শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


ছোটগল্প: জীবনকাহন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

কিঙ্কর আহ্সান
গদ্যশিল্পী

kingkar_ahsanরিজাইন লেটারটা লেখাই আছে।
প্রতিদিনের মতন আজও ভাবছি ছেড়ে দেবো চাকরিটা। হয় না। সাহসে কুলায় না। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েদের সাহস কম হয়।

মাস শেষে নিশ্চিত আসবে এটা জেনে অল্প কয়টা টাকার ফাঁদে আটকে পড়ে থাকে তারা। আমারও একই অবস্থা। ছুটতে পারছি না। একা হতে পারছি না। একা হবার জন্য যখনই আকুলি করে মন তখনই দুখী মায়ের মুখ সামনে চলে আসে। মনে পড়ে ক্লান্ত বাবার কথা। অযথা স্বপ্ন দেখা বোকা প্রেমিকার ভালোবাসায় থমকে যেতে হয়। বাধা পড়ে গেছি। আছি।

আমি তো একটা ঘর চেয়েছিলাম। কোন একটা চুপচাপ, সহজেই ঠাই পাওয়া যায় এমন একটি নদীর পাড় ঘেষে দাড়ানো ছোট্ট কাঠের বাড়ি। বাড়ির চারপাশ ঘিরে গাছের দেয়াল। পাতার ফাঁক গলে সাত সকালে তেরছাভাবে আসা রোদ। বাড়ি সামনে বুনো ঘাস, নীলচে ফুল। একটা পোষা ফিঙে পাখি। এইতো। সকালে উঠে এক কাপ রং চা। চিনি ছাড়া। গাঢ় লিকার। সাথে মিষ্টি হাওয়া বিস্কুট। সকালের নাস্তা।

খুব বেশি খিদে পেলে দুটো চাল বসানো উনুনে। পাতিলেই সেদ্ধ হবার জন্য দিয়ে দেওয়া আলু। একটু কাঁচা মরিচ, পেয়াজ, তেল দিয়ে সেদ্ধ আলু চটকে ভর্তা বানানো আর সাথে গরম ধোয়া ওঠা ভাত ব্যস!

এরপর ছিপ নিয়ে বসে যাওয়া নদীর পাড়ে। সারাদিনে দু-একটা মাছ। টাকি হলেই চলবে। ঝোল ঝোল করে আলু, পেপে বা লাউয়ের সাথে রান্না। তারপর কাজ নেই। সারাদিন বই পড়বো। দুপুরের খাবারই রাতে বাসি হলে গরম করে খাওয়া হবে। খাওয়ার জন্য এত কষ্ট করা যাবে না।

বই পড়া হবে। রোমাঞ্চকর সব বই। গোয়েন্দা বই থেকে কাঠখোট্টা প্রবন্ধের বই কিছুই বাদ যাবেনা। মাঝে মাঝে একটা দুটো অযথা কবিতা লেখার চেষ্টা। বেলের শরবত, ডাবের পানিতে নেশা গাড় হবে। ঘরের জানালা দিয়ে একটানা তাকিয়ে থাকবো অন্ধকারের শূণ্যতায়। ঝিঝি পোকা ডাকবে। জোনাক পোকা আলো জ্বালিয়ে নিভিয়ে নষ্টামি করবে। কোন কোন দিন মাথায় পাগলামি উঠলে নিজের একটা ছোট্ট নৌকা নিয়ে নেমে পড়বো নদীতে। মধ্যিখানের গাঙে পৌছে নৌকা শুনবে স্রোতের কথা। তারপর ঘুম। শান্তির ঘুম।

কোন চাওয়া-পাওয়া নেই। বড় হবার ইচ্ছে নেই। তাড়া নেই। পিছুটান নেই। নিজের জীবন। নিজের জন্যই যাপন করা।

এইতো এমনই। খুব বেশি কিছু নয়। নদীর পাশে বাস করে নিজেই একদিন নদী হতে চাওয়া।

পারি না। যেমন তেমনই টেনে নেই জীবন। রিজাইন লেটারটা পরে থাকে ড্রাফট বক্স এ। পাগলামি দেখে হাসে কলিগ অপু ভাই। বলে,‘খোঁজ নিয়ে দেখো আমাদের সবারই ড্রাফট বক্স একটা করে রিজাইন লেটার আছে। আছে হাবিজাবি ইচ্ছা-অনিচ্ছা। সেসব কখনও সত্যি হয়না। অতটা সাহস করে ওঠার যোগ্যতা আমাদের নেই। মানুষ একা হতে পারেনা। একা হওয়া সহজ নয়।’ কথাগুলো সত্যি। তবুও মানতে ইচ্ছে করে না।

অন্য দশটা দিনের মতন অফিস শেষ হবার আগে, নিচে নেমে বাসে ওঠার আগে অপু ভাইকে বলি নিজের অক্ষমতার কথা। ইচ্ছের কথা। বলি, নদী হতে চাই। কথা শুনে সে হাসে। বলে, নদী চিনলে না। নদী তো সব সহ্য করে। কচুরিপানার যন্ত্রনা, মাছের ওলটপালট, নৌকার মোচড়, চড়ের লুটপাট সব নীরবে সয়। অভিযোগ নেই। ক্লান্ত হয়না। নদী সে’তো ভালো নেই। সে যে মানুষই। নিজের জীবন যাপন করা হয়না কখনও। করে যায় অন্যের জন্য।

আমি হতাশ হই। নদীর জন্য মন খারাপ হয়। মন খারাপ হয় নিজের জন্য, মানুষের জন্য। অতঃপর অফিস শেষে বাড়ির পথ ধরি। অপু ভাইয়ের সাথে। প্রতিবেশীও তিনি। আমার চড়–ই পাখির মতন মন মরা মুখ দেখে বলে, ‘ক্লান্ত জানি কিন্তুু পালানো যায় না যে। বাড়িতে অনেকগুলো মানুষ অপেক্ষা করে আছে। তাদের রেখে পালানোটা অপরাধ।’

শুনি। কিছু বলি না। মেইলটা ড্রাফট বক্স এ থাকুক। কিছু কিছু কথা কোনদিন বলা হয় না। করা যায় না কিছু কিছু কাজ কোনদিনই।
তবুও নিজের জন্য অপরাধ করতে ইচ্ছে করে। অপরাধী হতে ইচ্ছে করে।

নিস্পাপ শিশু তো হতে চাইনি। একটু আধটু পাপ না করলে সে জীবন তো জীবনই নয়।

এরপর রাত হয়। সবার অগোচরে এতকিছুর পরেও আজ সদর দরজা খুলি। যেতে হবে। ঘুম ঘুম প্রিয় মানুষ। আমার ইচ্ছেরা হাতছানি দিয়ে ডাকে কিন্তুু ‘ছি। ছি। ছি...।’ শুনতে পাই। কে বলে?

মা? বাবা? প্রেমিকা? অফিস? সমাজ?

না। আর পারি না। পারা যায়? এসব শুনে যেতে?

আমি আর জীবনে বিশ্বাস করিনা। কিংবা এটা জীবনই নয়। এর নাম অন্য কিছু। ফাঁদ কি?

জেএম


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ