রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সাম্যের ভিত্তিতে সংবিধান রচনার আহ্বান নেপালে ফের কুরআন প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে সৌদি আগামীকাল সংবিধান সংস্কার কমিশনে প্রস্তাবনা পেশ করবে ইসলামী আন্দোলন ‘আল্লামা আতহার আলী রহ. জীবন, কর্ম, অবদান’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন আগামীকাল হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. : কে এই মহান ব্যক্তি হাজিদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ : ধর্ম উপদেষ্টা মহানবীকে সা. নিয়ে কটূক্তি করলে সংবিধানে শাস্তির বিধান রাখার প্রস্তাব পার্থের নতুন নির্বাচন কমিশন প্রত্যাখ্যান জাতীয় নাগরিক কমিটির ফুলপুরে জমিয়তের কমিটি গঠন স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে চাই: সিইসি নাসির উদ্দীন

অসহিষ্ণু ভারতে শুভবোধের আজান

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

ফারুক ফেরদৌস
আওয়ার ইসলাম

 ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবরে শিখ দেহরক্ষীদের হাতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি খুন হওয়ার পর এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতে শিখ বিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়।

দিল্লিতে শিখ সম্প্রদায়ের প্রায় ২০০০ মানুষ মারা যায়। সেই সময় ইন্দিরার ছেলে প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধি একটি জনসভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে দাঙ্গার পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেছিলেন, ‘বড় গাছ পড়লে মাটি কাঁপে।’ অর্থাৎ এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।

দু’জন শিখ ইন্দিরা গান্ধীকে মেরেছে, তাই হাজারে হাজারে শিখ মারা যেতেই পারে। বড় গাছের পতনে বড় প্রতিক্রিয়া হবেই। প্রধানমন্ত্রীর মতো দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকেও রাজিব গান্ধির এমন বক্তব্যই আমাদের সামনে স্পষ্ট করে তোলে ভারতের পরিস্থিতি।

ভারত দাঙ্গার দেশ। মামুলি কথা কাটাকাটি থেকেও দাঙ্গা বেঁধে যায় ভারতে। প্রতিবেশীর ছাগল আর পান-চুনের মতো ব্যাপার থেকে আগুন জ্বলে ওঠে খুব সহজেই। একজনের অপরাধ অথবা পরিকল্পিত কোনো ঘটনার দায় কোটি কোটি মানুষের ওপর চাপিয়ে হাজার হাজার মানুষকে মেরে ফেলা হয়। গত প্রায় একশ’ বছর ধরে এরকমই ঘটে আসছে ভারতে।

ট্রেনে বোমা পড়েছে, কে ফেলেছে কেউ জানে না। তাৎক্ষণিকভাবে কয়েক কোটি মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করে ফেলা হলো, কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করা হলো, মিটে গেলো। অপরাধী কি সাজা পেলো? সেটা নিয়ে খুব বেশি মাথা ব্যথা নেই মানুষের।

কারো মনে প্রশ্ন জাগে না, ঘরের ভেতর যে বৃদ্ধ লোকটি, যে নারী, যে শিশুটি ঘুমিয়েছিলো, তার অপরাধ কী? ওই ঘটনার বিন্দু বিসর্গও তো জানে না সে! তাহলে সে কেনো মারা পড়বে? সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে সব শুভবোধ ও মনুষত্ব হারিয়ে যেন পশু হয়ে যায় ভারতের মানুষ।

ভারতের পরিস্থিতির এই অসহিষ্ণু, বর্বর রূপ সামনে রেখে আসানসোলের ইমাম মাওলানা ইমদাদুল্লাহ রাশিদির ভূমিকা দেখুন! মাত্র একদিন আগে তার কিশোর ছেলে হাফেজ সিবগাতুল্লাহকে মেরে ফেলেছিলো উগ্র হিন্দুরা। শুধু হত্যা করেই তাদের জিঘাংসা শেষ হয় নি। তারা ছেলেটির লাশ টুকরো টুকরো করে কেটেছে। বুকের ভেতর থেকে কলজে বের করেছে। তারপর লাশটিকে আগুনেও পুড়িয়েছে।

আসানসোলের সেই ইমামকে ‘ভারতরত্ন’ দেয়ার দাবি কবীর সুমনের

স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনাটি চরমভাবে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিলো আসানসোলের মুসলমান সমাজকে। সিবগাতুল্লাহর জানাজায় ঈদগাহ ছিলো কানায় কানায় পূর্ণ। সাধারণ কোনো জানাজায় এত মুসল্লি আসেন না।

সেদিন অঘোষিতভাবেই পুরো আসানসোলে কর্মবিরতি চলছিলো। বোবা কান্না নিয়ে মানুষ জড়ো হয়েছিলো ঈদগাহে।মনে হচ্ছিলো, জানাজার পরপরই ফেটে পড়বে বিক্ষু্ব্ধ জনতা।

কিন্তু পুত্রশোকে কাতর ইমাম, মাতৃশোকে কাতর প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধীর মতো ভুল করলেন না। ভুলে গেলেন না, তিনি ইমাম; তার সামান্য ভুলে এই জমাট বারুদে সামান্য আগুনের পরশেই ঘটে যাবে অশুভ অনেক কিছু। তিনি ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্তটিই নিলেন।

তার কণ্ঠে ভারতের আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হলো ইসলামের ন্যায়, ইনসাফ ও শুভবোধের আজান।

জানাজা পড়ানোর আগ মুহূর্তে মুসল্লিদের লক্ষ্য করে তিনি বললেন, ‘গত ৩০ বছর ধরে আমি আপনাদের ইমামের দায়িত্ব পালন করছি। আমার জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, আমি মানুষের কাছে ইসলামের সঠিক বার্তা পৌঁছাবো, শান্তির বার্তা পৌঁছাবো। আমি যা হারিয়েছি তার কষ্ট থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতে হবে।

আমি শান্তি চাই। আমার ছেলে চলে গেছে। আমি চাই না আর কোনো পরিবার তাদের সন্তানকে হারাক। আমি চাই না আর কোনো ঘরে আগুন জ্বলুক। আমি চাই না আর কারো কোনো ক্ষতি হোক।

আল্লাহ আমার সন্তানের যতদিন আয়ু রেখেছিলেন, ততদিন সে বেঁচেছে। আল্লাহর ইচ্ছায় তার মৃত্যু হয়েছে। তাকে যারা হত্যা করেছে, কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহ্‌ তাদের শাস্তি দেবেন। কিন্তু আমার সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকার আপনাদের কারও নেই।

যদি আপনারা আমাকে ভালোবাসেন, তাহলে কারো প্রতি আঙ্গুল পর্যন্ত তুলবেন না। যা ঘটেছে  তা কেবলই ষড়যন্ত্র ছিলো। আসানসোলের সব মানুষ আসলে এমন নয়। ইসলাম আমাদের নিরীহ কোনও মানুষকে হত্যা করতে শেখায় না। ইসলাম শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রেখে বসবাস করতে শেখায়। আসানসোলে আজ শান্তি ও শৃঙ্খলার প্রয়োজন।

আপনারা যদি আমাকে আপন মনে করেন, তাহলে ইসলাম নির্দেশিত শান্তি বজায় রাখবেন। শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব আপনাদের। আর যদি আপনারা শান্তি বজায় রাখতে না পারেন, তাহলে মনে করব আমি আপনাদের আপন নই। আমি আর এই মসজিদে থাকবো না। চিরতরে আসানসোল ছেড়ে চলে যাব।’

পুত্রহারা বাবার ঘোষণা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ল মানুষ। জানাজা শেষে শোকাকুল জনতা বাড়ি ফিরে গেলো নিরবে। কোনো হিন্দু বাড়িতে একটা ঢিলও পড়লো না।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মাওলানা ইমদাদুল্লাহ রাশিদির ভূমিকার ব্যাপক প্রশংসার পাশাপাশি কিছু নেতিবাচক মন্তব্যও চোখে পড়েছে। বাংলাদেশের কিছু মানুষ ঘটনাটিতে ভারতের মুসলমানদের দুর্বলতা ও অসহায়ত্বের প্রকাশ ছাড়া কিছু দেখতে রাজি নন।

তারা বলছেন, ইসলাম হত্যাকাণ্ডের কিসাসের কথা বলে। এতো বেশি ক্ষমার ঔদার্য দেখানো ইসলামি তরিকা নয়।

তাদের অনেকে হয়তো ঠিক মতো পড়েও দেখেন নি যে, মাওলানা ইমদাদুল্লাহ রাশিদি আসলে কী বলেছেন। মাওলানা সাহেব জানাজায় ওই বক্তব্যটি না দিলে একটা সাম্প্রদায়িক হানাহানি বেঁধে যেতো। ইমদাদুল্লাহ রাশিদির বক্তব্য সেই হানাহানি ঠেকিয়ে দিয়েছে।

একটা সাম্প্রদায়িক হানাহানি, গোটা দশেক হিন্দু বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া অথবা কয়েকজন হিন্দু কিশোরকে হত্যা করা হলে সেটা কি সিবগাতুল্লাহর কিসাস হতো?

প্রকৃত খুনী ও অপরাধী শণাক্ত হওয়ার আগেই বদলা নিয়ে ফেলার এমন প্রবণতা ভারতের হিন্দুদের মধ্যে আছে ঠিকই, কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলোও হতো সিবগাতুল্লাহর হত্যাকাণ্ডের মতোই অন্যায় আরও কিছু হত্যাকাণ্ড।

নিরপরাধ একজন মানুষের হত্যাকাণ্ডও ইসলাম গোটা মানবজাতিকে হত্যার সমতুল্য অপরাধ সাব্যস্ত করে; সেই মানুষ মুসলমান হন অথবা হিন্দু।

কুরআনের আয়াতে এক্ষেত্রে এসেছে ‘নাফস’ শব্দটি; যা কোনোভাবেই কোনো বিশেষ ধর্ম বা জাতি নির্দেশ করে না। মাওলানা ইমদাদুল্লাহ রাশিদি  তার বক্তব্যে ইসলামের এই শিক্ষাটিই তুলে ধরে বলেছেন, ইসলাম আমাদের নিরীহ কোনও মানুষকে হত্যা করতে শেখায় না।

গত কয়েক বছর ধরে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের অসহিষ্ণুতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন রাজ্যে গরু জবাই ও গরুর গোশত খাওয়া, বহন করা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করে আইন করা হয়েছে।

এরপর গরুর গোশত বহন করা বা গুজব ছড়িয়ে মুসলমানদের হত্যার ঘটনা ঘটছে বার বার। বিজেপির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই প্রকাশ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াচ্ছেন। হিন্দুত্ববাদী শিবসেনা ও রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘের দৌরাত্ম্য পরিকল্পিতভাবে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে।

আসাম ও ত্রিপুরাসহ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে মুসলমানদের নাগরিকত্ব নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি করা হচ্ছে। এসবের পেছনে একটি বড় কারণ হলো, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা।

যা ভোটের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন বিজেপির অন্যতম বড় সম্বল। বিজেপির নেতারা ভাবছেন, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পারদ যত ঊর্ধ্বমুখী থাকবে, বিজেপির ভোটও তত বাড়বে। এই প্রেক্ষাপটে আসানসোলের ইমামের কিশোর ছেলের হত্যাকাণ্ডটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

বিজেপি হয়তো ভাবছে, একটি বৃহৎ দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেয়া গেলে সামনের নির্বাচনে পশ্চিম বঙ্গেও ভোটের রাজনীতিতে তারা এগিয়ে যাবে। কিন্তু মাওলানা ইমদাদুল্লাহ রাশিদির ভূমিকা হিন্দুত্ববাদীদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছে। এই ঘৃণ্য ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জেরে শুধু পশ্চিমবঙ্গই নয়, দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়তে পরতো ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও।

ভারতের শুভবোধ সম্পন্ন নাগরিকদের উচিত বিজেপির এসব কূটকৌশল ও নোংরা রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া। তা না হলে বহু ধর্ম, বহু ভাষা ও বহু সংস্কৃতির দেশ ভারতে বিস্তৃত পরিসরে অশান্তির আগুন জ্বলে উঠতে পারে।

সূত্র: https://goo.gl/C9yc9g ২. https://goo.gl/x2c6w4 ৩. https://goo.gl/GWXLkw

আরও পড়ুন: ‘আসানসোলের ইমাম রাশিদির প্রশংসায় পঞ্চমুখ রাহুল’


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ