মুহাম্মদ নাজমুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, দারুল উলূম দেওবন্দ, ভারত
হযরত কাসিম নানুতবি রহ.। আসল নাম খোরশিদ হাসান। তিনি ১২৪৮ হিজরিতে শাওলা মাসে সাহরানপুর জেলার প্রসিদ্ধ এলাকা নানুতাহ থানায় জন্মগ্রহণ করেন। কাসিম নানুতবির বাবার নাম 'আসাদ আলী বিন' গোলাম শাহ। তার পিতা ছিলেন নেহায়েত একজন ভদ্র, দিনদার ও নেককার ব্যক্তি। হযরত নানুতবি রহ. শৈশব থেকেই ছিলেন ভাগ্যবান ও প্রখর মেধাবী।
তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন দেওবন্দ এলাকায়। এরপর ১২৬০ হিজরীতে মাওলানা মামলুক আলী রহ. এর সাথে দিল্লীতে সফর করেন। সেখানে শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. এর সাহেবজাদা শাহ আব্দুল গনী রহ. এর কাছে হাদিস অধ্যয়নের সৌভাগ্য লাভ করেন। এরপর তিনি শায়খুল মাশায়িখ হাজ্জি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কি রহ. এর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেন। তাঁর সোহবতে তাছাওউফ ও রিয়াযত মুজাহাদার পথে মেহনত করে খেলাফত লাভ করেন। এই আত্মিক সম্পর্ক হযরত কাসিম নানুতবির অন্তর্নিহিত যোগ্যতা আরো শানিত ও বিকশিত করে।
হযরত কাসিম নানুতবির সত্ত্বায় ছিলো অনুপম আখলাক ও পরিশীলিত মনন। তাঁর স্বভাবে ছিলো সীমাহীন বিনয় ও অতুলনীয় ইখলাছ। এক কথায় তিনি ছিলেন, ইলম-আমল ও তাকওয়া পরহেজগারিতে সর্বোচ্চ স্তরের একজন বুযুর্গ। সমকালীন সময়ে তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও আপাদশীর আশেকে রাসূল সা.।
হযরতকে মহান আল্লাহ আরেকটি অসাধারণ নেয়ামত দান করেছিলেন। সেটা হলো মুনাযারা বা তর্ক করার যোগ্যতা।
হযরত নানুতবি আপন পীর ও মুর্শিদ হাজ্জি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কি রহ. এর নির্দেশনায় সঙ্গীদের নিয়ে বৃটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করেন। সঙ্গীরা হলেন ফকীহুন্ নাফস রশিদ আহমাদ গাংগুহি, মাওলানা ইয়াকুব নানুতুবি, হাকিমুল উম্মাত আশরাফ আলি থানভী ও হাফেজ জামেন শহীদ রহতুল্লাহি আলাইহিম।
স্বাধীনতা যুদ্ধে বিপর্যস্ত হবার পর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য হযরত কাসিম নানুতুবি দ্বিতীয় একটি পথ বেছে নেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। যে প্রতিষ্ঠান আজও পর্যন্ত অসংখ্য ব্যক্তিকে প্রকৃত ইলম নববি শিক্ষাদান করছে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে হাজারো তালিবুল ইলম দ্বীনের হাকিকী সমঝ হাসিল করেছে।
ইসলামি ইতিহাসে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠা এমন একটি উজ্জ্বল অধ্যায় যা সারা দুনিয়ায় যুগযুগ ধরে ইলম ও আমলের দীপ্তি ছড়িয়ে আসছে।
দেওবন্দ। বিশ্বের একমাত্র নিখুঁত এরাবিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ইলমে হাদীস ও ইলমে তাফসীরের মাকবূল এবং অনন্য দরসগাহ, আউলিয়ায়ে কেরাম এবং মাশায়িখে হিন্দের একমাত্র রুহানি দিক্ষাগার। হিন্দের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্র সৈনিকদের একমাত্র অবস্থান ক্ষেন্দ্রোই হলো 'দারুল উলূম দেওবন্দ'।
যে বিদ্যাপীঠকে 'আযহারে হিন্দ' বলে আখ্যা দেয়া হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে বলা হয় উলামা ও ফুযালাদের ইখলাস কা তাজমাহাল।
এখানেই শেষ নয়... তা এমন একটি বৃক্ষ, যেটাকে আল্লাহ প্রেমিকরা তারই ইশারা ও ইলহামের মাধ্যমেই তার উপর পূর্ণ ভরসা রেখেই একনিষ্ঠতা ও লিল্লাহিয়্যাতকে পূজি করে রূপণ করেছেন। যার শাখা প্রশাখা আজ সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিশ্বের রন্দ্রে রন্দ্রে ছড়িয়ে পড়ছে এবং পুরো জাতীকে বিলিয়ে দিচ্ছে তার সুবাস। আলোকিত করছে তার আলোয়। সেটি এমন এক চিন্তাচেতনার জ্ঞান সমুদ্র, যা নবুয়াতের বক্ষ থেকে প্রবাহ হয়ে সাহাবাদের বক্ষ বেয়ে হিন্দুস্তান এসে আল্লামা শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি'র বক্ষ গেসে আল্লামা কাসিম নানুতবি রাহ., আল্লামা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি রহ.আল্লামা ইয়াকূব নানুতবি রহ.'র মাধ্যমে দেওবন্দের পুস্পবাগানে এসে স্তম্ভিত হয়। যার নদীমালা হিন্দের সীমা অতিক্রম করে আজ বিশ্বের মানচিত্রে বিস্তৃত হয়ে আছে। আর সমগ্র বিশ্বের ইলম পিপাসুরা তার অথবা তার থেকে সৃষ্ট পেয়াল থেকে তাদের ইলমের পিপাসা নিবারণ করছে। যা আজও বিরাজমান। তাইতো এ প্রতিষ্ঠানকে একপলক দেখতে মানুষ ছুটে আসে বিশ্বের দিকদিগন্ত থেকে।
ছুটিতে, উৎসবে বা কোন এক ফাকে অবসর হয়ে নিজেদেরকে আনন্দ দিতে দেশ বিদেশের মুসলিম অমুসলিম, বাদশা-ফকির,দিনদার বেদীন, পুরুষ-মহিলা,বুড়ো-যুবক এবং শিশু পর্যটকরা দল বেঁধে অথবা একা একা ছুটে আসতে থাকে এ মাদরে ইলমিতে। এসে ঘুরে ঘুরে দেখে অনেক কিছু। মনকাড়া ডিজাইনের ভবনসমূহ, মসজিদ, ছাত্রাবাসহ আরো অনেক কিছু। সঙ্গে সঙ্গে সর্বপরি মহাথির উলামা হজরাত এবং ইলম পিপাসুদের সুন্নাতি লেবাস, অমায়িক চরিত্র, আদবী কথাবার্তা শুনে নিজেরা এ অনুভূতি প্রকাশ করতে বাধ্য হয় যে,
‘এখন পর্যন্ত (দেওবন্দ সম্পরর্কে)যা শুনেছিলাম তা কোনো উপন্যাস না, এবং এখন পর্যন্ত যা দেখলাম তা কোনো স্বপ্ন না’ এভাবেই অনেক গুনিজন এবং সাহিত্যিকের কলাম, প্রবন্ধ, ফিচার, গল্প উপন্যাস আর অনুভূতিতে চিত্রায়ন হয়েছে 'দারুল উলূম দেওবন্দের' স্মৃতিকথা। এই দারুল উলুমে দরস সমাপনকারী ছাত্রদের মধ্যে যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, হযরত শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী, আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশমিরী, আল্লামা শাব্বির আহমাদ উসমানি, সাইয়েদ হোসাইন আহমাদ মাদানী, মুফতি আজিজুর রহমান উসমানি, মুফতিয়ে আজম মুফতি শফী, মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী, মাওলানা ইদরিস কান্ধলভী প্রমুখ ইতিহাসখ্যাত ব্যক্তিত্বগণ। যারা নিখিল বিশ্বকে নিজেদের ইলম ও ফয়েজ দ্বারা আলোকিত করেছেন।
ইলম, আমল ও কুরবানি মুজাহাদার এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস রচনা করে এ বুজুর্গ এবং হযরত কাসিম নানুতবি নামক দ্বীনের সূর্য ১২৯৭হি, ৪ জমাদিউল আওয়াল, রোজ বৃহস্পতিবার অস্তমিত হয়।(ইন্না....রাজিউন।)
আল্লাহ তাকে জান্নাতের উঁচু স্থানে সমাসীন করুন।
সূত্র: তারিখে দারুল উলূম দেওবন্দ ইখলাস কা তাজমহল।
পূর্ববর্তীদের ও এখনকার রোজার বড় পার্থক্য ধরিয়ে দিলেন মাওলানা তারিক জামিল