শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫


বিকল্প শক্তি হিসেবে ইসলামি দলগুলোর জোট গঠনে জোর আলোচনা

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আতাউর রহমান খসরু
বার্তা সম্পাদক

জোটবদ্ধ রাজনীতির কালচারটাই এখন জনপ্রিয়। আদর্শ, চেতনা ও ক্ষমতা বণ্টনের হিসেব সামনে রেখে সারা পৃথিবীতে জোটবদ্ধ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষত ভোটের রাজনীতিতে জোট অপরিহার্য হয়ে উঠছে সর্বত্র। তাই ছোট দলগুলোর পাশাপাশি বড় দলগুলোও সমানভাবে জোটবদ্ধ রাজনীতিতে আগ্রহী।

বাংলাদেশে জোটের রাজনীতি শুরু হয় স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়। তখন এরশাদকে ক্ষমতা থেকে সরাতে এক মঞ্চে আসেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আদর্শিক বৈপরিত্ব থাকা সত্ত্বেও জোটবদ্ধ হয় আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী।

১৯৯১ এর আট দলকে সাথে নিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। অন্যদিকে, বিএনপি ৭ দলীয় জোট নিয়ে অংশ নেয়। ১৯৯৬ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাসদ, ন্যাপ ও আরো নামসর্বস্ব কয়েকটি দল নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালের নির্বাচন পর্যন্ত মূলধারার ইসলামি দলগুলো দেশের প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় নি। যদিও তারা ইসলামী ঐক্যজোট নামে ঐক্যবদ্ধ হন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে অংশগ্রহণ করে। তখন এর বিরোধিতা করে জোট ত্যাগ করে চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।

এ নির্বাচনে চার দলীয় জোট বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়। ইসলামী ঐক্যজোট এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ক্ষমতার অংশিদারিত্বের প্রশ্নে ভাগ হয়ে যায় ইসলামী ঐক্যজোট।

২০০৭ সালের সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে  গঠিত হয় ১৪ দলীয় মহাজোট।

এরপর বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে সংযুক্ত হয়েছে আরও কয়েকটি দল।

শুরু থেকে ইসলামি দলগুলো বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে থাকলেও ক্রমন্বয়ে কয়েকটি দল জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ খেলাফত মসলিস ও ইসলামী ঐক্যজোট। যদিও ইসলামী ঐক্যজোটের কিছু নেতা সেখানে থেকে যান একই নামে।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর ইসলামি দলগুলোর রাজনৈতিক ইতিহাস খুব সুখকর নয়। এরপর থেকে ভাঙ্গনের মুখে পড়ে ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।

সম্প্রতি জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আরও সংঘবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে ইসলামি দলগুলো। শোনা যাচ্ছে, ইসলামী ঐক্যজোটের নেতৃত্বে জোটবদ্ধ হবে দলগুলো।

মূল ধারার ইসলামি দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করা গেছে। তারা আন্তরিকভাবে জোটবদ্ধ হতে চাচ্ছেন তবে সম্ভাব্য জোটের কোনো রূপরেখা এখনো দাঁড় করানো যায় নি বলে জানিয়েছেন তারা।

নির্বাচন সামনে রেখে এ জোট হলেও ইসলামি দলগুলোর স্থায়ী জোটেই তাদের আগ্রহ বেশি।

ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ আওয়ার ইসলামকে বলেন, ‘দেশের মানুষ এখন ইসলামি শক্তির জাগরণ চায়। জনগণের প্রত্যাশা সামনে রেখেই ইসলামি দলগুলোর মধ্যে জোটবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সবাই আন্তরিক। খুব শিগগির একটি সুফল দেখতে পাবেন ইনশাআল্লাহ!’

তবে সুনির্দিষ্ট সময় ও কাদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে সে ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু বলতে রাজি হন নি তিনি।

মূলধারার ইসলামি দলগুলোর মধ্যে খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ বিএনপি জোটের অংশিদার। তারা এখনো বিএনপির নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা ভাবছে জানিয়েছেন খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের ও জমিয়তের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট শাহীনূর পাশা

অবমূল্যায়নের কারণে জোট ছাড়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের বলেন, এ ধরনের প্রচার-প্রচারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা। খেলাফত মজলিস জোটে আছে এবং থাকবে।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের নেতা মুফতী মুহাম্মদ ওয়াক্কাস জানিয়েছেন তারা জোটে আছেন এবং থাকবেন। ৯ ডিসেম্বরের ঘটনার পর তারা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করলে তিনি তাদের আশ্বস্ত করেন।

এ সময় তিনি ইসলামি দলগুলোর পৃথক জোট গঠনের ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহও নেই বলে জানান।

অপর ইসলামি দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস জোটের ব্যাপারে আগ্রহী। তারা ইসলামি দলগুলোর পৃথক প্লাটফর্ম তৈরি করতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। দলের মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক আওয়ার ইসলামকে বলেন, ঐক্য আমাদের একটি মৌলিক কর্মসূচি। আমরা ঐক্যপ্রত্যাশী ও প্রয়াসী। তবে আমরা এখনো কোনো জোটে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেই নি।

তিনি আরও জানান, সাম্প্রতিক ইসলামি দলগুলোর যে জোট হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে সে প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমরা এখনো জড়িত না।

কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, ফরায়েজী আন্দোলন ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগের মধ্যে জোটগঠনের জন্য কয়েকবার বৈঠক হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উদ্যোগটি আলোর মুখ দেখেনি বলে জানান মাওলানা মাহফুজুল হক।

তবে দলগুলোর ঐক্যের সম্ভাবনা এখনো শেষ হয়ে যায় নি বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী

তিনি আরও বলেন, ৪টি দলসহ নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত কয়েকটি দল নিয়ে জোট করার চিন্তা করছি। এ ব্যাপারে আলোচনা ও যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।

এর বাইরে অন্য কোনো দল জোটগঠনের জন্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নি বলে তিনি জানান।

যোগাযোগ করলে সাড়া দিবেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা বৃহত্তর ঐক্যের বিশ্বাসী। তাই কেউ আহবান জানালে আলোচনার ভিত্তিতে জোট গঠনের বিষয়টি বিবেচনা করবো। কিন্তু একক ব্যক্তি বা দলের নেতৃত্বাধীন কোনো জোটে যাওয়ার আগ্রহ আমাদের নেই।’

ইসলামি দলগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে রয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অনাগ্রহ বরাবর। কিন্তু কেনো? দলের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান এর ব্যাখ্যা তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচনসহ অন্যান্য ধর্মীয় ইস্যুতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। কিন্তু সে অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়। প্রতিবারই জোট ভেঙ্গে গেছে, আমাদের চলে আসতে হয়েছে কিন্তু আমরা দায়ী ছিলাম না।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ঐক্যে আগ্রহী নই এমন নয়; বরং অতীত ইতিহাসের কারণে তারা আমাদের ডাকতে লজ্জাবোধ করেন।’

ঐক্যের প্রস্তাব পেলে বিবেচনা করবেন কিনা? সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো এককভাবে নির্বাচনের চিন্তায় করছি। আমাদের প্রস্তুতিও সেভাবে এগুচ্ছে। ৩০০ আসনে আমাদের প্রার্থী নির্বাচনও শেষ দিকে।’

বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতৃত্বাধীন জোটকে পাশ কাটিয়ে এ জোট ভোটের রাজনীতিতে কতোটা সুবিধা করতে পারবে সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। একদিকে বাংলাদেশের মানুষ বিকল্প ভাবতে অভ্যস্ত নয়, অন্যদিকে ইসলামি দলগুলোর সাংগঠনিক দুর্বলতা।

তারপরও আশাবাদী ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ। তিনি মনে করেন, দেশের মানুষ এখন প্রধান দুই দল ও তাদের শাসনের ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ। মানুষ এখন অপশাসন থেকে মুক্তি চায়। আর তা সম্ভব ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এ সত্যটুকু মানুষ বুঝতে পেরেছে।'

এ জোটে ইসলামি দলগুলো কতোটা উপকৃত হবে সে হিসেবের চেয়ে বেশি করা হচ্ছে এ জোটের কারণে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কতোটা উপকৃত হবে তা নিয়ে। অনেকের ধারণা, এতে জোটে বিএনপির চিরায়ত ভোট ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদিও আওয়ামী লীগ খুব বেশি উপকৃত হবে না।

সরকার চাচ্ছে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব বৃদ্ধি পাক। ইসলামি দলগুলোর জোট হলে সে প্রত্যাশাই বেশি পূরণ হবে।

তবে মুফতি ফয়জুল্লাহ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির লাভ-ক্ষতির হিসেব সামনে আনতে নারাজ। তিনি বলেন, এদেশের ইসলাম ও মুসলমানের বৃহত্তর স্বার্থ সামনে রেখেই আমরা জোটবদ্ধ হতে চেষ্টা করছি। এখানে আমরা কতোটা উপকৃত হলাম সেটাই মুখ্য। অন্যদের লাভ হলো না ক্ষতি হলো, সরকার চাইলো না চাইলো তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না।

সম্ভাব্য এ ইসলামি জোটের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সংশ্লিষ্টতার প্রশ্নও তোলা হচ্ছে কোথাও কোথাও। কিন্তু উল্লিখিত নেতাদের প্রত্যেকেই হেফাজতে ইসলামের সম্পৃক্ততাকে অস্বীকার করেছেন।

তারা বলেছেন, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো সাংগঠনিক সম্পর্ক নেই এবং তা থাকাও উচিৎ হবে না।

হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব ও ইসলামি দলগুলোর নেতৃত্ব এক হওয়ায় এবং একই নেতৃত্ব উভয় সংগঠনের শীর্ষ পদে থাকায় সম্ভাব্যজোটে হেফাজতের ছায়া দেখছেন অনেকে।

বিষয়টি উত্থাপন করলে মাওলানা মাহফুজুল হক বলেন, হেফাজতে ইসলাম উলামায়ে কেরামের নেতৃত্বাধীন সাধারণ মানুষের প্লাটফর্ম। দেশের শীর্ষ আলেমরাই ইসলামি দলগুলোর নেতৃত্বে রয়েছেন এবং আলেম হিসেবেই হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দুই স্থানে তাদের পরিচয় ও ভূমিকা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

তিনি মনে করেন, হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফী ও মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বারবার বলেছেন, হেফাজত কখনো রাজনীতি করবে না। রাজনীতির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এরপর কারো কোনো সন্দেহ থাকা উচিৎ নয়।

ইসলামি দলে ভাঙ্গন: মুসা আল হাফিজ যা বললেন

মজলিস থেকে জমিয়ত : হৃদয় ভাঙার দায় কার?


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ