আতাউর রহমান খসরু
আওয়ার ইসলাম
সারাদেশে একযোগে চলছে কওমি মাদরাসাসমূহের বার্ষিক পরীক্ষা। বোর্ডভূক্ত ও বোর্ডের বাইরে থাকা সব শ্রেণির পরীক্ষা শেষ হবে এ সপ্তাহেই। এরপর দীর্ঘ আড়াই মাসের ছুটি। রমজানের পরবর্তী সপ্তাহে শুরু হবে নতুন শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম। সে হিসেবে প্রায় ৩ মাসই ছুটির আওতায় চলে যায়।
কওমি মাদরাসার প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ১৫ শাবান তথা শবে বরাতের পূর্বেই বার্ষিক পরীক্ষাসহ চলতি শিক্ষাবর্ষের সব কার্যক্রম শেষ হয়। আর শুরু হয় শাওয়ালের প্রথম সপ্তাহে।
স্বাভাবিক অবস্থায় বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এমন দীর্ঘ ছুটি থাকে না। তাহলে কওমি মাদরাসায় কেনো? এমন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
তারা মনে করেন, এতো দীর্ঘ বিরতি শিক্ষায় কমতি আনছে। পাশাপাশি দীর্ঘ ছুটিতে শিক্ষার্থীদের ভিন্ন পথে হাঁটার সুযোগ তৈরি হতে পারে।
আবার রমজানকেন্দ্রিক দীর্ঘ ছুটিতে বিভিন্ন কোর্স ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করতেও দেখা যায় কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে।
শুরুতে তা নাহু-সফরে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে সাহিত্য-সাংবাদিকতা থেকে শুরু করে ইংরেজি ভাষা কোর্স পর্যন্ত।
দীর্ঘ সময়কে কাজে লাগাতে কওমি শিক্ষার্থীদের অনেকেই এসব কোর্সে ভর্তি হন। কোর্স থেকে দু’ধরনেরই প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় তাদের থেকে।
কেউ কেউ বিষয়গুলো সম্পর্কে মৌলিক ধারণা পেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। আবার কেউ কেউ ব্যানার সর্বস্ব বাণিজ্যিক কোর্সে ভর্তি হয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন।
কেনো পবিত্র মাস রমজানকেন্দ্রিক কোর্সগুলো বাণিজ্যিক হয়ে উঠছে? প্রশিক্ষণার্থীদের প্রত্যাশা-প্রাপ্তির মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে প্রতিনিয়ত?
বেফাকের সহ-সভাপতি ও সিলেট গহরপুর মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজুর কাছে জানতে চেয়েছিলাম কেনো এই দীর্ঘ ছুটি?
তিনি বলেন, সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটানা ২ মাস ছুটি না থাকলেও গ্রীষ্মের ছুটি, শীতের ছুটি, পূজা ও ঈদের ছুটিসহ বিভিন্ন ধরনের ছুটি রয়েছে। যা হিসেব করলে ২ মাসের বেশি হবে। কওমি মাদরাসা এই ছুটিগুলো রমজানে এক সাথে কাটায়।
কেনো একসাথে কাটায়? আমি বলবো, সেটা রমজানের জন্য। রমজান মাসে সারা দেশের মসজিদে মসজিদে কুরআনের যে খতম হয় তা তো কওমি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাই বেশি করেন। এটা জাতির জন্য তাদের অনেক বড় একটি সেবা।
তিনি আরও বলেন, যেসব হাফেজ তারাবি পড়ান তারা কিন্তু সব মিলিয়ে ১৫ দিনও ছুটি পান না। মাদরাসা বন্ধের পর বাড়ি যান। এক সপ্তাহ না থেকেই তারাবির মসজিদে হাজির হন। এরপর রমজানের ২৭ বা ২৮ তারিখ বাড়ি ফেরেন। ঈদের ৪-৫ দিন পর মাদরাসায় চলে আসেন। তাহলে ছুটি দীর্ঘ হলো কোথায়? ছুটি দীর্ঘ দেখা গেলেও আসলে দীর্ঘ নয়।
যারা হাফেজ না এমন শিক্ষার্থীদের বিষয়টি উত্থাপন করলে তিনি বলেন, ‘তাদের আমরা বিভিন্ন কোর্সের অন্তর্ভূক্ত করি। এতে তাদের সময়টা জ্ঞানচর্চার ভেতর দিয়ে যায়।’
দেশের অন্যতম দীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার প্রধান মুফতি ও মুহাদ্দিস মুফতি হিফযুর রহমান মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজুর সঙ্গে রমজান মাসে ইবাদতের প্রশিক্ষণের বিষয়টি যুক্ত করেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইলম অর্জন করি আমলের জন্য। আর রমজান মাস আমলের জন্য শ্রেষ্ঠ মাস। এ মাসে ক্লাস ও পড়ালেখা থাকলে ছাত্র-শিক্ষক কেউ ঠিকভাবে আমল করতে পারবেন না।’
মুফতি হিফজুর রহমান দীর্ঘদিন পাকিস্তানে লেখাপড়া করেছেন। সফর করেছেন ভারতও। তিনি বলেন, ভারত ও পাকিস্তানেও একই নিয়মে মাদরাসাগুলোতে ২ মাস বন্ধ থাকে।
দেশের শীর্ষ এ আলেমের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তিনি ছাত্রজীবনে কিভাবে রমজান কাটাতেন?
স্মৃতিচারণ করে মুফতি হিফজুর রহমান বলেন, আমি রমজানের আগে সময়কে কয়েকভাগে ভাগ করে নিতাম। প্রথমভাগে আমি সেসব বিষয়ে তাকরার করতাম যাতে বছরের নিয়মিত ক্লাসের সময় দুর্বলতা থেকে যেতো। কিছু সাথীও আমি তাকরারের জন্য পেয়ে যেতাম। কিছু অংশে এমন বিষয় পাঠ করতাম যা আমার পাঠ্য বিষয়ের পূর্ণতার জন্য প্রয়োজন হতো।
আর শেষভাগে যেয়ে আগামী বছর যেসব কিতাব পড়বো তার ভূমিকাগুলো পড়ে ফেলতাম।
ছাত্রদের রমজানের সময়টাকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যাদের পেছনের বছরের সবকে, বা নাহু-সরফের মতো মূল বিষয়ে দুর্বলতা নেই তাদের আমি পরামর্শ দেবো যেনো আগামী বছরের কিতাবগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয় এবং মুকাদ্দিমা (ভূমিকা) হলেও পড়ে শেষ করে।
আর যাদের মৌলিক বিষয়ে দুর্বলতা রয়েছে তারা যেনো কোনো গ্রহণযোগ্য জায়গায় সে বিষয়ে কোর্স করে নেয়। দীর্ঘদিন কিতাব থেকে দূরে থাকা কোনো আলেমের জন্য উচিৎ নয়।
মুফতি হিফযুর রহমান রমজানকেন্দ্রিক কোর্সগুলোকে ইতিবাচকভাবেই দেখেন। তার মতে এ কোর্সগুলোর কারণে ছাত্ররা তাদের দুর্বলতা কাটানোর সুযোগ পাচ্ছে এবং তাদের মূল্যবান সময় কাজে লাগছে।
কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের সামনে রেখে রমজানকেন্দ্রিক কোর্সগুলো বেশ প্রসার পেয়েছে। এক সময় তা শহর কেন্দ্রিক হলেও এখন গ্রামের মাদরাসাগুলোতেও রমজানে নানানে কোর্সের আয়োজন থাকে। এ ছাত্র উপস্থিতির হারও কম নয়।
বৈচিত্র এসেছে কোর্সের বিষয়েও। এক সময় রমজানে শুধু নাহু-সরফের কোর্সই হতো। কিন্তু এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে, কেরাত, তাফসির, হাতের লেখা, লেখালেখি-সাংবাদিকতা, ইসলামি অর্থনীতি, আরবি ও ইংরেজি ভাষাশিক্ষা কোর্স।
তরুণ আলেম ও লেখক মাওলানা রিদওয়ান সিদ্দিক মনে করেন, সময়ের দাবিতেই কোর্সের বিষয়ে এ বৈচিত্র এসেছে। এখন কওমি তরুণদের চিন্তা ও পেশায় বৈচিত্র আসছে। তাই তাদের শিক্ষা ও আগ্রহের ক্ষেত্রে বৈচিত্র এসেছে।
বাংলাদেশে খণ্ডকালীন ভাষা ও সাহিত্য কোর্সের অন্যতম প্রধান সংগঠক আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম সম্পাদক মুফতি হুমায়ুন আইয়ুব।
তিনি সর্বপ্রথম ২০০৬ বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের ব্যানারে ভাষা ও সাহিত্য কোর্সের যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি নিজে এবং আরও অনেকে এমন আয়োজন করেছেন।
তিনি তার সে অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘হজরত শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. ছিলেন এ দেশে ইসলামি সাহিত্যচর্চা ও সাংবাদিকতার স্বপ্নদ্রষ্টা। তার একজন যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বেফাকের প্রয়াত মহাসচিব মাওলানা আবদুল জব্বার জাহানাবাদীও ভাষা, সাহিত্য ও লেখালেখির ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। বেফাকে কাজ করার সুবাধে আমি বিষয়টি বুঝতে পারি এবং তার সহযোগিতায় ভাষা ও সাহিত্য কোর্সের আয়োজন করি।
আল হামদুলিল্লাহ! এরপর আরও অনেকেই খণ্ডকালীন কোর্স করেছেন। এতে ছাত্রদের আগ্রহ বেড়েছে। এখন দেশের একাধিক মাদরাসায় বছরব্যাপী সাহিত্য ও সাংবাদিকতা কোর্স চালু হয়েছে।
মানুষের বিপুল আগ্রহ ও ভালোবাসা তাকে অন্তহীন অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাই তিনি আজীবন বাংলা ভাষায় ইসলামি সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ধারা তৈরির কাজ করে যাবেন বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
বাণিজ্যিক কোর্সের ব্যাপারে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ভালো পণ্যের প্রতি আগ্রহ বাড়লে বাজারে কিছু ভেজাল পণ্য আসে। গ্রাহকের দায়িত্ব তা যাচাই করে নেয়া।
তবে ব্যানার সর্বস্ব বাণিজ্যিক কোর্সের পরিমাণও খুব সামান্য বলেই তিনি মন্তব্য করেন।
গতকালের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট
ইরাক যুদ্ধের পনেরো বছর; প্রতিশ্রুতি বনাম প্রাপ্তি
মুন্সিগঞ্জের এক খতমে বুখারি অনুষ্ঠানের ছবি নিয়ে সরগরম ফেসবুক
সৌদির সিনেমা নিয়ে উল্লসিত মিশর, কিন্তু কেন?
এখন মানুষ বুঝতে পারে না রাজনীতির চাকাটা কোন দিকে ঘুরবে: জিএম কাদের