকেই বোধহয় বলে বোবা কান্না৷বোবাকান্না বোঝার মত ক্ষমতা সব মানুষের থাকে না৷যাদের আছে, তারা বহু কষ্টের ঐশ্বর্য্যের মালিক! তারা কষ্টকে ঐশ্বর্য্যের মত ভোগ করতে পারে৷

আজকাল কেন জানি খুব অল্পতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন মা৷সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকেন তিনি৷ তবুও আরগ্যের দেখা মেলে না৷ সম্ভবত রোগের আলাদা কোন ধর্ম নেই৷ কর্মরত বা কর্মহীন, যে কাউকেই স্পর্শ করতে পারে৷
আজ বিকেলে হঠাৎ করে মায়ের বুকের ব্যথাটা বেড়ে গেছে৷সন্ধ্যার পর থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে৷তাই মাকে হাসপালে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল সাদিক৷

বাঁশখালি থেকে সদর হাসপালের দুরত্ব প্রায় দশ কি: মি:৷ গাড়ি ভাড়া করতে বের হল সাদিক৷বাঁশখালিতে অনেকেই সিএনজি চালায়৷ কিন্তু আজ কেউ যেতে রাজি হল না৷ কয়েকদিন ধরে বাঁশখালির বর্তমান চেয়ারম্যানের সাথে সাবেক চেয়ারম্যানের গোণ্ডগোল চলছে৷গতকাল রামদার কোপে খুন হয়েছে দুজন৷তাই গ্রামে পাহারা বসিয়েছে পুলিশ৷সন্ধ্যার পর রাস্তায় বের হওয়া নিষেধ৷কখন কী হয় এই ভয়ে কেউ বের হতে সাহস করল না৷

অগত্যা পাশের গ্রাম থেকে কবির মামাকে ডেকে আনল সাদিক৷কবিরের প্রাইভেট সিএনজি আছে৷ ওরা যখন মাকে নিয়ে সিএনজিতে উঠল, রাত তখন আঁধারকে নিয়ে নেমে এসেছে পৃথিবীতে৷

হেডলাইটের আলোয় পথ চলছে সিএনজি৷ মায়ের বুকের ব্যথা আরো বেড়েছে৷এখন শ্বাস নিতেও বড্ড কষ্ট হচ্ছে তাঁর৷হার্টবিড বেড়ে চলেছে দ্রুত৷ মায়ের করুণ অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে উঠল সাদিকা৷ওকে সান্তনা দিতে গিয়ে সাদিক বলল,কাদিস না,আমি আছি তো! কিচ্ছু হবে না মায়ের৷কিন্তু কথাটা বলে সাদিক বোনকে সান্তনা দিল,না নিজেকে প্রমোধ দিল বোঝা গেল না৷

সিএনজির স্পিড আরেকটু বাড়িয়ে দিল কবির৷গ্রামের আঁকাবাঁকা পথে এর চে' বেশি স্পিড বাড়ান সম্ভব না৷ছুটে চলল সিএনজি৷মায়ের শিয়রে বসে তখনো কেঁদে চলেছে সাদিকা৷বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না থামাবার চেষ্টা করল সাদিক৷কিন্তু অন্ধকারে সাদিকের ভেজা চোখ দেখতে পেলনা কেউ৷

প্রায় শহরের রাস্তার মুখে এসে পড়েছে সাদিকরা৷হঠাৎ রাস্তার পাশের একটা ঝোপ থেকে যমদূতের মত উদয় হল একদল পুলিশ৷হাত উঁচিয়ে ওদেরকে থামার নির্দেশ দিল৷ধক করে উঠল কবিরের মন৷ হার্ডব্রেক কষে থামিয়ে দিল সিএনজি৷পুলিশের দলটা সিএনজিকে ঘিরে দাঁড়়াল৷ পুলিশ অফিসার একটু এগিয়ে এসে বলল,এত রাতে কৈ যাও? জানো না,সন্ধ্যার পর বের হওয়া নিষেধ’৷

কবির বলল, হাসপাতালে যাচ্ছি স্যার৷আমার বোন খুব অসুস্থ৷
না, যাওয়া যাবে না৷উপর থেকে নিষেধ আছে৷

ওদিকে যন্ত্রণায় কাঁতরাতে শুরু করেছেন খাদিজা বেগম৷ সাদিক অস্থির হয়ে বেরিয়ে এল সিএনজি থেকে৷অফিসারের হাত দুটো চেঁপে ধরে বলল, আমার মা খুব কষ্ট পাচ্ছে স্যার! দয়া করে আমাদের হাসপালে যেতে দেন৷

অফিসার সাদিকের পকেটের দিকে ইশারা করে বলল,ওকে,আমাদের জন্য হালকা চা নাস্তার ব্যবস্থা কর৷ আমি দেখি কী করা যায়৷

অফিসারের মুখে চতুর হাসি৷

এতক্ষণে থলের বিড়ালটা যেন বেরিয়ে এল৷পুরো ব্যাপারটা বুঝতে আর কষ্ট হল না সাদিকের৷ পকেট থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করে অফিসারের হাতে গুঁজে দিল ৷ একটা ক্রড় হাসি ফুটে উঠল অফিসারের মুখে৷ অবজ্ঞা ভরে বলল,ব্যাটা ফকির না কি আমরা!দশ হাজার টাকা লাগবে৷

চমকে উঠল সাদিক৷চা নাস্তা খেতে এত টাকা লাগে! সাদিক পকেট থেকে দুৃহাজার টাকা বের করে বলল,স্যার,এটাই রাখেন,এর চে’বেশি দিলে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা যাবে না৷
‘প্যাচাল পাইরো না৷পুরাটা দিয়ে দাও, ল্যাঠা চুকে যাক!

কবির একটু এগিয়ে এসে বলল,সার,এখন এটাই রাখেন৷বাকিটা না হয় কালকে দেব৷
‘শালা মজা নাও!তুমি যে কাল আসবা তার গেরান্টি কি? সি এনজি রাইখা হাইটা যাও৷

এ সময় সিএনজি থেকে সাদিকা চিৎকার করে উঠল,ভাইয়া! আম্মু কেমন যেন করছে৷তুমি তাড়তাড়ি আস৷
সাদিক যেন পাগল হয়ে গেল৷উন্মাদের মত চিৎকার করে বলল,রেখে দে সিএনজি!আমার মাকে আমি কাঁধে করে নিয়ে যাবো!

তোরা তো শালা জারজ সন্তান৷ মায়ের কষ্টের কী বুঝবি!

সাদিকের আর্তচিৎকারে পুলিশদের মাঝে কোন পরিবর্তন দেখা গেল না৷যারা একজন অসুস্থ মায়ের আর্তচিৎকারকে উপভোগ করতে পারে, সামান্য কটা টাকার জন্য জারজ উপাধি নেয়াটা তাদের কাছে নস্যি!
অসুস্থ মাকে কাঁধে তুলে নিয়ে এগিয়ে চলল উন্মাদ ছেলে সাদিক৷ অব্যক্ত যন্ত্রণায় মুহ্যমান সাদিকা পাগলিনীর মত ছুটে চলল ভাইয়ের পিছু পিছু৷নির্বাক কবির ভাবতে থাকে,সত্যি কি এরা মানুষ!!?

দূর আকাশের চাঁদটা তখন মুখ লুকোলো মেঘের আড়ালে৷আজ পৃথিবীর জোসনার কোন প্রয়োজন নেই৷ আমাবস্যার আঁধারে যেন ঢেকে ফেলতে চায় নিজেকে৷ হয়ত এমন করুন দৃশ্য দেখতে প্রস্তুত নয় প্রকৃতি৷

তখন রাতের শেষ প্রহর৷নিঝুম প্রকৃতি৷ বাঁশখালির পথ ধরে একটা এ্যাম্বুলেন্স আসতে দেখা গেল৷অর্ধঘুমন্ত পুলিশের দলটা সতর্ক হয়ে উঠল৷এ্যাম্বুলেন্সটা তাদের বরাবর হলে হাত উঁচিয়ে থামার নির্দেশ দিল অফিসার৷
থেমে গেল এ্যাম্বুলেন্স৷অফিসারটি ভারি টর্চের আলো ফেলল এ্যাম্বুলেন্সের খোলা জানালায়৷টর্চের আলোয় জানালার পাশে বসে থাকা সাদিককে চিনতে কষ্ট হল না অফিসারের৷

মাকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে পৌঁছতে পেরেছিল সাদিকরা৷ কিন্তু কর্তব্যরত ডাক্তার নার্ভ পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেছে৷

মাকে হাসপালে ভর্তি করানোর সেই টাকাগুলো দিয়েই এ্যাম্বুলেন্স নিয়েছে সাদিক৷

হাসপাতালে যেতে মায়ের অনেক কষ্ট হয়েছে,অন্তত কবরে যেতে যেন তাঁর কোন কষ্ট না হয়!

মায়ের লাশের পাশে নিথর হয়ে পড়েছিল সাদিকা৷চোখ দুটি ভেজা৷এলোমেলো চুল৷বিদ্ধস্ত চেহারা৷এ্যাম্বুলেন্স থামার শব্দে চকিতে মুখ তুলে চায়লো সে৷জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অফিসারকে দেখে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না৷অদ্ভুত এক কণ্ঠে বলে উঠল,টাকা লাগবে সার, টাকা! কিন্তু টাকা তো নেই! আমার আম্মুর লাশ আছে সার,লাশটা দিলে কি আমাদের ছেড়ে দেবেন?

এতক্ষণে অফিসারের চোখ দুটিও যেন ভিজে উঠলো৷প্রতিটা মানুষের ভেতরে আরেকটা মানুষ বাস করে৷ উপরের মানুষটা খারাপ কিছু করলে ভেতরের মানুষটা তার সাক্ষী দেয়৷ তাই মাঝে মাঝে উপরের মানুষটা ভাল হয়ে যায়৷অথবা ভাল হয়ে যাওয়ার ভান করে৷ অফিসারের ক্ষেত্রেও সম্ভবত সেটাই ঘটেছে৷

পুনশ্চ: তুমি আমাদের গ্রামের সন্তান৷পুলিশ হইছো জেনে ভাল লাগতিছে৷ কিন্তু এক বছরের মধ্যে আমার ছয় লাখ টাকা দিতি না পারলি নিয়ম অনুযায়ী তোমাদের বাড়িটা আমার নামে হিয়া যাবি৷এই চিন্তাটাও মাথায় রাইখো’৷ চেয়ারম্যানের কথাই চিন্তার বলিরেখা গাঢ় হলো সেলিমের কপালে৷ চাকরিটা পেতে ছয় লক্ষ টাকা দিতে হয়েছে৷ অসুস্থ বাবার চিকিৎসা আর সংসারের খরচ যোগাতে চাকরিটা তার খুবই প্রয়োজন ছিল৷ তাই বাধ্য হয়েই বাড়িটা বন্ধক রেখে ছয় লক্ষ টাকা নিয়েছে সে৷ কিন্তু এক বছরের মধ্যে কীভাবে শোধ করবে এতগুলো টাকা! চিন্তার অথৈ সাগরে ডুবে যায় সেলিম৷ সারাটা জীবন সৎ পথে চলেছে সেলিমের বাবা৷ হয়ত সেই বাবাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাকে আজ অসৎ পথ অবলম্বন করতে হবে৷এ ছাড়া আর উপায়ই বা কি!
টাকার কাছে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হল সেলিমের৷

ছোটগল্প: জীবনকাহন

 


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ