রায়হান মুহাম্মদ ইবরাহীম : রাজনীতি নিয়ে পর্দার অন্তরালের অনেক খেলাই প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। ক্ষমতার রাজনীতির যারা ‘থিঙ্কট্যাংক’, ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং নতুন করে ক্ষমতার স্বাদ নেওয়ার কৌশল নির্ধারণে তারা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। ইসলামপন্থীরাও আছেন সে কৌশলী ছকের একটি বড় অংশজুড়ে। কারণ, কেউ স্বীকার করুক আর না করুক- ইসলামপন্থীরা দিনদিন ক্ষমতার রাজনীতির জন্য ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠছেন। ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে বা আবার ক্ষমতায় আসতে হলে ইসলামপন্থীদেরও এখন ‘গণা’য় ধরতে হবে।
ভোটের হিসাব যাই হোক- তাদের সমর্থনটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এজন্যই ‘আপস করা’, ‘ছাড় দেওয়া’ বা ‘ম্যানেজ করা’র কৌশল নিয়েই এগুচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা কোনোভাবেই চাচ্ছেন না ক্ষমতাহারা হতে। ক্ষমতা হারালে পরিণতি কী হতে পারে, তার কিছুটা ধারণা তাদের সাধারণ সম্পাদক ইতোমধ্যে দিয়েই দিয়েছেন। একটা আতঙ্ক তাদেরকে তাড়া করে ফিরছে। এই আতঙ্ক দূর করার সহজ উপায় হলো একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। যার সময়সীমা তারা বলছেন ২০১৯। কিন্তু ৫ জানুয়ারির মত ভোটারবিহীন প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করলে সে আতঙ্ক দূর হবে না। এজন্য প্রয়োজন একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার নিশ্চয়তা।
কওমিজোট: বিরোধী দল হওয়া কী সম্ভব?
স্বতন্ত্র ইসলামি জোট; লাভ লসের হিসাব কষছেন নেতারা
এক্ষেত্রে বিএনপি নির্বাচনে আসলে হবে এক কৌশল আর না আসলে আরেক কৌশল। পর্যবেক্ষকদের মতে বিএনপি তাদের দাবি থেকে সরে এসে হাসিনার অধিনেই নির্বাচন করতে চাইলে তাদেরকে ‘পূর্ণ শক্তি’ নিয়ে নির্বাচনী মাঠে আসতে দেওয়া হবে না। আদালতের মাধ্যমে শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হতে পারে। তখন দ্বিতীয় সারির নেতারা তেমন একটা সুবিধা করতে পারবেন না।
আর যদি এ অযুহাতে নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করা হয়, তখন দল ভাঙ্গার কৌশল প্রয়োগ করা হতে পারে। ‘টোপ’ দিয়ে বা ‘চাপ’ দিয়ে বিএনপির একটি অংশকে নির্বাচনে আনা হবে। তাদের নেতৃত্বে বিশদলীয় জোটের অনেক দলই নির্বাচনী মাঠে থাকবে। এটাও সম্ভব না হলে অধিকাংশ নিবন্ধিত দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ এবং বিকল্প ‘বিরোধী দল’ সৃষ্টির জন্য বিএনপি জোটের অনেক দলকে ভাগিয়ে এরশাদের জোটে ভেড়ানো হবে। শরিক দল হিসেবে কিছু ইসলামী দলও এখানে থাকবে। যারা হেফাজতের ইমেজকে ব্যবহার করে নিজেদের ‘দর’ বাড়ানোর চেষ্টা করবে। এক্ষেত্রে সরকার নিজেদের ক্ষমতায় আসার পথ ‘ক্লিয়ার’ করে এ জোটকেও অনেক সুবিধা দিতে পারে। এই হলো আগামীর সম্ভাব্য প্রেক্ষাপট।
এ প্রেক্ষাপটে যারা ইসলামী রাজনীতি করেন বা ইসলামকে ক্ষমতায় নেওয়ার জন্য যারা রাজনীতি করেন, তাদের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত- সেটিই হলো আজকের আলোচ্য বিষয়। আগেই বলা হয়েছে, কেউ স্বীকার করুক আর না করুক- ইসলামপন্থীরা দিনদিন ক্ষমতার রাজনীতির জন্য ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠছেন। তাদেরকে কাছে টানার জন্যে এখন মরিয়া আওয়ামীলীগ। পক্ষে রাখতে চায় বিএনপিও। কিন্তু তাদের এই চাওয়াটা শর্তহীন। আপত্তির জায়গা এটাই। জোটবদ্ধ রাজনীতির শুরুর দিকে জোটে যোগ দেওয়ার আহ্ববানের জবাবে একটি ইসলামী দলের পক্ষ থেকে কিছু শর্ত দেওয়া হলে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন- ‘আমরা ক্ষমতার রাজনীতি করি, আদর্শের রাজনীতি করি না। এসব শর্ত-টর্ত আমাদের পক্ষে মানা সম্ভব না।’
‘শর্ত’ না মেনেও ‘হুজুর’দের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব মনে করেই হয়ত কেউ বিষয়টাতে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু এখন সময় পাল্টে গেছে। ‘খেলোয়ার’ও পাল্টে গেছে। আফসোস, দুনিয়ার কত শ্রেণি-পেশার মানুষ নিজেদের সামান্য দাবি আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে পারলো এবং দাবিও আদায় করলো, কিন্তু আমরা ইসলামপন্থীরা এখনও নিজেদের গুরুত্ব বুঝলাম না। একথা খুব জোর দিয়েই বলা যায়- আমরা যদি আওয়ামী লীগ-বিএনপির লেজুড়বৃত্তি না করে নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, তাহলে আমাদের ‘রাজনৈতিক গুরুত্ব’ শতগুণ বেড়ে যাবে। তখন ওরা আমাদের সমর্থনকে আর ‘সস্তা’ মনে করবে না। যদি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যায় যে, আমাদের সমর্থন ছাড়া কেউই সরকার গঠন করতে পারছে না, তখনই বোঝা যাবে ইসলামপন্থীদের গুরুত্ব।
এটা কি আসলেই অসম্ভব? ইসলামপন্থী সব দল ও মতাবলম্বীর মাঝে স্থায়ী না হোক; অন্তত একটা নির্বাচনী জোট যদি গড়ে তোলা যায়, তাহলে ইসলামপন্থীদের জন্য ক্ষমতার রাজনীতির নিয়ন্ত্রকশক্তি হওয়া অসম্ভব কিছু হবে না।
একদিকে আওয়ামী জোট, আরেকদিকে বিএনপি জোট, স্বতন্ত্র অবস্থানে ইসলামপন্থীদের জোট- দৃশ্যটা একবার অন্তর দিয়ে কল্পনা করুন। হলফ করে বলা যায়- ইসলামপন্থীরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে অন্যরাও পাবে না। তখন ক্ষমতার স্বার্থেই ওরা আমাদের ‘শর্ত’ মানতে বাধ্য হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে ইসলামী ধারার দলগুলো যদি নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়, তাহলে আগামী নির্বাচনের ভোটের ফলাফল নির্ধারণে তারাই হয়ে উঠবেন প্রধান নিয়ামক।
-এআরকে