সৈয়দ ফয়জুল আল আমীন
ভারতের আসানসোল উভয় বাংলায় অতি পরিচিত এক নাম। কারণ, এটি ‘দুখু মিয়া’ খ্যাত আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মস্থান।
আমরা কম-বেশি জানি, কাজী নজরুলের বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। অবশ্য নজরুলও গ্রামের স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করতেন। তো এই আসানসোলেরই আরেক ইমাম সম্প্রতি এক কালজয়ী ভূমিকা পালন করে তুমুল সাড়া জাগিয়েছেন বিশ্বব্যাপী।
এই তো সেদিনের ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে রামনবমীর উৎসবে এমন এক কাণ্ড ঘটে গেল এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে যে ধরনের সংঘাত ভারতে আবার ছড়িয়ে পড়ার আশংকা ছিল তা থেকে মুক্তি দিয়েছেন ইমাম মাওলানা ইমদাদুল হক রাশিদি।
তিনি বলেছেন, তার ছেলের হত্যার জন্য কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতাকে মেনে নিবেন না। যদি এর জন্য কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতার সূচনা হয় তবে তিনি আসানসোল ত্যাগ করবেন।
অনেকে মনে করেছিলেন, এই নৃশংসতার পর সেখানে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা অনিবার্য হয়ে পড়বে। তাছাড়া এমন বক্তব্য একজন সদ্য সন্তানহারা সংখ্যালঘুর জবান থেকে কেউ আশা করে নি। কারণ, এমন উদার চিন্তা যে কোনো সম্প্রদায়ের উঁচু আসনে বসা নেতার কাছ থেকেও ভারত কখনো দেখেনি।
ইতিমধ্যে ঘটনাটি সবার জানা হয়ে গেলেও চুম্বকাংশ অবতারণা করা যাক।
আসানসোলের যে অঞ্চলে গত ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় দাঙ্গা শুরু হয়েছিল, সেই চাঁদমারি আর কুরেশি মহল্লা পেরিয়ে অনেকটা ভেতরে নুরানি মসজিদ। ২৯ মার্চ খবর এলো, স্থানীয় হাসপাতালে মসজিদের ইমাম ইমদাদুল হক রাশিদির নিখোঁজ ছেলের লাশ পড়ে আছে। তাকে বলা হলো হাসপাতালে গিয়ে লাশ শনাক্ত করতে।
আসানসোলের পরিস্থিতি তখনও হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের জের ধরে থমথমে। সবকিছু বন্ধ। চারিদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে নানা গুজব। ইমাম রাশিদি হাসপাতালে গেলেন। শনাক্ত করলেন নিজের ছেলের ক্ষতবিক্ষত লাশ।
নখ উপড়ে নেওয়া হয়েছে। ঘাড়ে ধারালো অস্ত্রের কোপ। লাশটি আধপোড়া। মনে হচ্ছে পুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। ক্ষতবিক্ষত লাশটি যখন মহল্লায় আনা হলো, পরিস্থিতি হয়ে ওঠল আরও অগ্নিগর্ভ।
কিশোর ছেলের লাশ ঈদগাহ ময়দানে রাখা হয়েছে জানাজার জন্য। ইমামতি করবেন বাবা ইমদাদুল হক রাশিদি। জানাজায় অংশ নিতে ঢল নেমেছে মুসল্লিদের। উপস্থিত সবাই ক্ষুব্ধ, মর্মাহত। সবার চোখে প্রতিশোধের আগুন। এমন একটি নিরীহ ছেলেকে কুপিয়ে টুকরা টুকরা করা হয়েছে। এর জবাব দিতেই হবে। নতুবা উগ্রপন্থিদের বাড়াবাড়ির মাত্রা আরও বেড়ে যাবে।
বিস্ফোরণের অপেক্ষায় থাকা মুসল্লিরা আগে জানাজা শেষ করতে চাইলেন। কিন্তু সকল আশঙ্কা অমূলক করে দিয়েছেন, একজন আলেম ও মসজিদের ইমাম মাওলানা রাশিদি।
নিহত সন্তানের লাশ সামনে রেখে হাজার হাজার উত্তেজিত মুসলামানদের সামনে তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ আমার সন্তানের যতদিন আয়ু রেখেছিলেন, ততদিন সে বেঁচেছে। আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাঁকে যারা হত্যা করেছে মহান আল্লাহ তা’য়ালা কেয়ামতের ময়দানে তাদেরকে শাস্তি দেবেন।’
এরপর তিনি সমেবেত সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমার সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকার আপনাদের কারও নেই। আমার সন্তানের মৃতুর জন্য একটি মানুষের উপর আক্রমণ করা চলবে না। একটি মানুষকেও হত্যা করা যাবে না।
বাড়ি, ঘর, দোকান-পাট কোথাও ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ বা লুটপাট করা চলবে না।’... ইসলাম আমাদের কোনো নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে শেখায় না। ইসলাম আমাদের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রেখে বসবাস করতে শেখায়। আমাদের আসানসোলে আজ শান্তি-শৃঙ্খলা প্রয়োজন। আপনারা যদি আমায় আপন মনে করেন, তাহলে ইসলাম নির্দেশিত শান্তি বজায় রাখবেন। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব আপনাদের।’
মাওলানা রাশিদির পুত্র সিবতুল্লাহার জানাজায় ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ ছিল। রাশিদির বক্তব্যের আগে জানাযায় উপস্থিত সবার চোখেমুখে ছিল প্রতিশোধ গ্রহণের আগুন। সবার ধারণা ছিল ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রক্তাক্ত হতে যাচ্ছে আসানসোল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী ও প্রশাসন এই ভয়ংকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারবে কি না তা নিয়ে ছিল শঙ্কা। কিন্তু সকল আশঙ্কা, সকল উত্তেজনা মাওলানা ইমদুল্লাহর দেওয়া বক্তৃতায় শেষ হয়ে যায়।
একটি বক্তৃতায় আগুনে জল ঢেলে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে গেল। হাজার হাজার জনতার বিক্ষুব্ধ মন শান্ত হয়ে পড়ল। জানাযা শেষে সবাই নিজ নিজ বাড়ি ফিরে গেল। ইমাম রাশিদি ফিরে গেলেন তাঁর মসজিদে। যখন আল্লাহর ঘরে উচ্চারিত হচ্ছিল নামাজের জন্য আযানের ধ্বনি।
আরও পড়ুন: ‘কুরআনে হাফেজদের রক্তে ভেসে যাচ্ছিল মেঝে’
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও ভাষাতাত্তি¡ক অধ্যাপক শেলডন পোলক বলেছেন, মুসলমান শাসকরা জোর করে ধর্মান্তর করালে ভারতে একজনও হিন্দু থাকত না। কারণ মুসলমান শাসকরা ভারতে প্রায় বারোশো বছর রাজত্ব করেছিলেন। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৯ মার্চ ২০১৭)
আসানসোলের মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারিসহ স্থানীয় প্রশাসন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন ইমাম ইমদাদুল রাশিদির। জিতেন্দ্র বলেন, ‘ইমাম সাহেবের বক্তব্যই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মূল ভূমিকা রেখেছে। আমরা তাকে নিয়ে গর্বিত। নিজের সন্তানকে এভাবে হারিয়েও তিনি শান্তি বজায় রাখতে মানুষের কাছে অনুরোধ করেছেন।’
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে কাউন্সিলর নাসিম আনসারি বলেন, ‘সন্তানহারা এক বাবার কাছ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এমনটি আমরা আশাই করিনি। এটি শুধু পশ্চিমবঙ্গের জন্য নয়, পুরো ভারতের জন্যই একটা দৃষ্টান্ত। আমি জানাজায় ছিলাম। নিহতের লাশ পাওয়ার পর যুবকরা ক্ষুব্ধ ছিল। তার বক্তব্যের সময় লোকজন কাঁদতে থাকে। আমি হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম।
তিনি যদি শান্তির জন্য অনুরোধ না করতেন, তাহলে আসানসোলে আগুন জ্বলত। আর তা যে ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়ত না, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।’
ইমাম রাশিদির প্রশংসা কওে ভারতের কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী টুইটারে লিখেছেন, ‘সাম্প্রদায়িক ঘৃণায় সন্তান হারানোর পরও ইমাম রাশিদির বার্তা প্রমাণ করে, ভারতে এমন ভালোবাসাই দূর করতে পারে ঘৃণা।’
দক্ষিণি অভিনেতা প্রকাশ রাজ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে বলেন, ‘সংস্কৃতি শিখতে হলে ওই ইমামের কাছ থেকে শিখুন, যিনি নিজের ছেলেকে হারানোর পরও শান্তি রক্ষার আবেদন জানাচ্ছেন।’
ইমাম রাশিদিকে ভারতরত্ন দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন ভারতীয় বাংলা গানের জনপ্রিয় গায়ক কবীর সুমন। গত ৩১ মার্চ নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এমন দাবি করেন এই নন্দিত গায়ক।
এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন তোলাই যেতে পারে- ভারত কি এবার তার বিগত সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস ভুলে নতুন করে অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা গ্রহণ করবে ইমামের কাছ থেকে? কারণ, ইমাম সাম্প্রদায়িকতা ঠেকাতে যে ধরনের মনোবৃত্তির পরিচয় দিয়েছেন তা অবশ্যই একটি রোল মডেল ভারতের জন্য।
অবশ্য ইমাম রাশিদির এমন বার্তাকে আমরা নতুন বা বিচ্ছিন্ন বলে দেখতে পারি না। কারণ, ইসলামের শিক্ষা যে এমনই। প্রিয় নবিজির সা. আদর্শ- প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা করা। আর সেটাই প্রকৃত ক্ষমা।
আরও পড়ুন: ইমাম ইমদাদুল্লাহ নিয়ে সঙ্গীত গাইলেন কবীর সুমন (ভিডিও)
প্রিয় রাসুল সা. এবং সাহাবায়ে কেরামদের জীবনে এমন অসংখ্য ঘটনা ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে।
মা আয়েশা রা. বলেন, ‘প্রিয়নবি সা. কখনও নিজের ব্যাপারে কারও প্রতি প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। আল্লাহর দ্বীন ও বিধানের অবমাননা হলে সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতেন।’
ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের দিন শর্তহীন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে প্রিয় নবি সা. বলেছিলেন, ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোনো প্রতিশোধ নেই, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন।’
ধর্মের নামে, তথাকথিত জেহাদের নামে ধর্মান্ধ যে শক্তি বিশ্ব রাজনীতিকে অশান্ত করেছে তাদের কাছে ইমাম রাশিদির কণ্ঠে উচ্চারিত ইসলামের বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে।
এই বার্তা আজ শুধু আসানসোলের কট্টর ধর্মান্ধ, উগ্রপন্থী হিন্দুত্ববাদের খুনীদের জন্যই নয়, ধর্মের নামে শান্তির পৃথিবীকে যারা অশান্ত করে তুলেছেন, তাদের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার এক ঐতিহাসিক আদর্শিক বার্তা। যে বার্তা আজকের পৃথিবীতে মহান আদর্শ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
লেখক : কবি, গবেষক ও সাংবাদিক
সহযোগী সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম
০৪ এপ্রিল ২০১৮