বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


‘আজ আমার ছোটবেলার কয়েকটি ঘটনা বলছি’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

[জামিয়া দারুল উলুম করাচির মুখপাত্র ‘ماہنامہ البلاغ মাহনামা আল-বালাগ’ এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত বিশ্বনন্দিত আলেম, স্কলার আল্লামা তাকি উসমানির আত্মজীবনী আওয়ার ইসলামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ।

এ বিষয়ে আল্লামা তাকি উসমানি আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ার ইসলামকে ভাষান্তর করে প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন। গত ২ জানুয়ারি জামিয়া দারুল উলুম করাচির তাখাসসুস ফিল ইফতার শিক্ষার্থী, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের শুভাকাঙ্ক্ষি উমর ফারুক ইবরাহীমীর মাধ্যমে আল্লামা তাকি উসমানি ও পত্রিকা কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মজীবনী ‘ইয়াদে’ অনুবাদের অনুমতি চাওয়া হলে তারা খুশি মনে রাজি হন এবং আওয়ার ইসলামকে ধন্যবাদ জানান বাংলাভাষায় ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য।

আল্লামা তাকি উসমানির নতুন ধারাবাহিক আত্মজীবনী “یادیں ইয়াদেঁ ” মাহনামা আল-বালাগে সফর ১৪৩৯ হিজরি, নভেম্বর ২০১৭ ইংরেজি মাস থেকে। আওয়ার ইসলামে লেখাটি সপ্তাহে দুদিন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে। আজ প্রকাশ হলো ১৪ তম কিস্তি। অনুবাদ করেছেন মাওলানা  উমর ফারুক ইবরাহীমী।]

আমি আমার নয় ভাই বোনের সবার ছোট। সম্ভবত এই জন্যই সবার আহ্লাদি। জানা নেই, এটা সবার আহ্লাদের কারিশমা ছিলো, নাকি সত্যিই এ বিষয়টির কোনো বাস্তবতাও আছে যে, আমার আব্বা, আম্মা থেকে শুরু করে ভাই, বোন সবাই এতটুকু ছোট্টবয়স থেকে আমার মেধাশক্তির গুণগ্রাহী ছিলেন।

তাঁদের এ দাবির স্বপক্ষে আমার যেসব ঘটনা উপস্থাপন করা হয়, সেগুলো আজও আমার এমনভাবে মনে গেঁথে আছে, এ যেনো আজকেরই ঘটনা।

সেগুলো থেকে কয়েকটিমাত্র উল্লেখ করছি, হয়তো আপনিও আনন্দ পাবেন। এখন সেসব ঘটনাপ্রবাহ লেখার জন্য আমার কলমও যেনো উদগ্রীব হয়ে আছে।

আমার আব্বাজান হজরত মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ শফি রহ.(আল্লাহ তা'আলা তাঁর উপর রহমতের বারি বর্ষণ করুন!) যদিও তিনি দারুলউলুম দেওবন্দের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রধান মুফতি ছিলেন এবং আল্লাহ তাঁকে ইলম ও ফজলের যে সুউচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন, সে খ্যাতি দেশজুড়েই ছিলো।

তাঁর নিবেদিত প্রাণ শিষ্যরা প্রিয় উস্তাজের প্রতিটি খেদমতকে নিজের জন্য বড় সৌভাগ্যের সোপান মনে করতো। কিন্তু আব্বাজানের মেজাজে এতটাই নিরহংকারিতা এবং সরলতা ছিলো যে, ঘরের বাজার সদাইসহ যাবতীয় কাজের জন্য নিজেই বাজারে চলে যেতেন।

কখনো কখনো ঘরের প্রয়োজনীয় কিছু কেনার পর সেটা নিজের কাপড়ে ভরে নিয়ে আসতেন।

তখন আমি এতটুকু বড় হয়ে গিয়েছিলাম যে, আব্বাজানের অঙ্গুলি চেপে ধরে তাঁর সাথে বাজারে যেতে পারি। আব্বাজানের সাথে বাজারে গেলে, ফেরার পথে তিনি আমাকেও পছন্দমত কিছু না কিছু কিনে দিতেন।

তখনো চকলেট, টফি যুগের সূচনা হয়নি। তাই আমাদের পছন্দইবা কি ছিলো! ভূনাচনা, ভুট্টাভাজা, মুড়ির মোয়া, বরফ মালাই (এটি আইসক্রিমের একটি দেশীয় আইটেম) এবং দেশীয় মিঠাই এসব কিছু।

যুগের কিছুটা উন্নতি হলে, এক পয়সায় চকলেটের মতো ছোট্ট মিঠাই পাওয়া যেতে শুরু করলো।আকৃতিতে সেটা কমলালেবুর কোয়ার মতো হতো। আমরা এটাকে ‘সাঙতারে কি মিঠাই’ বলতাম।

এখন মনে হচ্ছে, সে জামানায় বাচ্চাদের চাহিদা বেশির ভাগ এমন কিছুর প্রতি থাকতো, যেগুলো স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এবং সস্তায় সব খানেই পাওয়া যেতো। বাচ্চাদের খুশি করার জন্য আজকালের মতো অস্বাস্থ্যকর এবং দামি জিনিসপত্রের কল্পনাও তখন ছিলো না।

যাই হোক! আব্বাজান যখন আমাদের সঙ্গে করে কোথাও নিয়ে যেতেন, উল্লেখিত জিনিসের কোনো একটি অবশ্যই কিনে দিতেন। ফলে আমাদের আসা যাওয়ার কষ্ট স্বার্থক হয়ে যেতো।

তবে বাজারে যাওয়ার কারণ আদৌ এসব ছিলো না। আমাদের কিছু কিনে দেয়া একান্ত আব্বাজানের তরফ থেকেই ছিলো। সন্তানের নিজ থেকে কিছু কিনে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করা, অথবা আদেশ করার প্রচলন তখনো শুরু হয়নি।

সুতরাং একবার এমন হলো, আব্বাজান বাজার থেকে আলু নিয়ে ঘরে ফিরছিলেন। আমিও তাঁর আঙুল চেপে ধরে সাথে চলছিলাম। ঘটনাক্রমে সেদিন তিনি বাজার থেকে আমাকে কিছু কিনে দেয়ার কথা বেমালুম ভুলে গেলেন।

এদিকে আমার মনের আঙিনায় ঘুরপাক খাচ্ছে, আমারও তো কিছু মেলা উচিত। কিন্তু মিলছিল না। আব্বাজান বাজার পেরিয়ে বাসার গলির দিকে মোর নিচ্ছিলেন। তারপর এমন কোনো দোকানও নেই যে, আমাদের পছন্দমত কিছু পাওয়া যাবে।

যখন বুঝতে পারলাম, এখন আর কিছু পাওয়ার আশা নেই। এদিকে যেমনটা পূর্বে বলেছিলাম যে, নিজের থেকে কিছুর আদেশ করা তখনকার রেওয়াজ এবং স্বভাববিরুদ্ধ ছিলো। অপরদিক আব্বাজানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও মন চাচ্ছিলো, আপনি কিছু ভুলে যাননি তো!

তখন আমার কচিমন এই দুটি বিপরীত বিষয়ের সমাধান এভাবে বের করলো, আমি আব্বাজানকে বললাম- ‘আব্বাজি! আমার হাতে না হয় আলুই ঢেলে দিন!

আব্বাজান আমার মুখে এমন কথা শুনে অনিচ্ছাকৃত হেসে দিলেন এবং আলুর পরিবর্তে আমার চাহিদামতো কিছু কিনে ঘরে ফিরলেন। বাসায় ফিরে সবাইকে আমার এই ঘটনা শোনালেন, পরবর্তীতে এটি একটি কৌতুকে পরিণত হলো।

প্রতি বুধবার দেওবন্দে একটি বাজার বসতো। সেখানে ওই অঞ্চলের মানুষ নিজস্ব আসবাবপত্র বিক্রয়ের জন্য নিয়ে আসতেন। সে বাজারে সাধারণত ঘরোয়া জিনিসপাতি সস্তায় কেনাবেচা হতো। সবাই এটাকে ‘বুধবাজার’ বলতেন।

আব্বাজান একবার সে বুধবাজারে যাবার সময় আমাকেও সঙ্গে নিয়েছিলেন। এখন মনে নেই তিনি বাজার থেকে কী কিনেছিলেন, তবে সে বাজার, বেশিরভাগ ঘরের নিত্যপ্রয়োজনীয় আসবাবের জন্য খ্যাত ছিলো।

সেখানে ছোট্টদের চাহিদা মাফিক বিশেষ কিছু পাওয়াও যেতো না। তাই সেদিনও তিনি আমাকে কিছু কিনে দেননি। কাজ শেষে এবার ঘরে ফেরার পালা। আমরা বাজারের সর্বশেষ দোকানের কাছে পৌঁছে গেলাম।

দোকানে চিনির তৈরি বাতাসার ঢের সাজিয়ে রাখা ছিলো। পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় এটা দেখে আমি নিজেকে আর সংবরণ করতে পারলাম না। সাথে সাথে আব্বাজানকে বললাম-‘আব্বাজি! অন্তত বাতাসার মূল্যটাই জিজ্ঞেস করে নিন না!’

এভাবেই আমি আব্বাজানের ভুলে যাওয়া দায়িত্ব মনে করিয়ে দিতাম। চলবে ইনশাআল্লাহ...

আগের পর্ব: আমার জীবনের শুরুর মুহূর্ত


সম্পর্কিত খবর