আবদুল্লাহ তামিম
আওয়ার ইসলাম
বাংলাদেশের সড়ক মানেই যেন এখন মৃত্যুর ফাঁদ। প্রতিদিন সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। কোনো প্রতিকার নেই। নেই কারো মাথা ব্যথা। এগুলো নিয়ে আইন থাকলেও সেটি ফঁসকাতে দেরি হয় না। যে কারণে থামছে না এ মৃত্যুর মিছি।
একটি দুর্ঘটনায় সারা জীবনের কান্না হয়েই থাকছে। সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পরে প্রাণে বাঁচলেও অনেককেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। একের পর এক চলতে থাকা এসব সড়ক দুর্ঘটনা থেকে যেন কোন নিস্তার নেই। সড়কে প্রাণ দেয়াটাই যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ মানুষের।
বছরের পর বছর ধরে সড়কে চলে আসা এসব দুর্ঘটনার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। শুধু মৃত্যুর পরিসংখ্যানটাই বাড়ছে। ‘আজ রাজিবের হাত তো কাল রোজিনার পা। এখানে স্কুলছাত্র তো ওখানে কর্মজীবী।
এ মৃত্যুর মিছিল কি চলতেই থাকবে? কীভাবে থামবে এ মিছিল? আর কত দেখতে হবে মৃত্যুর মিছিল, কিংবা বরগুনার শিশু সুমির হাতের বিচ্ছিন্ন কব্জি অথবা ঢাকায় চালক রাসেলের বিচ্ছিন্ন পা।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দীর্ঘাদিন মাঠে কাজ করছে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)। এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। নিরাপদ সড়ক ও দুর্ঘটনারোধে দীর্ঘ বছর ধরেই সরব তিনি।
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হবে কীভাবে এ বিষয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ড্রাইভারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
ড্রাইভাররা যদি ঠিক না হয় তাহলে কোনো লাভ হচ্ছে না। তাই এ মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে ২০১০ সাল থেকে ড্রাইভারদের কাছে গিয়ে টার্মিনালে বা বিভিন্ন জেলায় গিয়ে গিয়ে একদিন বা দুই দিনের মোটিভেশনাল ট্রেনিং শুরু করি আমরা।
শিক্ষিত ড্রাইভার তৈরি করার জন্য আমরা ‘নিসচা ড্রাইভিং ইনস্টিটিউশন’ থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়ারও ব্যবস্থা করছি। যেখানে গরিব অন্তত এসএসসি পাশ করা মানুষদের বিনা পয়সায় প্রশিক্ষণ এবং লাইসেন্সের টাকা আমরা দিচ্ছি। এভাবে এ পর্যন্ত ৫০০ ড্রাইভার আমরা তৈরি করেছি।
সম্প্রতি যেসব দুর্ঘটনা ঘটেছে, একে অপরের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে পথচারীকে একে কিভাবে দেখছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা দুর্ঘটনা নয় এটা হত্যাকাণ্ড। ইদানিং এই ধরনের ঘটনাগুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে। বড় ধরনের শাস্তি ছাড়া এসব দূর করা সম্ভব নয়।
ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, আমরা ৩ তারিখ প্রেসক্লাবে মানববন্ধনের ডাক দিয়েছি। ছাত্ররাও যেনো আমাদের মানববন্ধনে একত্রিত হয়। এখান থেকে আমরা অবৈধ চালকদের প্রতিরোধের ডাক দেবো।
তাহলে আশা করা যায় সরকার ফিটনেসহীন গাড়ি, সার্টিফিকেটবিহীন চালক আর লাইসেন্স ছাড়া গাড়ির দৌড়াত্ব কমবে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা যায় কীভাবে? এ বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ ন্যাশনাল মুভমেন্টের প্রেসিডেন্ট দেশ চিন্তক কবি মুহিব খান-এর সঙ্গে।
তিনি বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা এখন বাংলাদেশের মহামারী আকার ধারণ করেছে।
সর্বপ্রথম এর থেকে উত্তরণে সরকারের স্বদিচ্ছাই যতেষ্ট। বাংলাদেশ সরকার যদি চায় তাহলে এটি রোধ করা কোনো কঠিন বিষয় না।
মূলত সড়ক দুর্ঘনাটা জ্যামের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জ্যামের কারণে সময় নষ্ট হয়। আর চালকরা সে সময় বাঁচাতে প্রতিযোগিতায় নামে যার কারণে প্রাণ যায় মানুষের।
এ সমস্যাটা দূর করতে সময় লাগলেও সরকারের জন্য অসম্ভব নয়। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে দেশের প্রাইভেট গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। প্রাইভেট গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করলে আশা করা যায় দুর্ঘটনা অনেক কমে যাবে। কারণ অনেক উন্নত রাষ্ট্রেও বাংলাদেশের মত প্রাইভেট গাড়ি নেই।
দ্বিতীয়ত ফিটবিহীন যত গাড়ি আছে সব মেরামতের সুযোগ বা সময় দিতে হবে। নয় তো বাতিল ঘোষণা করতে হবে। আর লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি ও চালককে কোনোভাবে ছাড় দেয়া যাবে না।
উন্নত রাষ্ট্রগুলোর মত পাবলিক পরিবহনগুলো উন্নত করতে হবে। জ্যামবিহীন নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করলে প্রাইভেটগাড়ি চলাচল সমস্যা হবে না আশা করি।
আইনে আছে চালককে অস্টমশ্রেণি পাশ হতে হবে, একজন চালকের জন্য এটি যথেষ্ট কিনা জানতে চাইলেতিনি আওয়ার ইসলামকে বলেন, চালকরে লেখাপড়া কোনো বিষয় না। আমাদের খেলোয়ারদের যেমন খেলতে গেলে লেখাপড়ার লাগে না তেমনই চালকের এতটুকু যোগ্যতাই দরকার, সে ট্রাফিক আইন আর সিগনাল বুঝে কি না।
তার ড্রাইভিং দক্ষতা এখানে মূল বিষয়। প্রশিক্ষিত ড্রাইভার ছাড়া রাস্তায় নামার জরিমানায় কঠোরতা হলে এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
সরকার সতর্ক হলে সময় লাগলেও নিরাপদ সড়ক সম্ভব এবং মৃত্যুর মিছিল থামানোও সম্ভব হবে বলে মনে করি আমি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দেয়া তথ্য অনুযায়ী গত চার মাসে ১ হাজার ৮৭১টি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২ হাজার ১২৩ জন এবং আহত ব্যক্তির সংখ্যা ৫ হাজার ৫৫৮।
২০১৭ সালের তুলনায় এই চার মাসে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১.০৬ শতাংশ, নিহতের সংখ্যা বেড়েছে ১.৪৪ শতাংশ এবং আহতের সংখ্যা বেড়েছে ৮.৩১ শতাংশ।
সংগঠনটির দেয়া তথ্য অনুযায়ী দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৩১ লাখ হলেও অনিবন্ধিত ও ভুয়া নামধারী যানবাহনের সংখ্যা ৫০ লাখ ছাড়িয়েছে। যার ৭২ শতাংশ ফিটনেসের অযোগ্য।
২০১৫-এর তুলনায় ২০১৬ সালে ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছিল ১৮৩ শতাংশ। এর আগে ২০১৫ সালেও পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছিল। ২০১৭ সালে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৩ হাজার ১৩১টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ হাজার ৩৯৭ জন।
২০১৮ সালে চার মাসেই নিতহ হয়েছে ২ হাজার ১২৩ জন। আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৫৫৮। সরকার এ ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি না দিলে দেশের মানুষের দুর্ভোগের আর কমতি হবে না। বন্ধও হবে না এ মৃত্যুর মিছিল।
‘তোমাদের সব দাবি মানা হয়েছে, এবার রাস্তা ছেড়ে দাও’
-আরআর