আবদুল্লাহ তামিম: ইরাকের নাজাফ শহরে এক আশ্চর্য কিতাবপাড়া রয়েছে, যার হাত ধরে ইসলাম চর্চার কেন্দ্রবিন্দু এই শহরটি আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে বিভিন্ন সাহিত্য আলোচনারও প্রাণকেন্দ্র৷
নাজাফের পুরোনো পাড়া, হাভিশ মার্কেটের ভেতর একটি বইয়ের দোকান৷ বইয়ের তাকে একদিকে রাখা কবিতা, দর্শন, অর্থনীতির বিভিন্ন বই৷ আর ঠিক পাশের তাকেই রাখা পবিত্র কুরাআনসহ অন্যান্য ধর্মতত্ত্বের একগুচ্ছ বই৷
তিন বছর আগে বাংলাদেশ ছেড়ে নাজাফে পড়তে আসা ছাত্র, মুহাম্মদ আলি রেদার মতো অনেক ছাত্রেরই এই দোকানে নিয়মিত যাতায়াত৷ যারা মহানবি মুহাম্মদের বংশধর, তাদের গায়ে থাকে কালো ও ধর্মীয় শিক্ষার্থীদের গায়ে থাকে সাদা পোশাক৷
সাদা পোশাক ও স্কার্ফ পরিহিত রেদা এখনো তার ধর্মশিক্ষার প্রাথমিকস্তরে আছেন বলে তার ইরানি, পাকিস্তানি এবং তুর্কি সহপাঠীদের মতোই ভাঙা ভাঙা আরবি ভাষায় কথা বলেন৷
হাদিসের নানান কিতাব থেকে শুরু করে তাফসিরের সব কিতাব পাওয়া যায় সেখানে। সেই সঙ্গে বিশ্বের বড় বড় কবিদের কিতাব ও কবিতার বইও পাওয়া যায়। আরবি কবিদের কাব্য কবিতার খুঁজে মানুষ সেখানে ছুটে যায়।
এই মুহূর্তে আমাদের আরবি, আইন ও ইসলামি নীতিতে পাঠ দেওয়া হচ্ছে,’ বলে তিনি জানান৷ যদিও ইরাকের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শিয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত, বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশে খুবই কম সংখ্যক মানুষ শিয়া মতানুসারী৷
সাবেক শিক্ষার্থী ও বর্তমানে শিক্ষক, মুহাম্মদ মুস্তাফা জামাল আল-দীনেরও এ অঞ্চলে বহুদিন ধরে যাতায়াত৷তার মতে, ৭৫০ বছরের এই ঐতিহ্যবাহী বাজার নাজাফের ভেতর যেন একটি স্বতন্ত্র শহর গড়ে তুলেছে৷
বাগদাদ থেকে ১৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই শহর প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ শিয়া তীর্থযাত্রীদের স্বাগত জানায়৷ এই তীর্থযাত্রীরা মূলত আসেন নবী মোহাম্মদের জামাতা, ইমাম আলী ও অন্যান্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের সমাধি দেখার জন্য৷
ধর্মের সাথে কাব্যচর্চার কোনো বিরোধ না দেখা জামাল আল-দীন বলেন, নাজাফের ধর্ম বিষয়ক শিক্ষার্থীদের ভিড়ে কবিতাপ্রেমীদেরও খুঁজে পাওয়া যায়৷
ধর্মতত্ত্বের জ্ঞানের পাশাপাশি সাহিত্য বিষয়ে আকর্ষণ থাকতেই পারে৷ এই দুইয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই৷ প্রথমদিকে ধর্ম নিয়ে লিখলেও পরবর্তীতে উগ্র জাতীয়তাবাদের দিকে আকৃষ্ট হওয়া প্রখ্যাত কবি মুহাম্মদ মাহদি আল জাওয়াহিরিকেও ১৯২০-র দশকে নাজফের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেতো৷
জাওয়াহিরির মৃত্যুর একুশ বছর পর, তার লেখাসমূহ পাওয়া যায় এই বইপাড়ার আনাচে কানাচে৷ ‘ইসলামী অর্থনীতি– মার্কসবাদী না পুঁজিবাদী?’ শিরোনামের বইয়ের সাথে শান্তিতে সহাবস্থান করে এই কিংবদন্তি লেখকের ব্যতিক্রমধর্মী কবিতাগুচ্ছ৷
জাওয়াহিরি ছাড়াও এই শহরের আরো অনেক প্রাক্তন ছাত্র পরবর্তীতে স্বক্ষেত্রে বিখ্যাত হয়েছেন, যেমন আয়াতোল্লাহ আলী সিস্তানি, ইরাকের শিয়া সম্প্রদায়ের নেতা ও বিশিষ্ট ধর্মতাত্ত্বিক মোহাম্মদ বকর সাদরের মতো ব্যক্তিত্বরা৷
ইসলামি সভ্যতার ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ, হাসান আল হাকিমের মতে, ১৯৫০-এর দশক পর্যন্ত নজফের পুরোনো বইয়ের দোকানে শিক্ষার্থীদের সাপ্তাহিক বৈঠক হতো৷
ছাত্ররা প্রতি শুক্রবার আলী রা. এর সমাধির কাছে জড়ো হয়ে বিভিন্ন বইয়ের মূল সংস্করণ নিলামে বিক্রি করত, বলে জানান কুফা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক, যিনি ইতিমধ্যে নাজাফের জন্য একটি ঐতিহ্য সমিতি প্রতিষ্ঠা করেছেন৷
বিশ শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক গের্ট্রুড বেল নাজাফের এই ভিনধর্মী বই বাজার পরিদর্শন করেন৷
হাসান আল হাকিম মনে করেন, অনলাইন বাজারের প্রচলনের মাধ্যমে নাজফের এই বিকল্প ধারাকে থামিয়ে দেওয়া অন্যায় হবে৷
তিনি আরো বলেন, আমরা আমাদের ছাত্রদের কাছে প্রাথমিক উৎস হিসাবে বইকেই তুলে ধরতে চাই৷ একটি বইয়ের সন্ধান করতে গিয়েই তো আরো নানা বিষয়ে আগ্রহ জন্মায়, যা অত্যন্ত আবশ্যক৷
বর্তমান দুনিয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে নাজাফের এই ঐতিহাসিক বাজার কতদিন টিকে থাকতে পারে, সময়ই তা বলতে পারে৷
সূত্র: ডিডাব্লিউ
আরও পড়ুন-
একজন বক্তার কেমন হওয়া উচিৎ?
পূজায় সোশ্যাল মিডিয়াতে উস্কানিমূলক পোস্ট করলেই কঠোরভাবে দমন