কাউসার লাবীব: রাজধানীতে শুক্রবার অনলাইন নিউজপোর্টাল আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের উদ্যোগে রাজধানীর অনুষ্ঠিত হলো অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট সম্মেলন।
তোপখানা রোডের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সমিতি মিলনায়তনে বিকেলে তরুণদের এ মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদক হুমায়ুন আইয়ুব।
প্রধান অথিতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চিন্তাশীল আলেম, রাজনীতিক ও সংগঠক খতিব তাজুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আওয়ার ইসলামের প্রধান সম্পাদক মুফতি আমিমুল ইহসান।
সভায় ‘মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া সঙ্কট ও সমাধান’ শীর্ষক বিষয়ের ওপর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন দেশের আলোচিত তরুণ, লেখক, সাংবাদিক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টগণ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে কওমি মাদরাসা শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনের চেয়ারম্যান খতিব তাজুল ইসলাম বলেন, শুরুতেই আওয়ার ইসলামকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলছি, আপনারা অনন্য এ জগতে গিয়ে চলছেন। কিন্তু অগ্রগতির এ ধারা থামিয়ে দিলে চলবে না। এগিয়ে যেতে হবে প্রাণ খুলে। মন খুলে। শত বাধা বিপত্তি আসবে। এগুলো মাড়িয়েই পথচলার অঙ্গীকার করতে হবে আপনাদের।
লন্ডনে এক বক্তৃতায় আল্লামা তাকি উসমানি একবার বলেছিলেন, ‘আমাদের শুধু অভিযোগ- ইহুদিরা আমাদের অন্যায়ভাবে হত্যা করছে। খ্রিস্টানরা আমাদের অধিকার হরণ করছে। আরও অন্যান্য ধর্মালম্বীরা আমাদের নির্যাতন করছে।
আরে ভাই, তারা তো আমাদের বন্ধু নয়, দুশমন। দুশমনের কাজ কী? তারা তো আমাদের বিরুদ্ধে লেগেই থাকবে। আমাদের কীভাবে পিছিয়ে রাখা যায়, দমন করা যায় এটাই তাদের পরিকল্পনা।
সুতরাং আমাদের উচিৎ তাদের বিরুদ্ধে শুধু অভিযোগ নয়, তাদের এ নীল নকশা ও পরিকল্পনাকে কীভাবে পণ্ড করা যায় সে পরিকল্পনা নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া। আমাদের এসব অকার্যকর হা হুতাশে নিজেরাই হাসির পাত্রে পরিণত হচ্ছি। ’
চিন্তাশীল আলেম খতিব তাজুল ইসলাম বলেন, মিডিয়ায় এখনও আমাদের ভূমিকা জিরো পার্সেন্ট। এ সঙ্কট থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। না হয় আমাদের ভবিষ্যত আরো ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়াবে।
বড়কাটারা, লালবাগ মাদরাসা থেকে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ভার্সিটি, বুয়েট, জামিয়া রাহমানিয়া, মালিবাগ মাদরাসার মাঝে যে দেয়াল আমরা তৈরি করেছি তা ভেঙ্গে সবাই একমালার ফুল হতে হবে। আমাদের মাঝে কোনো ভেদাভেদ রাখা যাবে না।
ভেদাভেদ আমাদের কাক্সিক্ষত সফলতা থেকে দিনদিন দূরেই সরিয়ে দিচ্ছে। সফলতা নয়।
লাল সবুজের এই পতাকা আমাদের। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইল আমাদের। এখানে মিশে আছে আমাদের আবেগ, প্রণয়, মায়া, ভালোবাসা, অনুভূতি আর মায়ামমতার গল্প। অতএব একতাই আমাদের এনে দিতে পারে কাক্ষিত সফলতা।
আমরা অনেকেই বলছি, ‘ফেসবুক আমাদের মাঝে সঙ্কট তৈরি করছে’। কিন্তু আমি এ কথাটিকে ততটা সমর্থন করতে পারছি না।
আমাদের সঙ্কট তো শুধু ফেসবুকে নয়, সঙ্কট অর্থনীতিতে, সংস্কৃতিতে, পরিবার নীতিতে। আমাদের সঙ্কট বিদ্যমান সর্বক্ষেত্রেই।
শুধু মিডিয়ায় বিদ্যমান সঙ্কট ঘুঁচালেই চলবে না। আমাদের প্রতিটি বিষয়ের সঙ্কট দূর করতে সচেতন হতে হবে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, শত স্বাধীনতার পরও কোটি সীমানায় আমরা বন্দি। প্রত্যেকটি কাজের ক্ষেত্রে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট একটি সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছে পৃথিবীর ক্ষমতাশীলরা। ওই সীমানা ডিঙানোর শক্তি বা অধিকার কোনোটাই আমাদের নেই।
অনুষ্ঠানে ইউটিউব কোর্স সম্পন্ন করা ১০ শিক্ষার্থীর হাতে সনদ তুলে দেয়া হয়
আমাদের আকাশে আমরা স্যাটেলাইট পাঠাতেও তাদের অনুমতি লাগে। বাংলাদেশ হাজারও চেষ্টা করে তাদের অনুমতি পায়নি। তাই স্যাটেলাইটও পাঠানো হয়নি। এভাবেই আমরা প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে একটি শক্তির হুকুমের গোলাম। আমাদের সংস্কৃতি আর আকাশ সংস্কৃতি সবই তাদের নিয়ন্ত্রণে।
তিনি বলেন, আজকের তুরস্ক দেখে আমরা আনন্দিত। এরদোগানের সাহসিকতা আমাদের আপ্লুত করে। কিন্তু আজকের তুরস্ক এ কীভাবে এমন হলো। এ ইতিহাস কি আমরা জানি? আমরা কি তা থেকে শিক্ষা নিচ্ছি।
যার রক্ত ঘামে এ তুরস্কের জন্ম তিনি হলেন বদিউজ্জামান সাইদ নূরসি। তিনি তার জীবনের প্রায় ৪০/৪৫ বছর কারাগার, নির্বাসন আর নির্যাতনে কাটিয়েছেন।
ইসলাম থেকে দূরে চলে যাওয়া তুরস্কবাসীকে তিনি তার অমর গ্রন্থ রিসালায়ে নুরের মাধ্যমে দেখেছিয়েন, ইসলাম আধুনিকতাকে নিরুৎসাহিত করে না। বরং ইসলাম সর্বাধুনিক পথ ও ধর্ম।
তিনি ধর্মনিরপেক্ষ ও নাস্তিক্যবাদের চরম বিরোধী ছিলেন। সুন্দর বিশ্ব বিনির্মাণে ধর্মনিরপেক্ষতা হুমকি। বস্তুবাদ ও নাস্তিকতা- বিজ্ঞান, যুক্তি ও সত্যতার চির শত্রু। এটি তিনি তার গ্রন্থে নিপুনভাবে তুলে ধরেছেন।
কামাল আতা তুর্ক প্রথমে তার দূরদর্শি ও নীরব পদক্ষেপকে দমাতে চেয়েছেন মন্ত্রিত্বের লোভ দেখিয়ে। তাকে তুরস্কের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের ধর্মমন্ত্রী করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি।
তারপর আরবিতে আজানের পক্ষাবলম্বন ও বেশ কিছু বিষয়ে দ্বিমত দেখিয়ে তাকে ইসপারতা প্রদেশে নির্বাসন দেওয়া হয়। এই অঞ্চলের জনসাধারণের মধ্যে তার শিক্ষা জনপ্রিয় হয়ে পড়ে। তাই ইসপারতার গভর্নর তাকে বারলা নামক গ্রামে পাঠিয়ে দেন। এভাবেই তাকে এখান থেকে সেখানে নির্বাসনে জীবন কাটাতে হয়।
কিন্তু শক্তিশালী লেখনী আর অনুসৃত পন্থার কারণেও তার আন্দোলন দ্রুত সফলতা লাভ করে।
সারা বিশ্বে বর্তমানে সভ্যতার যে সঙ্ঘাতের পদধ্বনি দেখা যাচ্ছে এ বিষয়ে তিনি প্রায় সিকি শতাব্দী আগেই মুসলমান তথা সমগ্র বিশ্ববাসীকে সতর্ক করেছিলেন এবং এ থেকে উত্তরণের অন্যতম পথ হিসেবে ‘ডায়ালগ’ এবং ‘কো-একজিস্টেন্স’কে অন্যতম সমাধান বলে অভিহিত করেছিলেন।
তিনি নাস্তিক্যতাকে তুরস্কে ঠেকানোর জন্য পশ্চিমা পাদ্রিদের সাথে ঐক্যের চেষ্টা করেছিলেন। তার ঐতিহাসিক ‘দামাস্কাস সেরমন’ জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবার সাথে সৌহার্দ্য রক্ষার অন্যতম নীতিনির্ধারণী বক্তৃতা বলে অনেকেই অভিহিত করেছেন।
১৯৬০ সালে উরফা ভ্রমণের পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সেখানে তাকে দাফন করা হয়। ১৯৬০ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর পরবর্তীকালের চরম ডানপন্থি রাজনীতিবিদ আল্প আরসালান তুরস্কের নেতৃত্বাধীন সৈনিকদের একটি দল জনপ্রিয়তা হ্রাসের জন্য সাইদ নূরসির দেহাবশেষ কবর থেকে উত্তোলন করে হ্যালিকপ্টারে করে ইসপারতার কাছে অজ্ঞাত স্থানে দাফন করে।
জীবনের শেষ প্রান্তে তার জনপ্রিয়তায় সামরিক সরকার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যায়। যে কারণে তার ইন্তেকালের পরও তাকে অত্যন্ত গোপন স্থানে দাফন করা হয় যেন অনুসারীরা তার সমাধিস্থলে একত্র হতে না পারেন।
ইসলাম সমৃদ্ধ আধুনিক তুরস্কের ইতিহাস যদি দেখতে চাই তাহলে আরও যার রক্ত, ঘাম আর মেধার দাগ দেখতে পাবো তিনি হলেন নাজমুদ্দিন আরাবকান। তার সঙ্গে আছেন তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দেরেসের নাম।
আদনান মেন্দেরেস ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েও ইসলামকে ভালবাসতেন। আর যারা ইসলাম নিয়ে কাজ করতে চায় তাদের মুক্ত প্লাটফর্ম গড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। অথচ তখন তুরস্কের অবস্থা এমন ছিল, আরবিতে আজান দেওয়া নিষেধ। শত শত মসজিদে তালা। ধর্মীয় বিধান পালনে বাধা। ইত্যাদি।
ইসলাম ও বিজ্ঞানের সমন্বয়ক নাজমুদ্দিন আরাবকান প্রধানমন্ত্রী মেন্দেরেসকে একটি প্রস্তাবনা লিস্ট প্রদান করেন। যাতে তুরস্কবাসীকে ইসলামের ছোঁয়ায় কুরআনের আলোয়ে বিজ্ঞান উপহার দেওয়ার ফর্মূলা ও ছক ছিল। মেন্দেরেস তাকে আশাবাদ করেছিলেন তিনি এ ফর্মূলা বাস্তবায়ন করবেন।
কিন্তু এ খবর খবর মার্কিন সেনাপ্রধান জানতে পেরে মেন্দেরেস ও আরাবকানকে বলেন, আপনার কেন বিজ্ঞান নিয়ে ব্যস্ত হবেন? আপনাদের আমরা ডক্টর দেব, ডাক্তার দেব, ইঞ্জিনিয়ার দেব, বিজ্ঞানী দেব। আপনার এসবে জড়ানেরা দরকার নেই।
কিন্তু তারা এ প্রস্তাব মেনে নেননি। তাইতো মেন্দেরেসকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছিল। তারা আজ নেই। কিন্তু আজও তারা তুরস্ক ও বিশ্ববাসীর হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরভাস্বর হয়ে আছেন।
অতএব আমরা যদি আমাদের দেশ আমাদের বিশ্বকে এগিয়ে নিতে চাই। তাদের মতো রক্ত, ঘাম আর নিপুন মেধা ব্যয় করতে হবে।
যে চিন্তাচেতনা সামনে রেখে হাঁটবো, তা হতে হবে যুগোপযোগী, নিপুন, মানসম্মত ও কার্যকরী। তাহলেই আমাদের আকাশ থেকে কালো মেঘের আঁধার ছায়া দূর হয়ে ফিরে আসবে রশ্মিচিরন্তন।
খতিব তাজুল ইসলাম আরও বলেন, আজ কলেজ ভার্সিটিতে মেয়েদের পর্দা ও হিজাবে বাধা আসছে। এর জন্য দায়ী কারা?
আমরা আমাদের নিজস্ব একটি গণ্ডি ও বলয় তৈরি করেছি। যার ফলে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি।
আর আমাদের অনুপস্থিতিতে নাস্তিক্যবাদ ও তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদাররা সেখানে ঘাপটি মেরে বসেছে। আর যা খুশি তাই করছে।
সুতরাং ওই মসনদ ও আসনগুলো আমাদের করে নিতে হবে। তাদের সুন্দর ও আধুনিক একটি পরিবেশ উপহার দিতে হবে আমাদের।
দেখুন, এরদোগানকে তার জনগণ প্রাণখুলে ভালবাসে কেন? তার সুন্দর আজানের জন্য? তার সুন্দর কোরআন তেলাওয়াতের জন্য? না।
তাকে মানুষ ভালবাসে তিনি তাদের সুন্দর তুরস্ক উপহার দেওয়ার চিন্তায় ব্যপৃত। আমাদেরও সেপথে এগুতে হবে।
ইসলাম সুন্দর ও আধুনিক ধর্ম । এটা শুধু দাবী করলে চলবে না। বরং মানুষকে বাস্তবে পরিণত করে দেখাতে হবে।
আমি আওয়ার ইসলামকে বলব, আপনারা বাংলা ভার্সনের সঙ্গে অতিসত্ত¡র আরবি ও ইংরেজি ভার্সন চালু করুন।
সবশেষে তিনি বলেন, আমি খুবই চিন্তা ও উদ্বিগ্ন ছিলাম, আমার দেশের আগামী ভবিষ্যত কোন পথে। কিন্তু এ অনুষ্ঠানে এসে আপনাদের যে পদক্ষেপ, চিন্তা চেতনা আর স্বপ্নের কথা আমি শুনলাম, তা আমাকে আসান্বিত করেছে। আল্লাহর শপথ আগামীর ভবিষ্যত, আগামীর বাংলাদেশ, আগামীর বিশ্ব আপনাদের হাতে। ইনশাআল্লাহ। তবে এগুতে হবে খুব সাবধান ও নিপুনভাবে।
ভিডিও
‘ইন্টারনেটে তরুণদের সংযত হওয়ার পরামর্শ’