বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪ ।। ১৪ চৈত্র ১৪৩০ ।। ১৮ রমজান ১৪৪৫


 ‘তাবলিগের কাজটা আলেমদের; তাই সংকট তৈরি হলে মাথা ব্যথাটাও আমাদের বেশি’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মারকাযুশ শাইখ যাকারিয়া রহ. ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মহা পরিচালক মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ। একজন খ্যাতিমান আলেমে দীন ও প্রজ্ঞাশাসিত মুফতি। ওয়াজের মাঠেও দেশ বিদেশে রয়েছে তার ব্যাপক খ্যাতি। ইসলামের মৌলিক বেশকিছু বিষয়ে তিনি লিখেছেন প্রামাণ্য গ্রন্থ। সম্প্রতি তাবলীগ জামাতের নানা বিষয়ে আওয়ার ইসলামের সঙ্গে দীর্ঘ কথা বলেছেন তিনি।

ভাবনা বিনিময় করেছেন আওয়ার ইসলামের সম্পাদক হুমায়ুন আইয়ুব

আওয়ার ইসলাম: তাবলিগ জামাতের মেহনতের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি...

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ: দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ রাসুলে পাক সা. এর দায়িত্ব এবং নায়েবে নবী হিসেবে কেয়ামত পর্যন্ত এ কাজ চালিয়ে যাওয়া সমস্ত ওলামায়ে কেরামের দায়িত্ব। নায়েবে নবীর মাধ্যমে রাসুলের উম্মত যারা সবার এই দায়িত্ব।

কারণ, দাওয়াত ও তাবলিগ না হলে ইসলাম চলমান থাকবে না, ইসলাম না থাকলে নবুয়ত ও রেসালাতও চলমান থাকবে না। এজন্য, আল্লাহ তার মাহবুবকে শেষ নবী বানিয়েছেন, কেয়ামত পর্যসন্ত আর নবী আসবে না।

তাহলে, কেয়ামত পর্যন্ত নবীওয়ালা এই কাজ উম্মতের ওপর অর্পিত হয়েছে। কোনোকালে যদি তা বন্ধ হয়ে যায় ইসলাম ও শরিয়ত বন্ধ হয়ে যাবে। এটা মৌলিক ইসলামের দাওয়াত ও তাবলিগ যুগযুগ ধরে চলে আসছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে।

হজরতজি ইলিয়াস রহ. দারুল উলুম দেওবন্দের কৃতি সন্তান। তিনি দাওয়াত ও তাবলিগ যেটা যুগযুগ ধরে চলে আসছিল সেটাকে আরো সম্প্রসারণ করে বিশেষ কিছু পদ্ধতিতে নতুন আঙ্গিকে শুরু করেছিলেন। বর্তমানে তাবলিগের যে নেজাম চলছে, তিনিই ব্যাপক আকারে সুশৃঙ্খলভাবে অধিক ফলপ্রসু করে আরম্ভ করেছেন।

এরপর তার সুযোগ্য সাহেবজাদা হযরত ইউসুফ রহ. এরপর মাওলানা এনামুল হাসান রহ. এরপর যোবায়ের হাসান রহ. সবাই সুন্দরভাবে এই নবীওয়ালা কাজ আঞ্জাম দিয়ে এসেছেন। তাদের পরিচালনায় দাওয়াত ও তাবলীগ এ পর্যন্ত এসেছে।

আরেক ভাষায় বলি, খতমে নবুয়তের ধারাবাহিকতা দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। সেই মহান কাজটাই নতুন আঙ্গিকে অতি সুন্দরভাবে ইলিয়াস রহ. উম্মতের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এটা নতুন কোন কিছু না বরং আগের থেকে চালু হওয়া জিনিসটাকে তিনি পরিমার্জন করে, পদ্ধতিগত কিছু সংযোজন করেছেন।

আওয়ার ইসলাম : সাধারণ মানুষের জীবনে দীনি পরিবর্তনে তাবলীগ জামাত পরীক্ষিত এবং আস্থাশীল জায়গা।  সারা পৃথিবীতে তাবলিগ জামাতের প্রতি মানুষের গভীর শ্রদ্ধা-ভক্তি রয়েছে। আজকাল কিছু সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছে সে সমস্যগুলো কী জানতে চাচ্ছি?

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদসমস্যা তো আগে থেকেই ছিল। যারা সত্যিকারের ইসলাম চায় না, ইসলামের অপব্যাখ্যাকারী বাতিল ফেরকা হজরতজি ইলিয়াস রহ. এর তাবলীগের ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপন করে আসছেন।

কিন্তু, হক্কানী ওলামায়ে কেরাম তাদের কঠোর জবাব দিয়ে এসেছে এখনও দিচ্ছেন। এটা বাতিলদের পক্ষ থেকে সৃষ্ট সংকট। আর বর্তমানে যে সংকটের কথা শোনা যাচ্ছে এটা দুঃখজনক। এই সংকট বাতিলদের পক্ষ থেকে নয় বরং আমাদের নিজেদের ঘরের মধ্যে ভাই ভাই মতপার্থক্যের কারণে সৃষ্ট সংকট।

এখন প্রশ্ন হলো সংকটটা কী? আমার মনে হয়, মাওলানা সাদ সাহেবের আপত্তিকর কিছু বক্তব্য একটা সংকট আর তাবলীগ জামাত আমির না শূরা অনুযায়ী চলা উচিৎ এটা আরেকটি সংকট। আমার দৃষ্টিতে সংকট এই দুইটা।

এই দুই সংকট নিয়ে আমি বলতে চাই, আসলে শরিয়তের কাজ যে কোনো তানজিম যে কোনো সংগঠন শূরা অনুযায়ীও চলতে পারে আবার আমির মেনেও চলতে পারে। উভয়টাই ইসলামে আছে।

তাবলীগ শূরা ভিত্তিক চলবে না আমিরের নেতৃত্বে চলবে? এই যে বিতর্ক এটা একটা অভ্যন্তরীণ কাজ এবং যারা তাবলীগের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত তাদের একান্ত বিষয়।

আরেকটা সংকট হচ্ছে বর্তমান মাওলানা সাদ সাহেব- একদল তাবলীগের সাথী তাকে আমির হিসেবে মানছেন আবার বড় আরকে দল তাকে আমির হিসেবে মানছেন না।

[যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় তাবলীগ বিষয়ে শুরা ও আলেমদের বৈঠকে ৫ সিদ্ধান্ত]

মাওলানা সাদ সাহেবের আরো একটি বিষয় হলো, তিনি ইসলামের নামে নিজস্ব কিছু মতবাদ তার বয়ান বক্তৃতায় প্রচার করছেন। যে কথাগুলো দারুল উলুম দেওবন্দসহ বিশ্বের হক্কানী সব আলেমের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।

এখন কথা হলো উনার আমির হওয়াটা শরিয়তের নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করে নয়। তাই উনাকে আমির না মেনে অনেক আলেম মুবাল্লিগ শূরা পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন। এটা একটা বিতর্কিত বিষয়, তবে আমার দৃষ্টিতে উভয়টাই হক।

এখন যদি নিযামুদ্দীন, রায়বেন্ড এবং কাকরাইলের আকাবিরগণ ইতিহাসকে সামনে রেখে ইখলাসের সাথে এই মহান দীনি কাজকে মাথায় রেখে এই কাজের মধ্যে যেনো কোন ক্ষতিসাধিত না হয়, বাতিল যেনো এই জামাতের মধ্যে নাক গলানোর সুযোগ না পায়- আলমী কাজ এটা চলতে থাকে আরো ভালোভাবে এই তিন দেশের মুরুব্বিরা বসে যদি ঐক্য হয়ে যায় তাহলে তখনই সমাধান হয়ে যাবে।

আওয়ার ইসলাম : তাবলীগের ইতিহাস কী বলে? দীর্ঘকাল পর্যন্ত তাবলীগ জামাত আমিরের পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়ে এসেছে না শূরার ভিত্তিতে?

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদআমি যতটুকু জানি, হযরত ইলিয়াস রহ. এর আমল থেকে এনামুল হাসান রহ. পর্যন্ত আমিরের পদ্ধতিতে তাবলীগ পরিচালিত হয়ে এসেছে। আহলে এলম এবং বুযুর্গরা তাদের নিজ প্রয়োজনে আমির বানিয়েছেন।

তবে, তারা আমির হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে কখনো আমির দাবি করেন নি এবং পরামর্শ ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নি। হযরত এনামুল হাসান রহ. ইন্তেকালের এক বছর কিংবা দেড় বছর আগ পর্যন্ত এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই তাবলীগ জামাত পরিচালিত হয়ে আসছিল।

এনামুল হাসান রহ. ইন্তেকালের পূর্বে তিনি চিন্তা করলেন আমি দুর্বল হয়ে গেছি এই আলমী কাজ আমার একার দ্বারা আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব না। তাই তিনি ৯ সদস্যের একটি শূরা গঠন করে যান। আমরা যতদূর জানি, এনামুল হাসান রহ. এর পর থেকে মাওলানা যুবাইরুল হাসান রহ. এর ইন্তিকাল পর্যন্ত এভাবেই তাবলীগ পরিচালিত হয়ে আসছিল।

তবে, ফয়সালা গ্রহণের জন্য শূরা কয়েকজনকে আমিরে ফয়সাল নিযুক্ত করে। প্রথমে পাঁচজন ছিল পরবর্তীতে দুইজন মারা গেছেন এরপর তিনজন ছিল। আবার দুজন মারা যান, এখন বিশ্বে আমিরে ফয়সাল হিসেবে হযরত মাওলানা সাদ সাহেব একাই রয়ে গেছেন।

[কাকরাইল শুরার উপদেষ্টা মনোনীত হলেন ৫ আলেম]

এখন প্রশ্ন হলো তিনি কি শূরা ভিত্তিক তাবলীগের আমিরে ফয়সাল না ফয়সাল একজন একজন বিয়োগ হতে হতে একাই যেহুতু রয়ে গেছেন তাই তিনি কি বিশ্ব আমির? না শূরার একজন সদস্য হিসেবে তিনি কাজ করছেন?

হাজী আবদুল ওয়াহাব সাহেব এখনও সেই শূরার সদস্যদের অন্যতম ব্যক্তি যিনি জীবিত আছেন। এখন একটা হলো আমিরে ফয়সাল আরেকটা হলো শূরা সদস্য। এটা এখন চিন্তার বিষয় মাওলানা সাদ সাহেব শূরার ৯ জনের একজন নাকি আমিরে ফয়সালের পাঁচজনের এক একজন?

[কাকরাইলের শুরায় আলেমদের পৃষ্ঠপোষকতাকে স্বাগত জানালেন আল্লামা আহমদ শফী]

তিনি যদি আমিরে ফয়সালের একজন হন আর শূরারও একজন হন উভয়টাতেই শূরার কাজ হবে বিশ্ব আমিরের তো কাজ হবে না। আর কেউ যদি এই ব্যাখ্য করেন যে, আমির ফয়সাল হিসেবে তিনি একাই বেঁচে আছেন, তাই তিনি বিশ্ব আমির তাহলে তিনি ভুল ব্যাখ্য করছেন।

এই ব্যাখ্যার ঠিক-বেঠিক নিয়ে আমি মনে করি, নিযামুদ্দিনসহ অন্যন্য মারকাজের মুরব্বিগণ ইতিহাস ও বাস্তবতার নিরিখে আহলে ইলমদের কাছে ফতোয়া চাইতেন তাহলে ওলামায়ে কেরাম কুরআন হাদিসের আলোকে এই সংকটের সমাধান দিতে পারতেন।

যদি আলেমদের প্রয়োজন না হয়, তাহলে নিযামুদ্দিনসহ অন্যান্য মারকাজে তো বড়বড় আলেম আছেন তারাও এর সুষ্ঠ সমাধান করতে পারেন। তবে, এই সমাধান হচ্ছে না, কেন হচ্ছে না আল্লাহ ভালো জানেন।

আওয়ার ইসলাম : আপনি বললেন হযরত মাওলানা এনামুল হাসান রহ. এর ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত তাবলীগ জামাত আমির পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়ে আসছিল । তিনি ইন্তিকালের এক থেকে দেড় বছর আগে ৯ সদস্যের একটি শূরা গঠন করে যান। সেই শূরাটা কোথায় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, কারা ছিলেন এবং কে প্রতিষ্ঠা করেছেন? আসলেও কি আলমী শূরা হিসেবে এর কোন ভিত্তি আছে?

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদআমি এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে একটা কথা বলে নিই। আমরা তাবলীগের মুহিব্বিন, তাবলীগ আমাদের কাজ। বেশিরভাগ সময় মাদরাসা-মসজিদ এবং ইলম চর্চায় কাটিয়ে থাকি। পুরো সময়টাই তাবলীগে দিতে পারি না। তাই ইতিহাস বাই ইতিহাস সব বলতে পারাটা আমার জন্য কষ্টকর।

তবে, আমি যে কথাগুলো বললাম এটা নেযামুদ্দিন থেকে শুরু করে কাকরাইল পর্যন্ত স্বীকৃত একটা বিষয়। কোন পক্ষ এই কথা অস্বীকার করতে পারবে না। সম্ভবত নেযামুদ্দিনে প্রতিষ্ঠিত এই শূরার সদস্যদের নিয়ে হযরতজী রহ. হজও করেছেন এবং হজ থেকে ফেরার পর তিনি ইন্তেকাল করেছেন।

আওয়র ইসলাম : আলমী শূরার বিষয়টা আরেকটু স্পষ্ট জানতে চাচ্ছি। এর জন্ম কখন কোথায় হয় এবং কারা আলমী শূরা তৈরি করেন?

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদআমি যতটুকু জানি, হযরতজী এনামুল হাসান রহ. পর্যন্ত আমির পদ্ধতি চলে আসছে। আর এখন যে তাবলীগের সাথীদের মধ্যে ২০১৫ সালের শূরার কথা প্রচলন আছে সেটা পাকিস্তানের রায়বেন্ডের ইজতেমায় সকল মুরুব্বি বসে ঐ এনামুল হাসান সাহেবের শূরা যেটা ছিল ৯ জনের তার মধ্য থেকে অনেকে দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার কারণে যারা তাবলীগের মুরুব্বি তারাই বারবার বলছিলেন ঐ শূন্যস্থানগুলো পূরণ করার জন্য নতুন একটি শূরা গঠন করা হোক।

এই প্রয়োজন অনুভব করে বিশ্বের সব মুরুব্বি মাওলানা সাদ সাহেবের উপস্থিতিতে ২০১৫ সালে ১৩ জন কিংবা ১৫ জনের আলমী শূরা গঠন করা হয়। আর এই আলমী শূরাকে সাদ সাহেব অস্বীকার করেছেন। অবশ্য তিনিও কিছু যুক্তি দেখিয়েছেন।

আর হাজি আবদুল ওয়াহাব দেখলেন যে একজন না মানলে কি হবে, কিন্তু শূরার প্রয়োজন ছিল। তাই তাদের বলা হয়েছিল আপনারা দুজন রয়ে গেছেন শূরা সদস্য আপনারা দুজন মিলে যে শূরা গঠন করবেন তাই শূরা বলে বিবেচিত হবে। মাওলানা সাদ সাহেব না মানায় ভাই আব্দুল ওয়াহাব সাহেব নিজে নিজে ইস্তেখারা করে ১৩ জনের একটা শূরা কায়েম করেছেন।

আওয়ার ইসলাম: আপনার কথা থেকে স্পষ্ট হয়, আলমী শূরা বলতে যে ১৩ জনের কমিটি গঠন করা হয় সেটা সর্বসম্মতিক্রমে গঠিত হয়নি বরং একজন ব্যক্তির মাধ্যমে গঠিত হয়। তাহলে আলমী শূরা বলতে যে কথা আজকে বোঝানো হচ্ছে এই কথার ভিত্তি কতটুকু এবং তাবলীগের ইতিহাস এটাকে কিভাবে দেখছে?

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদসংকটটা তো সৃষ্টিই হয়েছে এখান থেকে।মাওলানা  সাদ সাহেব মানেন নাই, ভাই আব্দুল ওয়াহাব সাহেব বিশ্বের সকল মুরুব্বিকে একসাথে করে সাক্ষর নিয়েছেন এবং মাওলানা সাদ সাহেবকে বলা হয়েছে আপনার এখানে কোনো প্রশ্ন থাকলে কোন সদস্য পছন্দ না হলে বলেন এবং আপনার পছন্দের সদস্যদের যোগ করে হলেও এটা মেনে নেন।

মাওলানা সাদ সাহেবকে মানানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে, তবুও তিনি মানেন নি। তিনি ব্যতিত বাকি সবাই ইত্তেফাক করেছেন। আমার জানা মতে, কাকরাইলও একমত হয়নি, সাদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে ছিল। আর এখান থেকেই কিন্তু ফাটলটা শুরু।

আওয়র ইসলাম : বুঝা যাচ্ছে মাওলানা সাদ সাহেবকে বাদ রেখে এই শুরা গঠন করা হয় এবং পরবর্তীতে তাকে মানানোর চেষ্টা করা হয়। আর এখান থেকে সংকটের সৃষ্টি হয়। তাহলে তো সমস্যার সূত্রপাত হাজী আবদুল ওয়াহাব বা উনাদের গঠিত শূরা থেকে, এখানে সাদ সাহেবের কী দোষ? মাওলানা সাদ সাহেবকে শূরা মানতে বাধ্য করা কতটা যৌক্তিক?

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদযুবাইর হাসান রহ. এর সময় থেকে সাদ সাহেবের জমানা পর্যন্ত অনেকবার এই নেযামুদ্দিনেই বড়বড় মুরব্বী সাদ সাহেবকে অনেক অনুরোধ করেছেন হাজী আবদুল ওয়াহাব সাহেবও অনুরোধ করেছেন।

মাওলানা সাদ সাহেব এতকিছুর পরেও এই শূন্যস্থান পূরণ করার লক্ষে শূরা গঠন করতে সম্মত হন নি। তিনি রাজি না হওয়াতে পাকিস্তানের ইজতেমায় বিশ্বের সবাই একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন সাদ সাহেব যেহেতু আকাবিরদের পন্থা থেকে সরে গেছেন, তাবলীগের মধ্যে ভিন্ন নতুনত্ব সৃষ্টি করেছেন, ফাযায়েলে আমল বাদ দিয়ে ইন্তিখাবে হাদীস চালু করেছেন, আবার বক্তব্য দেন কুরআন সুন্নাহ বিরোধী এসব কিছুই ২০১৫ সালের আগেই সামনে এসেছে।

এরপর সাদ সাহেবের সাথে একাকী বসে, লিখিতভাবে আরো অনেক পন্থায় তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হযেছে যে কাজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, মানুষের মধ্যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হচ্ছে আপনি আল্লাহর ওয়াস্তে একটা শূরা গঠন করেন।

শূরার মাধ্যমে আপনি যদি কাজটা করেন তাহলে আপনি এই বিপদ থেকে বেঁচে যাবেন। মাওলানা সাদ সাহেব না মানার কারণে পরস্পর মতের ভিন্নতা যখন তীব্র আকার ধারণ করছিল, তখন ২০১৫ সালের ইজতেমায় ঐ কারণ থেকে সবাই শূরা গঠনের উদ্যোগী হলেন।

[‘তাবলীগের উপদেষ্টা মনোনয়ন সময়োপযোগী ও দূরদর্শী পদক্ষেপ’]

সবাই ভাবলেন, আমারা সবাই একমত হয়ে গেলাম সাদ সাহেব যদি একা একমত না হয় তাহলে এতবড় আজিম দীনি কাজকে রক্ষা করার জন্য একজন ব্যক্তিকে পরে হাতে পায়ে ধরে মানিয়ে নেওয়া যাবে। আমরা শূরা করতে বাধ্য। না করলে একক নেতৃত্বে তাবলীগ চলার কারণে পূর্ববর্তীদের মানহাজ থেকে তাবলীগ জামাত লাইনচ্যুত হয়ে যাচ্ছে, নতুন ফিকির সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়াও, তাবলীগের মতাদর্শ এবং লক্ষ উদ্দেশ্যকে সংরক্ষণ করার জন্য আলমী শূরা কায়েম করা হয়।

আওয়ার ইসলাম: আপনি বলতে চাচ্ছেন, হজরতজি ইলিয়াস রহ. এর তাবলীগ বহাল নেই, তাবলীগে আগের ফিকির থেকে বেরিয়ে আসছে, কাজের মধ্যে নতুনত্ব সৃষ্টি হচ্ছে এই জায়গাটা ষ্পষ্ট করবেন কি?

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদইলিয়াস রহ. তাবলীগের যেই নিয়ম-নীতি দিয়েছিলেন, কাজ দিয়েছিলেন, কর্মপদ্ধতি এবং রূপ দিয়েছিলেন মাওলানা সাদ সাহেব তার উল্টো করেছেন। সাথে সাথে অনেক বড়বড় ‍সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে সাদ সাহেব নতুন নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন এবং সেগুলো সবাই জানেন।

আওয়ার ইসলাম:  মাওলানা সাদ সাহেব তাবলিগের কাজে হজরতজি  ইলিয়াস রহ. এর বিপরীতে গিয়ে করেছেন এবং মাওলানা সাদ সাহেবের সেই কাজ শরিয়ত সম্মত হয়নি, এমন একটা কাজের কথা বলুন…

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদফাযায়েলে আমলের যে তালিম ছিল, সাদ সাহেব সেটাকে পরিবর্তন করে মুন্তাখাব হাদিসের আমল চালু করেছেন।

আওয়ার ইসলাম: এ কারণে শরিয়তের কী সমস্যা হয়েছে বলে মনে করেন বা তাবলীগ জামাতের চিন্তা চেতনার মধ্যে কি পরিবর্তন এসেছে?

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদশরিয়তের মধ্যে কোন সমস্যা হয় নাই। আর তাবলীগ জামাতের যিনি প্রতিষ্ঠাতা মরহুম ইলিয়াস রহ. এবং তার পরবর্তী আমিরগণের পরীক্ষিত এবং নির্ধারণকৃত বই ফাযায়েলে আমলকে পরিবর্তন করে নিজের নামে ছাপানো বই এর তালিমের প্রচলন করাটা দু:খজনক এবং আকাবিরদের সম্মানহানির কারণও বটে।

আর এই বিষয়টা তো পরামর্শ করে করা উচিৎ ছিল। কিন্তু তিনি পরামর্শ ছাড়াই তা করেছেন। শুধু এমন একটা পরিবর্তন নয় বরং একাধিক পরিবর্তন এনেছেন তিনি।

আওয়ার ইসলাম : মাওলানা সাদ সাহেবের সমস্যাগুলো কী ব্যক্তিগত না শরিয়তসম্মত? যদি ব্যক্তিগত সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে কিভাবে সমাধান করা যাবে বা শরিয়তের সমস্যাগুলো কিভাবে সমাধান করা যায়? একজন বিশেষজ্ঞ আলেম হিসেবে আমি আপনার মতামত জানতে চাচ্ছি।

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদউভয় সমস্যার সমাধান হবে, সবকিছু শূরার উপরে ছেড়ে দেওয়া এবং শরিয়ত বিরোধী কর্মকাণ্ডগুলোকে যেগুলো তিনি শরিয়তসম্মত মনে করেন আলেমদের হস্তান্তরে আলোচনা সাপেক্ষে একটা সমাধানে আসা।

আওয়ার ইসলাম : মাওলানা সাদ সাহেবের শরিয়ত বহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে শোধরানোর উদ্দেশ্যে দারুল উলুম দেওবন্দ এবং সাদ সাহেবের মধ্যে চিঠি আদান প্রদান হয়েছে। সাদ সাহেবের ব্যাপারে দারুল উলুমের সর্বশেষ বক্তব্য কী?

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ: মাওলানা সাদ সাহেব কর্তৃক প্রকাশিত বিতর্কিত আলোচনা শোধরানোর জন্য দারুল উলুম তার কাছে চিঠি পাঠিয়েছে, লোক পাঠিয়েছে তার পরেও তিনি তার বক্তব্যকে ঠিক করেননি বরং এখনো করে চলেছেন। একাধিকবার দারুল উলুম চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার পর হাল ছেড়ে দিয়েছে। বর্তমানে তাকে আল্লাহর হাওয়ালা করে দিয়েছেন এবং তার উপর নারাজ রয়েছেন।

আওয়ার ইসলাম : আমাদের কাছে একটি চিঠি এসেছে, যেখানে দারুল উলুম দেওবন্দ সাদ সাহেবের ব্যাপারে এতমেনানে কলব ইজহার বা পুরোপুরি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। সাদ সাহেবও বলেছেন, আমি আমার বক্তব্য থেকে রুজু করছি এবং ভবিষ্যতে আর এমন বক্তব্য না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করলাম...

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদএজন্য, আমি উত্তরার পরামর্শ সভায় একটা কথা বলেছি, তিনি নতুন নতুন বিতর্কিত বিষয়ের অবতারণা করছেন। এটা তো তাবলীগওয়ালার কাজ নয়, তার কাজ ছিল দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করে যাওয়া।

কুরআনের ব্যাখ্যা দেওয়া তাবলীগের ধারা না, মাসয়ালা-মাসায়েল প্রদান করাও তাবলীগের কাজ না। কিন্তু তিনিএসব করেই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। তিনি যদি তাবলীগের অন্যান্য মুরুব্বিদের মত মুকাল্লিদ হয়ে দারুল উলুম ও ওলামায়ে কেরামকে সম্মান জানিয়ে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ আঞ্জাম দিয়ে আসতেন তাহলে তো আর তার ব্যাপারে কোন আপত্তি থাকত না।

আপনি যেই চিঠির ব্যাপারে বলছেন, আমার কাছে সেই চিঠি নেই ।

আওয়ার ইসলাম : দারুল উলুম দেওবন্দ কাউকে নিষ্পাপ বললেই তো আর নিষ্পাপ হবে না কিংবা মাফ করে দিলেই তো আর মাফ হবে না, যদি না তা সিস্টেম অনুযায়ী হয়। মাওলানা সাদ সাহেব যদি বিতর্কিত বিষয়গুলো প্রত্যাহার করে থাকেন সেটা একটা বিষয়। দ্বিতীয় বিষয় হলো তিনি যদি শরিয়ত বিরোধী কোন বক্তব্য দিয়ে থাকেন এবং নিজেকে তাবলীগ জামাতের বিশ্ব আমির দাবি করে থাকেন তাহলে বিশ্বের অন্যান্য ইলমি এদারাগুলো যেমন মদিনা ইউনিভার্সিটি থেকে শুরু করে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় তারা কেন সাদ সাহেবের বিরুদ্ধে কোন কথা বলছেন না।

শুধু দারুল উলুম দেওবন্দ থেকেই কেন তার ব্যাপারে আপত্তি তোলা হচ্ছে? অথচ, অন্যান্য দেশগুলোতেও তো তাবলীগের কাজ চলে, সেসব দেশেও তো তাবলিগের অগণিত সাথী আছে…। শুধু দেওবন্দ থেকে আপত্তি আসার পেছনে বিশেষ কোন কারণ আছে কী? বা রাজনৈতিক দর্শনের কোন সমস্যা আছে?

মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ: এ পর্যন্ত কোন বিশেষ কারণ আমি খুঁজে পাইনি। আমরা বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরাম নিজেদের উদ্যোগে ঈমানের তাগিদে কাকরাইল গেছি এবং আলোচনা করেছি। আমাদের তো কোন ব্যক্তি উদ্বুদ্ধ করেনি।

বিশ্বের অন্যান্য ইলমী এদারাগুলো এ বিষয়ে বক্তব্য না দেওয়ার একটি বড় কারণ হলো, অন্যান্য দেশের এদারাগুলো রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা আছে আর তাবলীগ তাদের দেশে এভাবে চলে না। ফ্রি ভাবে তাবলীগ চলে আমাদের উপমহাদেশে।

ঐ সমস্ত দেশে তাবলীগ চলে না একথা বলা আমার উদ্দেশ্য না, আমাদের দেশে তাবলীগ যতটা পরিচিত, যতটুকু কাজ আমাদের দেশে হয় ততটা সেখানে হয় না। তারা সব কথা জানেও না। কিন্তু বিষয়টা হলো তাবলীগ আমাদের।

[আলেমদের সঙ্গে তাবলীগের শূরার সম্মিলন দাওয়াতের কাজকে বেগবান করবে]

হজরতজি ইলিয়াস রহ. দারুল উলুম দেওবন্দের সন্তান। আর দেওবন্দের চারটি কাজ ছিল। তার মধ্যে একটা ইসলাম প্রচার, দীনের প্রসার। আর ইলিয়াস রহ. তাবলীগের মাধ্যমে দেওবন্দের সেই উদ্দেশ্যকে পূরণ করছিলেন তাই এ ব্যাপারে কিছু হলে আমাদের মাথাব্যথা সবার আগে হবে এটাই স্বাভাবিক।

তবে সম্প্রতি ঢাকার যাত্রাবাড়ি মাদরাসায় হজরত উলামায়ে কেরামকে উপদেষ্টা করে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে- সত্যিই তা ইলহামি। আমি মনে করি, কাকরাইলের শূরা ও হজরত উলামায়ে কেরাম একসাথে বসলে এসব ছোটখাটো সমস্যা দূর হয়ে যাবে এবং তাবলিগ তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাবে।

অনুলিখন করেছেন রকিব মুহাম্মদ


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ