শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪ ।। ১৫ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৯ রমজান ১৪৪৫


আধুনিক তুরস্কের রূপকার সাঈদ নুরসিকে আমরা কতটুকু চিনি?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মাদ শোয়াইব
আন্তর্জাতিক ডেস্ক

সাঈদ বদিউজ্জামান নুরসি। অনেকগুলো পরিচয় রয়েছে তার। তিনি একাধারে শিক্ষক, সংস্কারক, রাজনীতিবিদ, সুফি, ভবিষ্যৎ জাগৃতি ও প্রেরণার উৎস ও একজন সুন্নি মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক।

কিন্তু তার সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি আধুনিক তুরস্কের রূপকার। আজকের তুরস্কের ভেতর থেকে এই বিশাল পরিবর্তনের নেপথ্য পুরুষ এই নুরসি।

নুরসির জন্ম ১৮৭৭ সালে। উসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্গত পূর্ব আনাতোলিয়ার বিতলিস ভিলায়েত প্রদেশের নুরস নামক কুর্দি গ্রামে তার জন্ম। কুর্দি বংশোদ্ভূত এই শিশুর নাম ছিল সাঈদ, মানে ভাগ্যবান। নুরসে জন্ম নিয়েছেন- তাই নুরসি। ‘বদিউজ্জামান’ তার সম্মানসূচক খেতাব। অর্থ, জামানার অনন্য পুরুষ। ইংরেজিতে বলা হতো ‘দি মোস্ট ইউনিক অ্যান্ড সুপিরিয়র পারসন অব দ্য টাইম’।

নিজ এলাকার পন্ডিতদের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করার পর তিনি ভান ভিলায়েতের গভর্নরের আমন্ত্রণে তার বাসগৃহে থাকতে শুরু করেন। এসময় গভর্নরের পারিবারিক গ্রন্থাগারে বসে তিনি প্রচুর পড়াশোনা করতেন। এখানে তিনি উসমানীয় তুর্কি ভাষা রপ্ত করেন।

ছোট থেকেই সাঈদ নুরসি ছিলেন স্বাধীনচেতা। ১০ বছর বয়স হতেই তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। অল্প বয়সেই ধর্মতত্ত্ব নিয়ে জ্ঞান অর্জন করেন তিনি। সুফি দর্শনে তিনি প্রচণ্ড প্রভাবিত হলেও সুফি তরিকায় পুরোপুরি যোগ দেননি। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। কোনো বিষয় মুখস্ত করতে তার বেশি সময়ের প্রয়োজন হতো না।

মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করা সাঈদ ধর্মতত্ত্বের উপর অগাধ পাণ্ডিত্য লাভ করেন। এ সংক্রান্ত যে কোনো বিতর্কে তার যুক্তিগুলো ছিল অখণ্ডনীয়। যা সে সময়ের আলেম সমাজকে বেশ অবাক করেছিল। এ কারণেই তাকে ‘বদিউজ্জামান’ উপাধি প্রদান করা হয়।

কুরআনকে যেভাবে তিনি আত্মস্থ করেছিলেন পৃথিবীর কম মানুষই তা পারে। কুরআন ছিল তার মন-মগজে। তিনি শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন কুরআনিক ধারায়। তিনি সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে যেমন ধর্মীয় শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছিলেন তেমনি ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে চেযেছিলেন।

তার আবিস্কৃত বিশ্বাসভিত্তিক আন্দোলন তুরস্কে ইসলামের পুনর্জাগরণের সূত্রপাত করে। তার অনুসারীদের দৃষ্টিতে তিনি (Wonder of the age) নামে পরিচিত। তার অনুসারীদের জামাতকে ‘নুরজু’ বা ‘নুর জামাত’ নামে ডাকা হয়।

শিক্ষাজীবন শেষে তিনি সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল যাতে বৈজ্ঞানিক ও ইসলামি শিক্ষার মাধ্যমে এই অঞ্চলে দার্শনিক চিন্তা অগ্রসর হয়।

১৯০৯ সালে কমিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রোগ্রেসের সংস্কারের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে বিচারের আওতায় আনা হয়। পরে তিনি মুক্তি পান। উসমানীয় খিলাফতের শেষের দিকে তিনি একজন শিক্ষা সংস্কারক হিসেবে সক্রিয় ছিলেন এবং খিলাফতের জনগণের একতার উপর জোর দেন।

সুলতান আবদুল হামিদের কাছে তিনি শিক্ষা সংস্কারের আবেদন জানান। মাদরাসা ও আধুনিক বিজ্ঞানের সমন্বয়ে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি রাশিয়ার সৈন্যদের হাতে গ্রেফতার হয়ে দুই তাদের হাতে বছর অবরুদ্ধ থাকেন। ১৯১৮ সালে তিনি রুশ ক্যাম্প থেকে পালিয়ে ইস্তাম্বুলে আসতে সক্ষম হলে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয় এবং তাকে ‘দরুল হিকমা আল ইসলামিয়া’র সদস্যপদ দেয়া হয়।

তাকে তুরস্কের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের ধর্ম মন্ত্রী বানানোর প্রস্তাব করা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ইস্তাম্বুলে ফিরে আসার পর তিনি ঘোষণা করেন, "আমি বিশ্বের কাছে প্রমাণ করে দেখাবো যে কুরআন চিরন্তন"।

ব্রিটিশ কলোনি সচিব গ্ল্যাডস্টোন তুর্কিদের পদানত করার ব্যাপারে বলেছিলেন, 'মুসলমানদের হাতে যদি কুরআন থাকে তবে তাদের পদানত করা যাবে না, তাদের উপর বিজয়ী হতে হলে হয় কুরআন তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে হবে অথবা কুরআনের প্রতি তাদের ভালবাসার বিচ্ছেদ ঘটাতে হবে।'

এ কথার প্রতিউত্তরে নুরসি বলেছিলেন ‘কুরআন অমর ও অনস্তমিত সূর্য, যা কখন মুসলমান তথা কল্যাণকামী মানুষ থেকে ছিনিয়ে নেয়া যাবে না।'

এরপরই তিনি কুরআন ভিত্তিক আধুনিক, মানবিক ও মরমি ব্যাখ্যায় প্রবৃত হন এবং ছয় হাজার পৃষ্ঠার বিশাল গবেষণা ভাণ্ডার গড়ে তুলেন। যা 'রেসালায়ে নুর' নামে পরিচিত। 'রেসালায়ে নুর' তাকে তুর্কিদের কাছে তো বটেই পুরো পৃথিবীতে অমর করে দিয়েছে।

সারা জীবন খেলাফত ব্যবস্থায় সক্রিয় থাকলেও জীবনের শেষের দিকে তিনি একদম আড়ালে চলে যান। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিপ্লবের বক্তব্য কোনো কিছুতেই তিনি সক্রিয় ছিলেন না। শিক্ষাবিস্তার, চিন্তার পরিশুদ্ধি, সেবাধর্ম আর নিজের মুক্তি বা নাজাতের প্রচেষ্টার বাইরে তিনি ছিলেন নির্বাক ধরনের। প্রকাশ্যে প্রতিক্রিয়াহীন।

জীবনের শেষ দশকে সাইদ নুরসি ইসপারতা শহরে অবস্থান করেন। ১৯৬০ সালে উরফা ভ্রমণের পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সেখানে তাকে দাফন করা হয়। কিচনু মুসলিমের মতে স্থানটিতে ইব্রাহিম আ. এর মাজার রয়েছে।

১৯৬০ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর পরবর্তীকালে চরম ডানপন্থি রাজনীতিবিদ আল্প আরসালান তুরকসের নেতৃত্বাধীন সৈনিকদের একটি দল জনপ্রিয়তা হ্রাসের জন্য কবর থেকে তার দেহাবশেষ উত্তোলন করে ইসপারতার কাছে অজ্ঞাত স্থানে দাফন করে। বলা হয়, পরবর্তীতে তার সমর্থকরা কয়েক বছর অনুসন্ধানের পর তার কবর খুঁজে পায় এবং আর কোনো ব্যাঘাত না ঘটার জন্য দেহাবশেষ গোপন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

জীবনের শেষ প্রান্তে তার জনপ্রিয়তায় সামরিক সরকার ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে যায়। যে কারণে তার ইন্তেকালের পরও তাকে অত্যন্ত গোপন স্থানে দাফন করা হয় যেন অনুসারীরা তার সমাধিস্থলে একত্র হতে না পারেন।

সূত্র: ইন্টারনেট

ঢাকায় এই ১ম আন্তর্জাতিক নুরসি সম্মেলন


সম্পর্কিত খবর