শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩১ ।। ১০ শাওয়াল ১৪৪৫


কওমিজোট: বিরোধী দল হওয়া কী সম্ভব?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ: গতকাল আমি কওমিজোট নিয়ে একটি দু লাইনের আশার কথা বলেছিলাম। এ নিয়ে দুদিন ধরে দেখলাম অনলাইন অফলাইনে নানা উত্তেজনা ও বিশ্লেষণ। প্রতিদিন অসংখ্য ফোন আর ম্যাসেজ আসছে। আসলেই কী কওমিজোট বলতে কিছু হচ্ছে। কেউ বলছেন ভূয়া খবর। আর হলে এর ধরন কী? কে কে থাকবেন? কার নেতৃত্বে। বিএনপিকে রেখে বিরোধীদল হবে কেমন করে ইত্যাদি।

গত য়েকদিন ধরে যারা জাতীয় পত্রিকা পড়েছেন, বা টকশোগুলোর রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতামত দেখছেন, তারা বিষয়টি নিশ্চয় আচ করতে পেরেছেন। দুদিন আগে দৈনিক মানব জমিনের প্রধান শিরোনামেই ছিল হেফাজতের ভোট ব্যাংক হবে আগামী নির্বাচনে বড় ফ্যক্টর।

গতকাল ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রধান শাহরিয়ার কবীর সেই শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, "ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ না হলে আগামি নির্বাচনে কেয়ামত হয়ে যাবে। আসলে জনাব শাহরিয়ার কবির এমনি এমনি কথাটি বলেন নি। তিনি এটা নিশ্চিত হয়েছেন, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মাঝে যে জাতীয় ঐক্য প্রচেষ্টা চলছে তা বাস্তবায়িত হলে ভোটের রাজনীতিতে আলেমদের আগামী নির্বাচন হয়ে উঠতে পারে বড় ধরনের টানিং পয়েন্ট। কওমিজোট হয়ে উঠতে পারে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক নীতি নির্ধারনী দল।

গতকালকের দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে সাংবাদিক স্বপন দাশগুপ্ত "আগামী নির্বাচন নিয়ে কিছু কথা" শিরোনামে উপ সাম্পাদকীয়তে লিখেছেন, "ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০দল ছেড়ে দিয়েছে। আরও হয়তো কয়েকটি ইসলামি দল বিএনপি জোট ছেড়ে দেয়ার চিন্তা করছে। ইসলামি দলগুলো বিএনপির সঙ্গে না থাকলে নির্বাচনে বড় ফ্যক্টর হয়ে দাড়াবে।"

তিনি আরো লিখেছেন, ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো বসে নেই। তারা আলাদা কোন জোট গঠন করবেন। জামাতে ইসলামীর সঙ্গে অনেক ইসলামিক দলের আদর্শগত দ্বন্দ্ব থাকায় এরা হয়তো আগামি নির্বাচনে বিএনপির দিকে না ঝুঁকে আলাদা জোট গঠনের চেষ্টা করবে। এ অবস্থায় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী হবে তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন। "

বাংলাদেশ প্রতিদিনের এই লেখা থেকে পর্দার অন্তরালে সতন্ত্র ইসলামি জোটের কিছু আভাস ঠিকই ফুটে উঠেছে। যদিও জোটের পক্রিয়াকে বাস্তবায়ন করা এবং বাস্তবে আলোর মূখ দেখাতে জোটের সমন্নয়কগণ আপাতত মূখ খুলছেন না। তবে কওমিজোট বা কওমিধারার জাতীয় জোট যে হচ্ছে তা নানা মহলের বক্তব্য ও তৎপরতায় অনেকটা নিশ্চিত। এক্ষেত্রে প্রশ্ন ধারাতে পারে এতে বিএনপির ভূমিকা কী হতে পারে? এবং বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার কী আলেমদের এই নতুন ঐক্য ও রাজনৈতিক উত্তান মেনে নিবে?

প্রথমতো দেখতে হবে বিএনপি জোটে বর্তমান ইসলামপন্থীদের অবস্থান কী। জমিয়ত ও মজলিসের একাংশ ছাড়া বিএনপির সাথে কোন গ্রহনযোগ্য ইসলামি দল নেই। এরশাদের নবগঠিত জোটেও কওমি ধারার কোন গ্রহনযোগ্য বা নিবন্ধিত দল নেই। এবং আগামিতেও যাবার সম্ভাবনা ক্ষীণ। দেশের প্রভাবশালী ইসলামি রাজনৈক সংগঠন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট, নেজামে ইসলাম পার্টি এখন বিএনপি জোটের সাথে নেই। আর সামনে জামাত বিএনপির শৈরাচারী আচরণের কারনে তাদের সাথে যাবার কোন সম্ভাবনা আগামি নির্বাচনের রাজনীতিতে নেই।

স্বতন্ত্র ইসলামি জোট; লাভ লসের হিসাব কষছেন নেতারা

ইসলামপন্থীরা ক্ষমতার রাজনীতির জন্য ‘ফ্যাক্টর’

এখন কথা হল জমিয়ত ও মজলিস বিএনপিকে ছাড়বে কী না? তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহলের মতে, কওমি স্বীকৃতি ঘোষণার পর বিএনপি ও খালেদা জিয়ার নানা বিরোপ মন্তব্যের কারণে এই দুটি দলের সাথে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

অপরদিকে স্বীকৃতি অনুষ্টানে কেবল, ছয়টি বোর্ড থেকে একজন করে বক্তব্য দেয়ার কথা থাকলেও জমিয়তের মহাসচিব মাওলানা নূর হুসাইন কাসেমী সাহেবকে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ ছিল সরকারের সাথে নতুন সখ্যতার আভাস। কাসেমী সাহেবও তাঁর বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর ভূয়াষী প্রসংশা করে বলেন, আপনার ব্যক্তিগত দ্বীনদ্বরী ও আমল সম্পর্কে আমি জানি, আপনি নামাজি, পরহেযাগার ইত্যাদি। এতে করে বিএনপি জোট ছেড়ে আসার আভাস কিছুটা আচ করা যায়। তাছাড়া গত রমাজানে খালেদা জিয়ার ইফতার মাহফিলে যান নি তারা । ২০দলের সর্বশেষ বৈঠকেও তাদের দেখা মিলে নি। এতে করে এটা স্পষ্ট হচ্ছে বিএনপি জামাতের সাথে দুটি ইসলামি দলের দুরত্ব তৈরি হয়েছে।

এছাড়া দুটি দলের নেতাদের উপর অসংখ্য রাজনৈতিক মামলা রয়েছে। বিএনপি জামাত জোটের সাথে থাকলে নির্বাচনের আগে এসব মামলা আবার চাঙ্গা হতে পারে বলে মনে করছেন মজলিস-জমিয়তের কেন্দ্রীয় অনেক নেতাই। তাই তারাও ভাবছেন বিএনপি আওয়ামী লীগের সাথে না থেকে সতন্ত্র জোটে ইসলামিক দলগুলোর অবস্থানে থাকাই হতে পারে এই মুহূর্তে নিরাপদ রাজনৈতিক কৌশল।

এখন কথা হলে আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক পতিপক্ষ হিসাবে ইসলামি দলগুলোর জাতীয় জোটকে কীভাবে দেখবে? রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল মনে করছেন আওয়ামী  লীগ নিজের স্বার্থেই কওমিজোটের কোন বিরোধিতা করবে না। তাঁরাও হয়তোবা এমনটাই চাচ্ছেন রাজনৈতিক কৌশলগত কারনে। বিএনপিকে ছেড়ে আলাদা ইসলামি জোট হলে ভোটের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে বর্তমান ক্ষমতাসিন দল। তখন কওমি অঙ্গন ও হেফাজতের সমর্থিত ভোট ব্যাংটি বিএনপির বাস্কে পড়বে না। এতে করে বিএনপির রাজনীতি ক্রমশ দুর্বল ও মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়বে। ইসলামপন্থীদের ক্ষমতায় যাবার সিঁড়ি হিসাবে ব্যাবহার কর বার বার বিএনপি মসনদে বসলেও ইসলামপন্থীদের স্বার্থে কখনো কোন কাজ করেনি বলে ইসলামি দলগুলোও এখন নিজদের সতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে চাচ্ছে।

অপরদিকে জামায়াত নেতাদের যুদ্ধপরাধী মামলায় ফাঁসি দেয়ার ফলে জামায়াতে ইসলামী মুসলিম বিশ্বে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে আসছে। মুসলিম বিশ্বকে বুঝাতে চেষ্টা করেছে বাংলাদেশে ইসলাম রাজনীতি নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করছে সরকার, ইসলামি বড় বড় নেতাদের ফাঁসি দিয়েছে। এর ফলে সৌদি আরব, কাতার, দুবাই, মালশিয়াতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার হুমকির মূখে। দেশের বৈদিশিক মূদ্রার রেমিটেন্স ধরে রাখতে উন্নায়নের স্বার্থে বর্তমান সরকার চাচ্ছে মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নায়ন করতে। সেক্ষেত্রে ইসলামিক দল ও আলেমরা রাজনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থান তৈরি করে যদি বিরোধী দলের ভূমিকায় আসতে পারেন তাহলে, এটাকে বহি:বিশ্বে বিশেষ করে আরব বিশ্বে দেখিয়ে সরকার সম্পর্ক উন্নায়ন করতে পারবে বলে অনেকেই মনে কররছেন। মুসলিম বিশ্বকে হয়তোবা বুঝাতে পারবে বাংলাদেশে ইসলামান্থীদের অবস্থান এখন আগের চেয়ে অনেক ভাল।

সম্প্রতি হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফির সাথে ফিলিস্থিনের রাষ্টদূতের সাক্ষাৎ সেই সম্পর্ক উন্নায়নেরই আভাস পাওয়া যায়। হেফাজতে ইসলাম রাজনীতিতে আসবে না এটা শতভাগ নিশ্চিত। তবে হেফাজতের অবস্থান হতে পারে ভারতের জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মতো। ভারতে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ কোন রাজনৈতিক দল নয়। সম্পূর্ণ সামাজিক অরাজনৈতিক সংগঠন। তবে ভোটের রাজনীতিতে জমিয়তে হিন্দ সবসময় বড় ধরনের ফ্যাক্টর। আলেমদের মাঝে যারা কংগ্রেস কিংবা বিজিপির সাথে রাজ্য সভা বা বিধান সভায় জোট করেন তাদের সবাই প্রায় জমিয়তের সাথে জড়িত। জমিয়ত ভারতের রাজনীতিতে না এলেও তাদের ভোট ব্যাংক তাদের ইশারায় চলে। ফলে কংগ্রেস থেকে বিজিপি সবাই জমিয়তকে সমীহা করেই রাজনীতি করেন।

কওমি বা ইসলামি জোটের সকল নেতারাই হেফাজতের দ্বায়িত্বশীল এটা যেমন সত্য, তেমনি এটিও সত্য হেফাজত রাজনীতি জোটে আসবে না। যারা কওমিজোটে আসবেন তারা হলেন হেফাজত সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল।

বিগত নির্বাচনের আগে এটা কেউ কল্পনাও করেন নি, বিএনপি দেশের বিরোধী দল থাকবে না। জাতীয় পাটির মত দল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করবে। বর্তমানে জাতিয় পার্টির চেয়াম্যান হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ যতোই ৫৮দলীয় জোট করেন না কেন, তার গল সরকারের সিদ্ধান্তের বাহিরে যাবে বলে মনে হচ্ছে না। জাতীয়পাটি যেহেতু মহাজোটের শরিকদল। তাই তাদেরকে সরারি সরকারের ক্ষমতার জোটে নিয়ে আরো মন্ত্রীত্ব বাড়ানো হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই। আর এদিকে কওমিজোট ঐক্যবদ্ধ হলে কমপক্ষে ২০০ আসনে প্রার্থী দেয়া সম্ভব। আওয়ামীলীগ যদি সরকার গঠন করে, সেখানে আলেমদের জাতীয় এই ইসলামি জোট ৩০/৪০আসনে বিজয়ী হলে অবাক হবার কিছু থাকবে না। কারণ এই অসম্ভবের দেশে সবকিছুই রাজনৈতিক কারনে সম্ভব হয়ে উঠে। জাতিয় পার্টি আরো ৪০টি আসন নিয়ে সরকারের সাথে থাকলে বিএনপি নির্বাচনে এলে ১৫/২৯টি আসনের মালিক হতে পারে। কারণ বিএনপির ভোট ব্যাংকেই হানা দিবে কওমিজোট। এই জোট আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক টানতে পারবে না। সরকারও হয়তোবা সেটাই অনুধাবন করছেন।

অনেক রাজনীতিক বিশ্লেষক মহল মনে করছেন, রাজনীতিতে এখনও বড় দুটি শক্তি রয়েছে। তবে বিএনপি মামলা মোকাদ্দমার পেছে পড়ে একেবারে নাস্তেনাবুদ। ঘুরে দাড়ানো তাদের জন্য কঠিন ব্যপার। তাদের প্রধান শক্তিই আলেম সমাজ। আলেমরা যেহেতু আগের মতো খালেদা জিয়ার সাথে আর নেই, তাই সবার আশা আকাঙ্ক্ষা এতে করে আগামি নির্বাচনে তৃতীয় একটি দল বা শক্তি দাঁড়াতে পারে। বাম বা জন- বিছিন্ন কেউ তৃতীয় শক্তি হবার কোন সম্ভাবনা নেই।

অনেকেই বলছেন, এই এই তৃতীয় শক্তিটি ইসলামি শক্তি হতে পারে। তবে তারা বলছেন, এই শক্তি তৈরিতে আলেমদের অনেক কৌশলি হতে হবে। সাবধানে মূখ খোলতে হবে। কারণ এখন প্রধান সব দলই চাইবে তাদের স্বার্থের বাইরে কিছু না হোক। এ জন্য ইসলামি দলগুলোকে তারা নিজেদের স্বার্থের জন্য কাজে লাগাতে চাইবে। এ ক্ষেত্রে সুচিন্তিত মতামত, কর্মপন্থা, ইস্পাত কঠিন ঐক্য নিয়ে এগুতে হবে। লোভ লালসা মুক্ত পারস্পারিক আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে নিজেদের নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়তে পারলে "কওমিজোট" হয়ে উঠবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বৃহত্তর এক শক্তি। তখন তাদের জন্য সংসদীয় বিরোধী দল হওয়া কেবল সময়ের ব্যাপারমাত্র।

লেখক, চিকিৎসক, গবেষক, উপন্যাসিক বহুগ্রন্থ প্রণেতা

মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়


সম্পর্কিত খবর