মুফতি মুহাম্মদ আমিমুল ইহসান
হযরত শায়খুল হাদিস রহ.-এর পারিবারিক জীবনের সবিশেষ উল্লেখযোগ্য দিকটি শুধু অভিনব ও বিস্ময়করই নয় বরং এ একটি নতুন ইতিহাস।
এ ইতিহাস জেনে এবং -এর যথাযথ অনুসরণ করে বিশেষভাবে তার ছাত্ররা এবং সাধারণভাবে অন্যান্য দীনদার মহল ইহকাল ও পরকালের সফলতার দিকনির্দেশনা পেতে পারেন।
সংক্ষেপে তার পরিবারের ইতিহাস হলো, তার ছেলে মেয়ে এবং তাদের উভয় দিকের নাতি-নাতনি ও নাতি পুতির মোট সংখ্যা প্রায় ১৫০ জনের মতো (২০১২ তথ্য অনুযায়ী) এবং তার নিজের ২ স্ত্রী এবং ছেলে ও নাতিদের বউ এবং মেয়ে ও নাতনিদের জামাতাসহ সর্বমোট সংখ্যা ১৭০ এর মতো। তিনি প্রথম ২ মেয়েকে আরবি, উর্দু ও বাংলা শিক্ষা দেন। অতঃপর তৃতীয় মেয়েকে পরীক্ষামূলকভাবে হিফজ পড়তে দেন। দেখা গেল মেয়েটি ছেলেদের চেয়েও দ্রুতগতিতে কালামে পাকের হেফজ সমাপ্ত করে এবং সফলভাবে হিফজ রক্ষা করতে থাকে। এরপর থেকেই তিনি তার ছেলে হোক, মেয়ে হোক সকলকে হেফজ পড়তে দেন এবং তা সমাপ্ত করার পর ছেলেদের মাদরাসায় কিতাবি লাইনে আলেম বানাতে থাকেন এবং মেয়েদের উর্দু ও বাংলার মাধ্যমে দীনি শিক্ষা দিতে থাকেন। আর পবিত্র রমযান মাসের আগমনে তার ঘরে মেয়েদের খতমে তারাবিহ এবং বড় ছেলেরা মসজিদে বা ঘরে জামাত করে তারাবিহ পড়ায়।
আর মেয়ে ও নাতনিদের কেউ বাড়িতে কেউ শ্বশুরালয়ে আলাদাভাবে খতমে তারাবিহ পড়ছেন। সে এক আজীব ও হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য।
মাশাআল্লাহ, বর্তমানে শায়খের সন্তান-সন্তুতি ও বংশধরদের মধ্যে হাফেজ ও হাফেজার সংখ্যা ৭৫ জনের মতো। আধা হাফেজ ও হেফজের সবকে রয়েছে বেশ কয়েকজন শিশু। অর্থাৎ, তিনি তার সন্তান সন্ততির সকলকে হাফেজ বা হাফেজা বানাতে প্রত্যেকের পিতামাতাকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করে গেছেন। ফলে তার আওলাদদের মধ্যে ছেলেদের তো কথাই নেই, মেয়েদের বা নাতনিদের সংসারে অর্থাৎ, স্বামীদের বাড়িতেও তাদের সন্তানদের হাফেজ হাফেজা ও আলেম হওয়ার পথ তৈরি হয়ে গেছে।
আলহামদুল্লিাহ। হযরত শায়খের ছেলেমেয়ে যে কারো গর্ভে যে সন্তানই জন্ম নিবে, তাকে প্রথমে আল্লাহ চাহেন তো হাফেজ বা হাফেজা বানাতে হবে। তাই দেখা যায়, শায়খের আওলাদের মধ্যকার মেয়েকে যিনি বিয়ে করেন তিনি বস্তুতই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে গেলেন, তার ভবিষ্যত সন্তানকে স্কুলে না দিয়ে হিফজ ও দীনি লাইনে পড়াবেন।
হযরত শায়খের জীবদ্দশায় তার অন্যতম ওসিয়ত এই যে, ‘আমার বর্তমান আওলাদদের যে কারও ঘরে ভবিষ্যতে ছেলে হোক বা মেয়ে, তাকে অবশ্যই হাফেজ বা হাফেজা বানাবে। তারপর ছেলেকে আলেম বানাবে ও মেয়েকে দীনি কিতাবাদি পড়াবে। সম্ভব হলে আরবি শিক্ষা দিয়ে আলেমা বানাবে। কিন্তু কখনও কাউকে স্কুল-কলেজে পড়াবে না’। কারণ, একে তো বর্তমানকালে স্কুল-কলেজ- ইউনিভার্সিটি পড়িয়ে ছেলেমেয়ের ঈমান-আকিদা ও আমলাদি ঠিক রাখাই মুশকিল। দ্বিতীয়ত পবিত্র কুরআন-হাদিস ওহির ইলেম হিসাবে এর চেয়ে বড় সম্পদ।
আল্লামা ইউসুফ কারযাভিকে সালমান নদভির চিঠি
দুনিয়াতে আর কিছু নেই। প্রতি বছর দু’এক বার হযরত শায়খ তার আওলাদদের নিয়ে বসতেন এবং এ ওসিয়ত নবায়ন করতেন। বিশেষত প্রতি রমযান মাসে তার আওলাদদের ঘরে ঘরে খতমে তারাবিহ শেষে ২৯ শে রমযানের রাতে তাকে কেন্দ্র করে এক সম্মেলন। পবিত্র রমযানে তার মেয়ে আওলাদরা তারাবির নামাযে সাধারণত দু’খতম এমনকি কেউ কেউ তিন খতমও করে থাকেন। এর জন্য পড়তে হয় কত খতম তা সহজেই অনুমেয়।
তার আওলাদদের মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, রমযানের শেষ দশকের রাতগুলি তারা তেলাওয়াত, সালাতুত তাসবিহ, তাহাজ্জুদ, যিকির-আযকারসহ খতমের পর খতম পড়ে রাত্রি জাগরণ করে থাকে। এভাবে ২১,২৩,২৫,২৭ ও ২৯ শে রমযান সারারাত তারা ছোট বড় ছেলেমেয়ে সকলেই ইবাদত বন্দেগী করে কাটান। যাতে আল্লাহ তায়ালার রহমতে শবে কদর পাওয়ার সৌভাগ্য সকলেরই হাসিল হয়। সে রাতগুলিতে তাদের শিশুরা পর্যন্ত আনন্দ খুশিতে পিতা-মাতা ও বড় ভাইবোনদের সঙ্গে সজাগ থাকে। আনন্দের আতিশয্যে তার ছোট ছোট নাতি-নাতনিরা বলত, আজকে রাতে আমরা দাদার, নানার, কেউ বলত, বড় আব্বার ওয়াজ শুনব, দোয়া করব ও মিষ্টি খাব।
এমনি করে দেখতে দেখতে ২৯ রাত এসে যেত এবং সেই আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। পুরুষ ও ছেলেরা যথারীতি এশার নামায মসজিদে জামাতে আদায় করে বাসায় এসে যেত এবং হযরত শায়খকে নিয়ে তারাবির নামাযে দাঁড়িয়ে যেত। মাইকের ব্যবস্থা থাকত এবং ডান ও বাম দিকের ঘরগুলিতে শ্রদ্ধেয়া স্ত্রী তার মেয়েদের ও নাতনী-পুতনীদেরসহ তারাবির জামাতে শরিক হতেন। পারিবারিক খতমের এই শেষ রাতে হযরত শায়খের ছেলে ও নাতীদের মধ্য থেকে কয়েকজন দুই দুই রাকাত করে ইমামতি করত। আর তিনি শুনতে থাকতেন, কে কেমন পড়ে এবং সালামের পরই তেলাওয়াত ও নামাযের ধরণ সম্পর্কে শফকতপূর্ণ নসিহত করতেন। সেই সঙ্গে মেয়ে ও নাতনিদের খবর নেন, কে কত খতম পড়েছে পবিত্র রমযানে। মহিলাদের মধ্যে যারা হাফেজা নন, তাদেরও কেউ কেউ রমযান মাসে দশ খতম কুরআন পড়েছেন বলে শোনা গেছে। নামায বাদ তাকে মধ্যবর্তী এমন একটি স্থানে বসানো হতো, যেখানে তাকে পুরুষ ও মহিলারা সকলেই দেখতে পেতেন।
শুধু তারই পরিবারভুক্ত সদস্যদের নিয়ে এই সমাবেশ হত বলে সবারই মাহরাম ছিলেন তিনি। অবশ্য আওলাদদের মধ্যে মাহরাম ও গাইরে মাহরামের ব্যাপার থাকত বলে তাদের বসার স্থান পূর্ব থেকেই এরূপ করা হতো যেন কোনোক্রমেই গাইরে মাহরামদের কেউ কাউকে দেখতে না পায়।
দোয়ার এ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাটিই এরূপ ছিল যে, সবার জন্য এ এক শিক্ষণীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এরপর শায়খুল হাদিস সাহেব রহ. সংক্ষিপ্ত বয়ান করতেন। তার পূর্বোক্ত ওসিয়তের নবায়ন করতেন এবং তার পারিবারিক এ দৌলতকে ধরে রাখার জন্য নসিহত করতেন।
সর্বোপরি আল্লাহ তায়ালা যে একমাত্র তারই অনুগ্রহ ও রহমতে এ বিরল নেয়ামত তাদের দান করেছেন, এ জন্য সর্বদা তার শুকরিয়া আদায়ের জন্য এবং নিজেদের কোনো ত্রুটি অর্থাৎ বড়াই, অহমিকা বা আত্মখুশির কারণে এ নেয়ামত ছিনিয়ে নেয়া না হয় সে জন্য তার প্রতি নিবেদিত প্রাণ হয়ে থাকা ও আজীবন সেজদাবনত হয়ে থাকার জন্য উপদেশ দান করতেন। এ সময় থেকেই হযরত শায়খ রহ. ক্রমান্বয়ে ভাবাবেগে অশ্রুসিক্ত হয়ে যেতেন। সঙ্গে সঙ্গে তার আওলাদদেরও এরূপ অবস্থা দেখা যেত। তারপর রাহমানুর রাহিমের হুজুরের মুনাজাতের জন্য হাত উঠানোর সঙ্গে সঙ্গে আওলাদদের সকলেই রোনাযারি শুরু করে দিত। সে এক অপূর্ব দৃশ্য।
হযরত শায়খের উল্লেখযোগ্য ও হৃদয়স্পর্শী দোয়ার ধরণখানি সংক্ষেপে এরূপ হত : আয় আল্লাহ! তুমি রহমান, তুমি রাহিম। তোমারই কৃপা ও অনুগ্রহে এই নেয়ামত অর্থাৎ, দীনদারী ও কালামে পাকের হিফজ ও দীনি ইলম হাসিলের সৌভাগ্য আমাদের দান করেছ। এতে আমাদের কোনোই কৃতিত্ব নেই; বরং আমাদের ধারণা চিন্তার বাইরে তুমি নিজ পক্ষ থেকে আমাদের তুমি তোমারই খাস রহমতে যেমন ফলে ফুলে সজ্জিত এ বাগান আমাকে দান করেছ তেমনি-এর হেফাজতের জন্যও আমরা তোমারই দয়া ও রহমতের মুখাপেক্ষী। আয় আল্লাহ! তুমি তোমার নিজ রহমতে ও তোমার হাবিবের তোফায়েলে আমাদের এ নেয়ামত কেয়ামত কাল পর্যন্ত দায়েম ও কায়েম রাখ।’ এ সময় হযরত শায়খ ও তার আওলাদদের হৃদয়স্পর্শী কান্নায় ও রোনাযারিতে ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠত।
উল্লেখ্য, তার উক্ত হিফজ বাগানের ফল ওফাতের পর থেকেই তিনি ভোগ করতে শুরু করেছেন। তার সওয়াব রেসানীর জন্য তার হাফেজ আওলাদদের মধ্য থেকে দৈনিক এক খতম ও মেয়েদের পক্ষ থেকে এক খতম মোট দু’খতমের সওয়াব তার রুহের মাগফিরাতের জন্য রোজানা আল্লাহর দরবারে পেশ করা হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ এই সিলসিলা চলতে থাকবে এবং পরবর্তী আওলাদদের মধ্যে হাফেজ হাফেজার সংখ্যা বাড়তে থাকলে শায়খ রহ.-এর সওয়াবের ভাগও বাড়তে থাকবে। আল্লাহ তায়ালা কবুল করুন।
উল্লেখ্য, শায়েখের বড় ছেলে মুফতি মাহবুবুল হক বলেছেন এই পরিবারের বর্তমানে হাফেজের সংখ্যা ১০০ এর উপরে।
তথ্যসূত্র : রহমানী পয়গাম, শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. স্মরণ সংখ্যা। অক্টোবর-নভেম্বর : ২০১২/ ২০৪ ৩ম সংখ্যা/ পৃ. ৫১, কৃতজ্ঞতা : অধ্যাপক মাওলানা গিয়াসুদ্দিন আহমদ হাফিযাহুল্লাহ, শায়খের বড় জামাতা।
এসএস