শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


‘আল্লামা’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে বিভ্রান্তি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আতাউর রহমান খসরু

জ্ঞানী-গুণী ও সম্মানিত মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বিভিন্ন উপাধি ও লকবের ব্যবহার নতুন নয়। উপাধি ব্যক্তির সঠিক পরিচয় জানতে মানুষকে সাহায্য করে। তার প্রকৃত অবস্থান তুলে ধরে।

আল্লাহ তায়ালাও পবিত্র কুরআনে তার নবীদের বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করেছেন। যেমন হজরত ঈসা আ. কে ‘মাসিহ’ উপাধিতে উল্লেখ করেছেন।

রাসুলুল্লাহ সা.ও তার সাহাবি গুণাগুণ বিচার করে নানা উপাধিতে ভূষিত করেছেন। তিনি হজরত আবু উবায়দা আমের ইবনুল জাররাহ রা. কে ‘আমিনু হাজিহিল উম্মাহ’ উপাধি প্রদান করেন।

হজরত সাহাবায়ে কেরাম রা. এর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত এমন বহু উপাধি বিভিন্ন ক্ষেত্রের পুরোধা ব্যক্তিদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে শায়খুল ইসলাম, হুজ্জাতুল ইসলাম, ইমামুল হারামাইন, শায়খুল হিন্দ, মুজাদ্দিদে জামান, ইমাম আজম, শায়খুল হাদিস, শায়খুল কুররা ইত্যাদি।

ইসলামি শরিয়তের বিভিন্ন বিষয়ে পণ্ডিতদের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত আরেকটি উপাধি ‘আল্লামা’। যার অর্থ মহাজ্ঞানী ও পণ্ডিত।

কামুসুল আলকাব গ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘আল্লামা’ মুবালাগার সিগা (যা কোনো দোষ বা গুণের আধিক্য বোঝায়)। সাধারণ জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য এ শব্দ ব্যবহার করা শুদ্ধ নয়। যদি না ব্যক্তির জ্ঞানচর্চায় গভীর পাণ্ডিত্য ও স্বতন্ত্র অবস্থান না থাকে।

আরবে পরিমিত আকারে আল্লামা শব্দের ব্যবহার বহু পূর্বে শুরু হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে এ উপাধিটি প্রথম ও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় ভারতীয় মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা কবি ও দার্শনিক মুহাম্মদ ইকবালের ব্যাপারে। তিনি ভারতবর্ষের প্রথম খ্যাতিমান ‘আল্লামা’।

তার পূর্বে ভারতবর্ষের জগদ্বিখ্যাত আলেমদের নামের সঙ্গেও এতোটা বিস্তৃত পরিসরে আল্লামা ব্যবহার করা হতো না। তাদের নামের সঙ্গে ব্যবহৃত হতো মাওলানা বা মৌলভি। খুব বেশি হলে শায়খুল হাদিস।

কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আল্লামা শব্দের ব্যবহার এখন সবচেয়ে বেশি। আর উপমহাদেশের আলেমদের ভেতর বাংলাদেশেই বোধ করি ‘আল্লামা’ শব্দের অপব্যবহার সবচেয়ে বেশি।

বাংলাদেশের কোনো এক অঞ্চলের ব্যাপারে রসিকজনরা বলে থাকেন, ‘নাহবেমির পাশ করলেও তাকে সেখানে আল্লামা বলা হয়’।

ঠিক নাহবেমির পাশ করা মৌলভি সাহেবরা আল্লামা শব্দ ব্যবহার না করলেও এমন অনেকেই এ উপাধি ব্যবহার করছেন যাদের যোগ্যতার দৌড় তার থেকে খুব বেশি নয়।

বিশুদ্ধভাবে দুই লাইন আরবি পড়ার যোগ্যতা নেই এমন অনেক ব্যক্তিকেও আজকাল নামের সাথে আল্লামা জুড়ে দিতে দেখা যায়।

বিশেষত বক্তা আলেমদের এ শব্দের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা দেখা যায়। বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান বক্তা মাগুড়ার এক মাহফিল থেকে বয়ান না করে শুধু এ জন্য ফিরে যান যে, পোস্টারে তার নামের সাথে আল্লামা লেখা হয় নি।

No automatic alt text available.

এটি সিলেটের একটি মাহফিলের পোস্টার, আটজন আলেমের নাম আছে এতে। বক্তাদের অধিকাংশই নিজেরা নামের শুরুতে শুধু মাওলানা লিখেন কিন্তু এ পোস্টারের আটজনের প্রত্যের নামের আগেই অযাচিতভাবেই ব্যবহার করা হয়েছে আল্লামা শব্দটি। 

ড. শামসুল হক সিদ্দিক। বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী আলেম। তিনি লেখাপড়া ও কর্মজীবনের সূত্রে দীর্ঘদিন আরব দেশে ছিলেন। আরবি ভাষায় বই লিখে আরবদের কাছে তুমুল সমাদার লাভ করেছেন।

তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম ‘আল্লামা’ শব্দের ব্যবহার আরবরা কিভাবে করেন?

তিনি জানান, ‘আল্লামা শব্দের ব্যবহার আরবরা খুব কম করেন। কোনো ব্যক্তি যদি কোনো শাস্ত্রে বিশেষ পাণ্ডিত্য ও সাধারণভাবে তার স্বীকৃতি লাভ করেন তবেই তার ক্ষেত্রে আল্লামা শব্দটি ব্যবহার করা হয়।

যেমন কেউ তাফসিরে পণ্ডিত তাকে বলা হয় আল্লামা ফিত তাফসির।’

‘তবে কারো পাণ্ডিত্য যদি সর্বজন বিধিত না হয় তবে তারা ‘তালিবুল ইলম’ বা জ্ঞানান্বেষী শব্দটি ব্যবহার করেন। এমনকি বিখ্যাত অধ্যাপকরা পর্যন্ত নিজেদের ‘তালিবুল ইলম’ পরিচয় দিতে সাচ্ছ্বন্দবোধ করেন।’

ড. শামসুল হক সিদ্দিক ‘আল্লামা’ শব্দ ব্যবহারে শরিয়তের বিধান তুলে ধরে বলেন, ‘এখানে দুটি শব্দ। এক. আল্লাম, দুই. আল্লামা। আল্লাম শব্দটি আল্লাহ নিজের জন্য ব্যবহার করেছেন। তাই তা কোনো মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা উচিৎ নয়। অনেকে বলেন, হজরাতুল আল্লাম। এটি অনুচিৎ।’

‘আর মানুষের ক্ষেত্রে আল্লামা শব্দটি ব্যবহার করা বৈধ। তবে তা সবার জন্য নয়। আরব রীতি অনুযায়ী কেবল কোনো শাস্ত্রের পণ্ডিতরাই তার নামের সঙ্গে আল্লামা শব্দটি ব্যবহার করতে পারেন। অন্য কেউ নন।

যার নামের সঙ্গে ব্যবহার করা হবে তিনি যে শাস্ত্রে পণ্ডিত তাও সেখানে উল্লেখ করতে হবে। যেমন, আল্লামা ফিন নাহব, আল্লামা ফিত তারিখ ইত্যাদি।’ এমনটাই বললেন ড. শামসুল হক সিদ্দিক।

তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের দেশে আল্লামা শব্দের ব্যবহার অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুলভাবে করা হচ্ছে। প্রথমত এমন অনেকের ক্ষেত্রে এ উপাধি ব্যবহার করা হচ্ছে যারা তার যোগ্য নয়।

আবার যাদের সামান্য যোগ্যতা আছে তাদের নামেও শাস্ত্র উল্লেখ না করেই ‘আল্লামা’ শব্দ জুড়ে দেয়া হচ্ছে। তাহলে কি উনি সব বিষয়ে সমান পারদর্শী? এটা হওয়া সম্ভব?’

ইসলামি কিতাব, বয়ান ও মালফূযাতের অন্যন্য অ্যাপ

তিনি মনে করেন, ‘আল্লামা শব্দের ভুল ব্যবহারে শব্দটি যেমন গুরুত্বহীন হয়ে যাচ্ছে, তেমন যা প্রকৃতই আল্লামা তাদের প্রতি অসম্মান দেখোনো হচ্ছে।’

আল্লামা বা এ জাতীয় অন্যান্য সম্মানসূচক উপাধির ব্যবহারের যে বৈধতা ফকিহগণ দিয়েছেন তা কেবল অন্যদের জন্য। কোনো ব্যক্তির জন্য সাধারণভাবে বৈধ নয় নিজের নামের সঙ্গে প্রসংশাসূচক শব্দ জুড়ে দেয়া।

ফকিহগণ এ ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতকে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করেন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা নিজেরা নিজেদের পবিত্রতা (মাহাত্ম্য) ঘোষণা করো না। আল্লাহই ভালো জানেন কে বেশি খোদাভীরু।’ [সুরা নাজম : ৩২]

আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে নিজের গুণগান করার নিন্দা করে বলেছেন, ‘আপনি তাদের দেখেন না যারা নিজেরা নিজেদের পবিত্রতা (মাহাত্ম্য) ঘোষণা করে। অথচ আল্লাহ যাকে খুশি পবিত্র করেন। আল্লাহ কারো প্রতি সামান্যও অবিচার করেন না।’ [সুরা নিসা : ৪৯]

আল্লামা শব্দ ব্যবহারের অন্যতম কারণ অন্যদের সঙ্গে মনস্তাত্বিক প্রতিযোগিতা। অনেকের ধারণা আল্লামা উপাধি আমার নামে যুক্ত না হলে অমুকের সমকক্ষ হতে পারবো না বা তার চেয়ে ছোট হয়ে যাবো।

হাদিস শরিফে জাগতিক সম্মানের ক্ষেত্রে পারস্পারিক এ প্রতিযোগিতা ও গর্বকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘আল্লাহ আমার কাছে ওহি প্রেরণ করেছেন (নির্দেশ দিয়েছেন) যেনো তোমরা পরস্পর বিনয় প্রকাশ কর। যাতে একে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব কামনা না করে এবং পরস্পরের উপর গর্ব না করে।’ [আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস নং ৯৭]

রাসুলুল্লাহ সা. জাহিলি যুগে রাখা এমন নাম ও উপাধি পাল্টে দিতেন যাতে গর্ব প্রকাশ পায় এবং যাতে আল্লাহর সঙ্গে সাদৃশ্য তৈরি হয়। হাদিসে এসেছে, তিনি আবুল হাকাম, হাকিম ও আজিজ নাম পরিবর্তন করে দিয়েছেন।

কোনো কোনো আল্লামা বলেন, আমি তো আল্লামা লিখি না। অন্যরা ভালোবেসে তা যোগ করে দেন। এমন ক্ষেত্রে শরিয়তের বিধান কি?

শরিয়তের বিধান হলো কোনো ব্যক্তি যখন কারো সামনে তার প্রকাশ্য প্রসংশা করবে, তখন ব্যক্তি তাকে থামিয়ে দিবেন। নিষেধ করবেন প্রসংশা করতে।

হজরত উসমান রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আমি রাসুল সা. কে বলতে শুনেছি, ‘যখন কোনো ব্যক্তিকে তোমরা প্রসংশা করতে শুনবে তার মুখে মাটি নিক্ষেপ করবে।’ [সহি মুসলিম, হাদিস নং ৩০০২]

হজরত মুয়াবিয়া রা. থেকে বর্ণিত। রাসুল সা. বলেছেন, ‘তোমরা তোষামোদ থেকে বেঁচে থাকবে। কেননা তা হত্যাতুল্য।’ [সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩৭৪৩]

সুতরাং ইমানের দায়িত্ব হলো কেউ যদি সম্মানসূচক উপাধি ব্যবহার করে তবে তাকে বারণ করা। কেননা প্রসংশা মানুষের জন্য বহু বিপদ দেখে আনে।

হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজালি রহ. বলেন, ‘প্রসংশিত ব্যক্তির জন্য আত্মতুষ্টি, অহঙ্কার ও আত্মবিমুখতা থেকে বেঁচে থাকা কঠিন। তার জন্য এসব বিপদ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব নয় যদি না সে আত্মপরিচয় লাভ করতে পারে।

সুতরাং প্রসংশার শেষ পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা কর। প্রদর্শনপ্রিয়তাসহ আমলের অন্যান্য বিপদ সম্পর্কে ব্যক্তিই ভালো জানে, প্রসংশাকারী নয়। যদি মানব হৃদয়ের সব কথা প্রকাশ পেতো তবে প্রসংশাকারী তার প্রসংশা না করে অপমান করতো। ’ [ইহয়াউ উলুমিদ্দিন, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-২৭৭]

সুতরাং শুধু ‘আল্লামা’ শব্দ নয়; বরং যে কোনো প্রসংশাসূচক শব্দই এগিয়ে যাওয়া উচিৎ।

তারপরও হয়তো অনেক সময় নামের সঙ্গে প্রসংশাসূচক শব্দের ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। বারণ করা সত্ত্বেও কোনো আবেগি ব্যক্তি তা ব্যবহার করে ফেলে। এমন সময় ব্যক্তির করণীয় হলো, আল্লাহর কাছে ব্যবহৃত শব্দের ব্যাপারে পানাহ (ক্ষমা ও আশ্রয়) চাওয়া।

হজরত আদি ইবনে আরতা রহ. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসুল সা. এর একজন সাহাবি ছিলেন। যখন কেউ তার মাহাত্ম্য ঘোষণা করতেন, বলতেন, হে আল্লাহ! তারা যা বলছে সে বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ কর না, তারা যা জানে সে ব্যাপারে আমাকে ক্ষমা করুন, আমাদের তাদের ধারণা চেয়ে উত্তম মানুষ বানান। [জামিউ সহিহিল আজকার, পৃষ্ঠা-১৩]

আরও পড়ুন: ‘মাওলানা সাদ চাইলে এক মিনিটেই তাবলিগের আগুন নেভাতে পারেন


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ