শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫


বিজ্ঞানের ফর্মূলা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে কী করণীয়?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি মুহাম্মাদ রাশিদুল হক
অতিথি লেখক

মহান স্রষ্টার অপরিসীম শক্তি বলে মহাবিশ্ব অস্তিত্ব লাভ করেছে। জানা-অজানা অসংখ্য সৃষ্টিকুলের মধ্যে মানবজাতি হল সর্বশ্রেষ্ঠ। সৃষ্টির একটি অংশ প্রাণহীন জড়। অপর অংশে সৃষ্টিকর্তা প্রাণের সঞ্চার করেছেন।

প্রাণের আবার রয়েছে তিনটি স্তর। প্রথম স্তরে রয়েছে বৃক্ষরাজী। প্রাণ থাকলেও এগুলো সেচ্ছায় চলাফেরা ও নড়াচড়া করতে পারে না। অধিকন্তু এদের বাকশক্তিও নেই।

দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে মানব জাতি ছাড়া অন্যসব পশু-পাখি, কীটপতঙ্গ প্রভৃতি। ইন্দ্রিয় ও বাকশক্তি উভয়টি এদের রয়েছে। তৃতীয় ও সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে মানবজাতি।

উল্লেখিত শক্তিগুলো ছাড়াও আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে আরও একটি নিয়ামত প্রদান করেছেন এ কারনেই মানুষের জীবন পরিপূর্ণ ও সর্বোৎকৃষ্ট। সে নিয়ামতের নাম বিবেক বা ‘আকল’।

জ্ঞানার্জনের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষকে কয়েকটি মাধ্যম প্রদান করেছেন। এর প্রত্যেকটির নিজ নিজ গণ্ডি ও সীমারেখা রয়েছে। এগুলো নির্ধারিত পরিমণ্ডলে সঠিকভাবে ব্যবহার করলে মানুষ তা থেকে আশানুরূপ উপকৃত হতে পারে। তবে নিজ পরিসীমার বাইরে এগুলোর কোন কার্যক্ষমতা নেই।

জ্ঞানার্জনের প্রথম মাধ্যম
যেসব অঙ্গ বা শক্তির দ্বারা পদার্থের বা বাহ্য বিষয়ের উপলব্ধি বা জ্ঞান জন্মে এবং কর্ম সাধন করা যায় তাকে ইন্দ্রিয় বলে। চৌদ্দটি ধারার এই ইন্দ্রিয় শক্তির প্রথম পাঁচটি যথা চক্ষু, কর্ণ, নাসিক, জিহ্বা ও ত্বক কে বলা হয় জ্ঞানেন্দ্রিয়।

এর প্রত্যেকটির মাধ্যমে মানুষ অসংখ্য জ্ঞান অর্জন করে থাকে। এগুলোর কাজ যেমন ভিন্ন ভিন্ন তদ্রুপ তার কর্মক্ষেত্র (Jurisdicton) পৃথক পৃথক । চোখ দিয়ে শুধু দেখাই সম্ভব। শ্রবণ করা আদৌ সম্ভব নয়।

তদ্রুপ নাক দিয়ে শুধু ঘ্রাণ নেয়াই সম্ভব। দেখা সম্ভব নয়। কেউ যদি চোখ বন্ধ করে কান দিয়ে দেখার চেষ্টা করে, তাহলে মানব সমাজে সে নির্বোধ বিবেচিত হবে। কারণ সে ইন্দ্রিয় শক্তিগুলোর কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে অবগত নয়।

জ্ঞানার্জনের দ্বিতীয় মাধ্যম
তথ্য ও উপাত্ত প্রদানের ক্ষেত্রে জ্ঞানেন্দ্রিয়ের দৌড় যেখানে শেষ জ্ঞানার্জনের দ্বিতীয় মাধ্যমের কাজ সেখান থেকে শুরু। তার নাম ‘আকল’ বা ‘বিবেক’।

একটি বই যদি আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়, তাহলে চোখে দেখে আমরা তার আকার আকৃতি উপলব্ধি করতে পারি। হাতে ধরে এর ওজন বুঝতে পারি। তবে বইটি অস্তিত্ব লাভ করল কিভাবে-

জ্ঞানেন্দ্রিয়ের কোনটি আমাদের সে তথ্য সরবরাহ করে না। আর এ ক্ষমতাও এদের নেই। এ বিষয়টি উপলব্ধি করার জন্য আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের ‘বিবেক’ বা ‘আকল’ প্রদান করেছেন। তা দ্বারা আমরা বুঝতে পারি, বইটির একজন লেখক রয়েছেন। একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এটিকে বাজারজাত করেছে । এমনিতেই বইটি অস্তিত্ব লাভ করতে পারেনি।

সুতরাং বুঝা গেল, যে স্থনে জ্ঞানেন্দ্রিয়ের দৌড় শেষ ঠিক সেই স্থান থেকেই ‘আকল’ বা বিবেকের কাজের সূচনা।

তবে মনে রাখতে হবে, জ্ঞানেন্দ্রিয়ের মত আকলের কার্যসীমাও অসীম নয়। তারও একটি সীমিত কার্যক্ষেত্র রয়েছে। মানুষ যদি আকলের সীমার বাইরে একে ব্যবহার করতে চায় তাহলে সে ব্যর্থ হবে।

জ্ঞানের তৃত্বীয় মাধ্যম
আকলের কার্যসীমা যেখানে শেষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের তৃত্বীয় মাধ্যমের সূচনা সেখান থেকে। আর তা হল ‘অহি’ বা আসমানী জ্ঞান।

আকল দ্বারা যে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয় এমন সব জ্ঞান আল্লাহ তা‘আলা অহির মাধ্যমে মানুষকে প্রদান করেছেন । সুতরাং যেসব ক্ষেত্রে অহি নাজিল হয় তার সবক্ষেত্রে আকল ব্যবহার করা, শ্রবন করার জন্য চোখ ব্যবহার করার নামান্তর।

তবে তার অর্থ এই নয়, আকল একেবারে অকার্যকর। বরং আপন কার্যক্ষেত্রে ব্যবহার করলে অবশ্যই তা ফলদায়ক। স্বর্ণ পরিমাপের নিত্তি দিয়ে যদি কেউ বিশাল প্রস্তর খন্ড পরিমাপ করতে যায়, তাহলে নিক্তিটি ভেঙ্গে যাবে।

তার অর্থ এই নয় যে নিক্তিটি কাজের নয়। বরং এটিকে নিজ কার্যসীমার বাইরে ব্যবহার করা হয়েছে বিধায় এর এই দশা।

পরিবর্তনশীল বিজ্ঞান
ধারাবাহিক পর্যবেক্ষন ও গবেষণার ফলে কোন বিষয়ে প্রাপ্ত ব্যাপক ও বিশেষজ্ঞান, অন্য কথায় পরীক্ষা প্রমাণ প্রভৃতি দ্বারা নিরূপিত শৃঙ্খলাবদ্ধ জ্ঞানের অপর নাম বিজ্ঞান। নিঃসন্দেহে তা মানুষের মস্তিষ্ক প্রসুত জ্ঞান। যার বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা থেকে থাকে।

উপরন্ত তা পরিবর্তনশীল। নতুন নতুন গবেষণা পুরনো অনেক গবেষণা ও অভিজ্ঞতার ফলাফলকে ভুল ও অনেক ক্ষেত্রে হাস্যকর প্রমাণিত করে। এর অসংখ্য উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে।

তন্মেধ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানের কতিপয় প্রাচীন ও আধুনিক গবেষণার ফলাফল এবং এতদুভয়ের বৈপরীত্য উল্লেখযোগ্য।

এক. প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গ্রীক দার্শনীকদের মতে পৃথিবী হল মহাবিশ্বের কেন্দ্র । দুই. পৃথিবীর কোন গতি নেই, একেবারে স্থীর । তিন. আংটির মধ্যে মুক্তা এবং দেয়ালের গায়ে পেরেক যেমন গ্রথিত, সমস্ত গ্রহ পৃথিবীর চারিদিকে বেষ্টিত কঠিন পদার্থে সৃষ্ট আকাশের গায়ে ঠিক সেভাবে গ্রথিত।

চার. আকাশের নয়টি স্তর রয়েছে। এর প্রতিটি স্বচ্ছ কাচেঁর মত । প্রত্যেকটির নিজস্ব গ্রহ নক্ষত্র রয়েছে। প্রথম আসমান পৃথিবীকে চতুর্দিক থেকে বেষ্টন করে রয়েছে।

এভাবে সবকটি আসমানকে বেষ্টন করে রেখেছে নবম আসমান। অনেকটা পেয়াজের খোসার স্তরের মত। সবকটি আসমান নিজ নিজ গ্রহ নক্ষত্রসহ প্রতি চব্বিশ ঘন্টায় পূর্ব থেকে পশ্চিমে একবার ঘুরে আসে। এ কারণে দিন রাত হয়।

পক্ষান্তরে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণা বলে, এক. মহা বিশ্বের কোন কেন্দ্র নেই। তবে সৌর জগতের কেন্দ্র হল সূর্য। দুই. পৃথিবীর একই সাথে দুটি গতি রয়েছে ; আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতি। তিন. সকল গ্রহ-নক্ষত্র মহাশূন্যে ভাসমান। চার. আহ্নিক গতির কারণে পৃথিবীর দিন রাত হয়।

পবিত্র কুরআনের বক্তব্য
وَالشَّمْسُ تَجْرِي لِمُسْتَقَرٍّ لَهَا

অর্থ: “সূর্য নিজ অবস্থানস্থল (গন্তব্য) এর দিকে চলতে থাকে”। আলোচ্য আয়াতে সূর্যের গন্তব্য বুঝানোর জন্য ‘মুস্তাকার’ শব্দ এসেছে। শব্দটির দুটি অর্থঃ এক. অবস্থানস্থল । দুই. অবস্থানকাল।

শব্দটি কখনও সফরের শেষসীমার অর্থেও ব্যবহৃত হয়। বিরতী না দিয়ে পুনরায় ভ্রমন শুরু করলেও শব্দটি উক্ত ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

অবস্থানকাল অর্থ হলে আয়াতের মর্ম হবে, সূর্য তার চলার নির্ধারিত সময় পর্যন্ত সন্তরণ করতে থাকবে। আর সেই সময়টি হল কেয়ামতের দিন। অর্থাৎ সূর্য একটি সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনায় নিজ কক্ষপথে পরিভ্রমন করছে।

এক মুহূর্তের জন্যও এতে হেরফের হয় না। তবে সূর্যের এই চলা অনন্তকালের জন্য নয়। বরং তার একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। যখন তার গতি স্তব্ধ হায়ে যাবে। সেটা হচ্ছে কেয়ামতের দিন। এই তাফসীর বিখ্যাত তাবে‘ঈ হযরত কাতাদা রহ. থেকে বর্ণিত।

আর যদি ‘মুস্তাকার’ দ্বারা অবস্থানস্থল উদ্দেশ্য হয়, তাহলে মর্ম হবে, সূর্য সৃষ্টিলগ্ন থেকে তার কক্ষপথের যে স্থানটি থেকে আবর্তন শুরু করেছে, বৃত্তাকারে সেদিকেই সেটি চলতে থাকে। ঠিক সেখানে গিয়ে তার এক চক্কর শেষ হয়। এভাবে আবার দ্বিতীয় চক্কর শুরু হয়।

অপর আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে,
كُلٌّ فِي فَلَكٍ يَسْبَحُونَ

অর্থ: “সূর্য ও চন্দ্র নিজ নিজ কক্ষপক্ষে সন্তরণ করে।” (সূরা ইয়াছিনঃ ৪০) ‘ফালাক’ এর শাব্দিক অর্থ ‘আকাশ’ নয়, বরং যে কক্ষপথে গ্রহ নক্ষত্র বিচরণ করে তাকেই ‘ফালাক’ বলে।

সূরা আম্বিয়ায় এ আয়াত সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এর দ্বারা বোঝা যায় যে, চন্দ্র (ইত্যাদি) আকাশের গায়ে প্রথিত নয়। যেমনটি গ্রীক দার্শনীকদের মত। আধুনিক গবেষনা ও চাঁদে মানুষের গমন কুরআনে কারীমের বাণীকে দ্বিতীয়বার বাস্তব প্রমানিত করেছে। ( মা‘আরেফুল কোরআন)

যে পথে আমরা চলবো
প্রায় পনের শত বছর পূর্বে কুরআন কারীম অবতীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এক্ষেত্রে কুরআনে কারীমের সাথে আধুনিক গবেষণার অপূর্ব মিল রয়েছে। অনুরূপভাবে অসংখ্য আধুনিক গবেষণার ফলাফল কুরআন মাজীদের সাথে মিলে যায়।

আবার কিছু গবেষণার অমিলও পরিলক্ষিত হয়। এ সকল ক্ষেত্রে কুরআন মজীদের ভাষ্যকেই বিশ্বাস করতে হবে। কারণ মানুষের গবেষণার মধ্যে ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। হতে পারে ভবিষ্যতের কোন গবেষণা পূর্বেরটিকে ভুল প্রমাণিত করবে।

পক্ষান্তরে কুরআনে কারীম আসমানী অহি। তা আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই । সুতরাং এমন কিতাবের মধ্যে ভুলের অবকাশ থাকতেই পারে না। আর নির্ভুল বিষয়ই সর্বাগ্রে গ্রহণীয়।

আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশ্বে বসবাস করছি। গোটা বিশ্ব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নতি সাধনে ব্যস্ত। কিন্তু আমাদের কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফ আমাদেরকে তথ্য প্রযুক্তির কোন ফর্মূলা শিক্ষা দেয় না।

পারমাণবিক ও হাইড্রোজেন বোমা তৈরির ফর্মূলা আমরা কুরআন মজীদ ও হাদীস শরীফে পাই না । মানুষ আজ চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহ জয় করেছে।

কিন্তু কুরআন আমাদের সেখানে পৌঁছার পদ্ধতি বাতলে দেয় না। কারণ এগুলি হল আকলের কর্মক্ষেত্রের অন্তর্ভূক্ত।

আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষকে যে মেধা দান করেছেন যথাযথভাবে তা ব্যবহার করলেই মানুষ প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে সক্ষম হবে। মানুষের মেধা-মনন, বুদ্ধি-বিবেক প্রয়োগের সীমা যেখানে শেষ, পূর্ণ বিবেক খাটিয়ে মানুষ যে সব বিষয় বুঝে উঠতে সক্ষম হয় না, কুরআন মজীদ আমাদের সেসব বিষয়ের শিক্ষা দেয়।

সুতরাং কুরআন মজীদ যে দ্বীনের ধর্মগ্রন্থ তার পূর্ণ অনুসরণে নিজেকে অর্পণ করে দেয়াই বিবেকের দাবী।

লেখক: মুহাদ্দিস, গবেষক

লেখকের আরও লেখা

যেভাবে শহীদ হন হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রা.


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ