নোমান বিন আরমান
সাংবাদিক
নতুন এক যুগে প্রবেশ করেছে কওমি মাদরাসা। পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। সমাজ ও রাষ্ট্রের মনোযোগের মূল কেন্দ্র এখন এই প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ বছরই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে স্বীকৃতি প্রদানের প্রথম পরীক্ষা। ১৬ এপ্রিল সরকারের ‘আস্থাভাজন’ কমিটির প্রথম বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এসব নিয়ে সারাদেশের প্রায় ২০ হাজার প্রতিষ্ঠানে যে আবেগ-উচ্ছ্বাস এখন বিরাজ করছে, সেটি সীমিত আকারে থাকলে ঠিক আছে। এটাকে বাগাড়ম্বরে রূপ দেওয়া হীতে বিপরীত হবে। প্রত্যেককে এখন দায়িত্ববান হতে হবে। কথায়, কাজে মার্জিত ও বিচক্ষণতার পরিচয় রাখতে হবে। বালখিল্য আবেগ আর মাত্রাছাড়া কথাবার্তা থেকে সচেতনভাবে দূরে থাকতে হবে। সামাজিক এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত কারও কোনো ধরণের বিরূপ, বিতর্কিত অবস্থান, বিবেচনাবর্জিত বক্তব্য-আচরণ আত্মঘাতি হবে।
স্বীকৃতি ঘোষণার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এমন কিছু বক্তব্য এসেছে যা সময়সচেতন নেতৃত্বের পরিচয় রাখে না। আমরা দেখেছি, হেফাজতে ইসলামের বিগত আন্দোলনের সময়ও কোনো কোনো নেতার এমন বাগাড়ম্বর ও অপরিনামদর্শী বক্তব্য ভুল প্রমাণ হয়েছে। বিপদ ডেকে এনেছে। জনজোয়ারে আত্মহারা নেতারা ‘ধরাকে সরা জ্ঞান’ করে মুখে যা আসে- মঞ্চে-মিডিয়ায় তা বলে বেরিয়েছেন। তাদের অনুসারীরা আরও মাত্রা ছাড়া।
সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমসহ নানাভাবে তারা লাগামহীন এবং ক্ষেত্রবিশেষ অপরাধপ্রবণ বক্তব্য রেখে যাচ্ছেন। কে কার চেয়ে কতটা ‘জঘন্য’ ভাষায় ‘প্রতিবাদী স্ট্যাটাস’ দিতে পারেন, তার একটা নিম্নশ্রেণির প্রতিযোগিতা যেন চলছে। ১১ এপ্রিল গণভবনের বৈঠকের পর অনেকেই নিজের অবস্থা ও অবস্থান ভুলে গেছেন। ভুলে গেছেন ‘রাজনীতির’ মারপ্যাঁচও। তারা ধরে নিয়েছেন, আর বুঝি কখনো কোনো ‘অঘটন’ ঘটবে না! আর বুঝি কখনো কেউ তাদের দিকে চোখ তুলার সাহস পাবে না। ভুল, এমন বোধ নির্ঘাত ভুল। মনে রাখতে হবে, কওমি সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিলেছে, কওমিদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা নয়।
স্বীকৃতি পক্রিয়াটি এখনো আঁতুরঘরে আছে। একটা শিশুকে আমরা যে নিবিড়যত্নে পরিচর্যা করি- স্বীকৃতিকেও সেভাবেই ‘লালন-পালন’ করতে হবে। কারও সঙ্গে গুঁতোগুঁতি, দেখে নেবার, ছিঁড়ে ফেলার, বিচার করার সময় এটা নয়। এর এখতিয়ারও নেই। এখন দরকার নিবিড় সংযম। মক্কা বিজয়ে সর্বশক্তি থাকার পরও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের সংযমের যে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, কওমিসংশ্লিষ্টদের সেরকম সংযম দরকার। আচরণের সংযম, বলার সংযম ও ব্যবহারের সংযমটা এখন সব চেয়ে বেশি জরুরি। ইসলামের মৌলিক এই শিক্ষা দিয়েই জাতির সামনে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে হবে। অন্যদের চেয়ে ইসলাম অনুসারীদের অবয়ব অনন্য করতে হবে। এটা না করে গালি বদলে গালি, কুৎসার বলদে কুৎসা, বিকৃতির বদলে বিকৃতি- অকল্যাণই বয়ে আনবে। ইসলামকে সমাজের চোখে ছোট করবে, রাষ্ট্রের চোখে অপরাধী বানাবে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরোধিতা, মতপার্থক্য থাকবে না- এমনটা হবার নয়। স্বাভাবিকভাবেই কওমির স্বীকৃতিতে কোনো কোনো গোষ্ঠি আহত হবেন। তাদের ব্যথায় তারা মলম লাগাবেন। এসব নিয়ে কওমিসংশ্লিষ্টরা অযাচিতভাবে ‘চিৎকার-চেচামেচি’ কেনো করবেন! এই শিক্ষা তো তাদের দেওয়া হয়নি। তারা তো সংযম, আদব-আখলাকের শিক্ষা পাচ্ছেন। আচরণের সৌন্দর্যই তো ইসলামের বৈশিষ্ট্য। এটা তাদের ভুলে গেলে চলবে কেনো!
১৫ মে থেকে ছয় বোর্ডের সম্মিলিত পরীক্ষা
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লিগের সঙ্গে ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক একটা দূরত্ব সবসময়ই ছিল। এটা জিরো পর্যায়ে এসেছে এমন নজির বিরল। হেফাজতের ঢাকা অবরোধ, শাপলা-বিপর্যয়ের পর সেটি আগুন রূপ নিয়েছে। দূরত্ব গিয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষোভে। সহজে এটা দূর হবে এমন সম্ভাবনা দৃশ্যমান ছিলো না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর থেকে ফিরেই ক্যারিশমা দেখালেন। গণভবনে আলেমদের বৈঠকে নতুনরূপে নিজেকে উপস্থাপন করলেন। তাঁর এই কৌশল পাল্টে দিয়েছি রাজনীতির সব হিসেব-নিকেশ। আওয়ামী লিগের প্রতি যে জনরোষ ছিল- সেটি এক নিমিষে তলানিতে নেমে এসেছে। বিপরীতে অবশ্য ক্ষমতাসীন দলের বলয়ে থাকা বামবুদ্ধিজীবী, ছোটখাটো দল নাখোশ হয়েছেন। এই নাখোশভাব স্থায়িত্ব পাবে না। পেলেও শেখ হাসিনার রাজনীতির কৌশলের কাছে সেটি দাঁড়াতে পারবে না। তাই বলে, কওমিরা আওয়ামী লিগের ‘জানে জিগার’ হয়ে গেছেন, কওমির পোলাপন যা বলবে, তাই ঘটতে থাকবে- এমনটা ভাবা বালখিল্য নয়, পাগলামো।
কওমিপন্থীদের অবাস্তব বাগাড়ম্বর আর অলীক স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিরুদ্ধবাদীদের সমালোচনা নয়, সংযত হতে হবে। নিরবতাই তাদের মুক্তি (বিজয়) দেবে। কে কোথায় কওমির বিরুদ্ধে কী বলল, কী লিখলো, আল্লামা শাহ আহমদ শফীকে নিয়ে কোথায় কোন পোস্টে কী হয়ে গেলে- এসব খোঁজাখুঁজিতে সময় নষ্ট না করে, নিজেদের পথ বিনির্মাণে কাজ করতে হবে। প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে হবে বিনির্মাণের। আর না হয় শাপলা-বিপর্যয়ের চেয়ে বড় অঘটনের অপেক্ষা করতে হবে। প্রিয় কওমি, তোমার ভবিতব্য ভালো হোক।
কওমি স্বীকৃতি: বিকৃতি ও রাজনীতি