মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৩ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ৭ শাওয়াল ১৪৪৫


কওমি স্বীকৃতির বাস্তবায়ন: বিভ্রান্তির ৫ কারণ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

হুমায়ুন আইয়ুব
সম্পাদক

গণমাধ্যমে কাজ করার ফলে কারও চোখে ভালো থাকা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্য উচ্চারণ বরাবরই কঠিন। সত্য আসলেও তিতা। তবুও সব সত্য সংবাদকর্মীরা বলেন না বা বলতে পারেন না। সীমাবদ্ধতা সব ক্ষেত্রেই কমবেশি আছে। আমিও এই বৃত্তের বাইরে নই।

কওমি মাদরাসা শিক্ষা সনদের স্বীকৃতির ইস্যুটি রাখাইনে রোহিঙ্গাদের চেয়ে আমাদের জন্য কম বিপদজনক নয়। বিষয়টি আলোচনায় এলেই নতুন নতুন জটিলতা ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তরিকভাবে আলেমদের আদর-আপ্যায়ন করে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ৩২ সদস্যের কমিটিও করেছেন। বলেছেন, যে কয়টি বিষয়ে আপনারা একমত হবেন, সেগুলো আমরা আইন করে পাশ করে দেব। আলেমরাই কওমি মাদরাসার কারিকুলাম, আইন ইত্যাদি তৈরি করবেন।

দীর্ঘ কয়েক মাস হলো এ ঘোষণার। প্রজ্ঞাপন হলো। আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়্যা বাংলাদেশ- মানে ৩২ সদস্যের কমিটি চূড়ান্ত হলো। অফিস হলো, জনবল নিয়োগ হলো, সবগুলো বোর্ড একই প্রশ্নপত্রে প্রথম বারের মতো পরীক্ষা গ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশ করলো। চলছে সাময়িক সনদ বিতরণও।

আলহামদুলিল্লাহ, সবা ঠিকঠাক হচ্ছে। হঠাৎ আবার স্বীকৃতি ইস্যুতে বিভ্রান্তি দেখা দিলো কেন?
প্রথম কথা হলো, সম্প্রতি হাইয়াতুল উলইয়া (কওমি মাদরাসা সর্বোচ্চ অথরিটি) পরিচালনার জন্য যে খসড়া গঠনতন্ত্রটি তৈরি করা হয়েছে তা কি ৩২ সদস্যের কমিটিতে অনুমোদিত নয়? নিশ্চয় আলোচনা-পর্যালোচনা করে গঠনতন্ত্রটি নিজেরা তৈরি করেছেন। তাহলে বিভ্রান্তি কেন?

গঠনতন্ত্রের খসড়া প্রস্তাবনাটি আমিও পড়েছি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথাও বলেছি। চারদিকে হাহুতাশ ও বিভ্রান্তির ডালপালাও দেখছি। নীতি নির্ধারণী আলেমরা ইচ্ছা করলেই বিভ্রান্তির কারণ বের করতে পারেন আর সমাধানও করতে পারেন।

তবুও আমার চিন্তার জায়গা থেকে বলি, বিভ্রান্তির কারণটা হাইয়াতুল উলইয়ার ভিতরে-বাইরে দুজায়গা থেকেই তৈরি হয়েছে। কমিটির একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বলছেন-

১. খসড়াটি প্রস্তুতকালে আমরা ছিলাম না। খসড়া প্রস্তুতের বিষয়টি আমরা জানতামও না। হঠাৎ মিটিংয়ে উত্থাপন করে অনুমোদন করা হয়। প্রশ্ন হলো, বাবার তো জানা থাকা চাই- তিনি বাবা হচ্ছেন! নইলে তো বিভ্রান্তি এড়ানো আসলেও দায়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, খসড়া অনুমোদনের আগে ‘খসড়া প্রস্তুত কমিটি’র অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। অনুমোদিত গঠনতন্ত্রের খসড়া তৈরির আগে রেজুলেশনে খসড়া প্রণয়ন কমিটি কেন করা হয়নি?

তখন আর প্রশ্ন করা হত না- এই খসড়া কারা করল? কখন করল? কেন করল? আমরা তো কিছুই জানি না।

২. হাইয়াতুল উলয়ার ৩২ সদস্যই পুরো খসড়াটির বিষয়ে একমত আছে বলে মনে হয় না। কারণ একাধিক সদস্য আমাদের কাছে তাদের ক্ষোভ দুঃখ ও দ্বিমতের কথা প্রকাশ করেছেন।

৩. বিভ্রান্তি তৈরির আরও একটি বড় কেন্দ্র- মতামত গ্রহণ না করা। ৩২ সদস্যের কমিটি কওমি মাদরাসা সনদের মূল অথরিটি। কোনও সন্দেহ নেই- শীর্ষ এই আলেমদের মতামতই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। তবে তারা মূলশক্তি হলেও সহযোগী শক্তি- দেশের কওমি মাদরাসার দুই কোটি ছাত্র শিক্ষক ও বিদগ্ধ আলেম উলামা।

হাইয়াতুল উলইয়া পুরো জাতির ভবিষ্যত নির্ধারণে এত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করলেন, অথচ কওমি মাদরাসা সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বা হাইয়াতুল উলইয়ার বাইরের শিক্ষা ও আইন সচেতন আলেমদের মতামত নিতে পারতেন! তখন তাদের উদারতাও প্রকাশ পেতো। জবাবদিহিতার জায়গাটিও স্পষ্ট হতো। উদ্যোগটি প্রশ্নের সম্মুখিনও হতো না।

৪. তাছাড়া স্বীকৃতির বিষয়টি যেহেতু বারবার হোঁচট খাচ্ছে- খসড়া তৈরি করে মতামতের জন্য সেটি উন্মুক্ত করে দেওয়াও উচিত ছিল। প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত, মতামত এলে গ্রহণ করা বা না করা তো হাইয়াতুল উলইয়ার এখতিয়ার।

এ জাতীয় স্পর্শকাতর বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত মতামত গ্রহণ করা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু হাইয়াতুল উলইয়া নিজেদের গঠনতন্ত্রের এই পূর্ব প্রস্তুতি ও জবাবদিহিতার জায়গাটির প্রতি মনোযোগ না দিয়ে বিভ্রান্তির পথকে খুলে দিয়েছে বলেই মনে হয়।

বিষয়টি নিয়ে হাইয়াতুল উলইয়ার নেতৃবৃন্দ আরও বিচক্ষণ ও জবাবদিহিতামূলক আচরণ করলে কওমি সন্তানদের পাশে পাবে। সরকারের স্বদিচ্ছার ফলাফলও ঘরে তুলতে পারবে।

যদি কাজগুলো বাস্তবায়নে আলো আধারি কিংবা ব্যক্তি বিশেষের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে তাহলে পুরো কওমি সমাজ সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেও সময় নিবে না। তাই পুরো কওমি মাদরাসার চিন্তা চেতনাধারী সবার মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে সরকারকেও স্পষ্ট ও দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

৫. খসড়া প্রণয়নের প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো না করেই হাইয়াতুল উলইয়ার নেতৃবৃন্দ সরকারের মঞ্জুরি কমিশন, স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য সরকার থেকে জমি গ্রহণ ও গোপনীয় সলাপরামর্শে যথেষ্ট মনোযোগী হয়েছে। সবার উন্মুক্ত মতামত সাপেক্ষে সরকারের স্বাভাবিক নিয়মতান্ত্রিকতায় মনোযোগী হলে এত জল ঘোলা হতো না।

তাই নীতি নির্ধারণী আলেমদের কাছে বিনীত অনুরোধ থাকবে- প্রতিটি পদক্ষেপ আরও বিচক্ষণতা, সতর্কতা ও জবাবদিহিতামূলক হোক।

নিজেদের বৈঠকে খসড়া অনুমোদিত হওয়ার পর নতুন ৯ সদস্যের কমিটির সেখানে বিতর্কিত লোকদের জায়গা হওয়া ও কোনো আলেম না থাকা, কওমি মাদরাসাকে আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দিয়ে দেয়া ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আলেমরা চোখ রাখছেন। বিষয়গুলো নিয়ে পরেও কথা বলা যাবে।

তবে বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য খসড়া অনুমোদনের আগের বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট করার প্রয়োজন মনে করছি।

আলিয়া ও কওমি মাদরাসার আধুনিকায়নে আরবি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমতি

কওমি শিক্ষা সনদের চলমান প্রক্রিয়া নিয়ে আলেমদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ