কাসেম বিন আবু বাকার। জনপ্রিয়তায় বাংলাদেশের শীর্ষ ঔপন্যাসিকদের কাতারে রয়েছেন। জীবনের প্রথম উপন্যাস ফুটন্ত গোলাপ যাকে অসামান্য খ্যাতি এনে দেয়। শুধু লেখকের এ উপন্যাসই বিক্রি হয়েছে ২০ লাখ কপি। এরপর লিখেছেন আরও একশ’ বই। বৃহস্পতিবার তার মুগদার লাইব্রেরিতে বসে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রোকন রাইয়ান ও আতাউর রহমান খসরু
আওয়ার ইসলাম : আপনার জন্ম কোথায় এবং শৈশব কীভাবে কেটেছে?
কাসেম বিন আবু বাকার: আমার জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলায়। সেখানেই আমার শৈশব কেটেছে। আমি হাওড়া বোর্ড থেকে ম্যাট্রিক পাশ করি। ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হই শেষ করতে পারি নি। বাবার প্রথম সন্তান হওয়ায় আমাকে সংসারের হাল ধরতে হয়।
আমার শৈশব ছিলো দুরন্ত। বাবা-মা শিক্ষিত হওয়ায় পড়ালেখায়ও খুব মনোযোগী ছিলাম।
আওয়ার ইসলাম : তারপর বাংলাদেশে আসলেন কীভাবে?
কাসেম বিন আবু বাকার : বাংলাদেশ বা তৎকালীন পাকিস্তানে আসার জন্য আমি স্বপ্নে আদিষ্ট হই। ফুরফুরা পীর সাহেবকে আমি স্বপ্নের কথা বললে তিনি বাংলাদেশে আসতে বলেন। তাছাড়া আমাকে দু’বার কলকাতা ও মুরশিদাবাদে গলাকাটতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই এবং বাংলাদেশে চলে আসি।
আওয়ার ইসলাম : লেখালেখির সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে পড়লেন?
কাসেম বিন আবু বাকার : পড়ার ঝোঁক পারিবারিকভাবেই পেয়েছি। মা-বাবা শিক্ষিত ছিলেন। পারিবারিক লাইব্রেরিতেই নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের আনোয়ারা উপন্যাস পড়ি এবং সালেহা উপন্যাস পড়ি। বই দুটি আমার খুব প্রিয়। এতে প্রেমের গভীরতা আছে। আমার বইতেও আমি প্রেমের গভীরত্ব দেয়ার চেষ্টা করেছি।
দশ বছর শিক্ষকতার পর আমি মল্লিক ব্রাদার্সে চাকরি নেই। এতে আমার পড়ার সুযোগ আরও বিস্তৃত হয়। দুটো জিনিস আমাকে পীড়িত করে। এক. বাংলা সাহিত্যের বইতে মুসলিম চেতনা, আদর্শ, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির অনুপস্থিতি। দুই. মল্লিক ব্রাদার্স সায়েন্স ও কমার্স-এর বই বেশি করতো। সেখানে ছেলে-মেয়ে যেভাবে আসতো আমি কষ্ট পেতাম। ব্যথিত হতাম।
আমার মনে হলো, আমি ইসলামি সংস্কৃতি ও শিক্ষা শিক্ষিত তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতীদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। সেই চিন্তা থেকেই লেখালেখির সূচনা।
আওয়ার ইসলাম : আপনি ইসলামি বিশ্বাস, চিন্তা ও আদর্শ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কলম ধরলেন, অথচ লিখলেন প্রেমের উপন্যাস। প্রেম ও ইসলামের মাঝে দূরত্বের কথা সবাই বলে...
কাসেম বিন আবু বাকার : এ প্রশ্নের মুখোমুখি আমি বার বার হয়েছি। আমি ইসলামের কথা বলি প্রেমের উপন্যাসে। কেউ কেউ আমাকে বলেছেনও আমি অর্থ উপার্জনের জন্য এমন করেছি।
কিন্তু আমার মন জানে আমি কেনো করেছি। আমি চিন্তা করেছি অন্য জায়গা থেকে। আমি প্রেমকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করেছি। কারণ, আমরা যতো বাধাই দেই না কেনো যুবকদের প্রেমবিমুখ করতে পারবো না। তাই আমি প্রেমকেই বাহক হিসেবে বেছে নিলাম এবং তাদের কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছে দিলাম। তাদের বোঝালাম, প্রেমের লাভ-ক্ষতি হিসেব কিন্তু আমি আমার উপন্যাসে দিয়েছি। বিশেষ করে সীমালঙ্ঘন যেনো না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক করেছি।
আওয়ার ইসলাম : আপনি পেরেছেন ইসলামের কথাগুলো মানুষকে শোনাতে? আপনার উপন্যাস পড়ে জীবনে ইসলাম এসেছে এমনটি হয়েছে?
কাসেম বিন আবু বাকার : হ্যা, আমি পেরেছি। ইসলামের বাণী ও কথা আমি মানুষকে শোনাতে পেরেছি। চিঠি, সাক্ষাৎ ও ফোনে বহু মানুষ আমাকে জানিয়েছে, তারা আমার উপন্যাস পড়ে ইসলাম মানছে। যেমন, পশ্চিমবঙ্গের চার ভাই আমাকে জানিয়েছে আমার উপন্যাস পড়ে তারা মাদক ছেড়েছে।
আওয়ার ইসলাম : বাংলার আবহমান কালের প্রেম-বিরহ-ইসলাম। এ তিনই আপনার উপন্যাসের মিথ। ইসলাম আপনার জীবনে এবং আপনার উপন্যাসে কীভাবে এলো?
কাসেম বিন আবু বাকার : আমি পারিবারিকভাবেই ইসলামানুরাগী। আমার পরিবার ফুরফুরা পীর সাহেবের মুরিদ। পরিবারের কাছ থেকেই ইসলাম শিখেছি। পরবর্তী জীবনে ব্যক্তিগত পড়ালেখা থেকেও অনেক কিছু জানতে পেরেছি।
আর উপন্যাসে ইসলাম আসার একটা গল্প আছে। আমি তখন মল্লিক ব্রাদার্সে চাকরি করতাম। সেখানে বিএ'র একজন ছাত্রী আসতো। পাকিস্তানি আমলে সেই বোরকাকে বলা হতো ফকিরনি বোরকা। সেই মেয়ের নাম হয়ে যায় ফকিরনি। একদিন মেয়েটির বোরকার বোতাম খোলা ছিলো। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, ভেতরে রয়েল ড্রেস। আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ভেতরে এমন রয়েল ড্রেস আর উপরে ফকিরনি বোরকা কেনো? সে বললো, আপনি ইসলাম মানেন? ইসলামের বিধান জানেন? ইসলাম বলেছে, বের হওয়ার সময় অনাকর্ষক পোশাক পরে বের হতে। কথাটি আমার মনে দাগ কেটেছিলো। আমার প্রথম উপন্যাস ফুটন্ত গোলাপের নায়িকার নামও আমি মেয়েটির নামে রাখি।
আওয়ার ইসলাম : আপনার প্রথম ও সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস ফুটন্ত গোলাপের গল্প যদি বলতেন?
কাসেম বিন আবু বাকার : উপন্যাসটি আমি ১৯৭০ সালে লিখি। কিন্তু এটা প্রকাশ হয় ১৯৭৮ সালে। অর্থাৎ লেখার পর দীর্ঘ আট বছর অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু প্রকাশের পর আর অপেক্ষা করতে হয় নি। এক মাসে পাঁচ হাজার বই শেষ হয়ে যায়।
আওয়ার ইসলাম : এতো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হলো কেনো?
কাসেম বিন আবু বাকার : কারণ, ইসলাম নির্ভর উপন্যাস হওয়ায় বইটি চলবে তা কেউ বিশ্বাস করতে পারে নি। অবশেষে সাহিত্যমেলার অরুণ বাবু বইটি প্রকাশ করেন এবং তিনি বলেন, আপনি লিখে যান আমি আপনার বই প্রকাশ করবো।
আওয়ার ইসলাম : লেখালেখির প্রথম জীবনে আপনার স্ত্রী-পরিবার কীভাবে আপনাকে কীভাবে সহযোগিতা করেছে?
কাসেম বিন আবু বাকার : সহযোগিতা করতো না। বলা যায়, বাঁধাই দিতো। আমি সাড়া দিন অফিস করতাম আর রাত জেগে উপন্যাস লিখতাম। সে আমার জন্য দীর্ঘ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতো। কখনো তার জন্য আমি ঘুমাতে যেতাম। সে ঘুমানোর পর আবার উঠে লিখতে শুরু করতাম। সে যখন টের পেতো আমি লিখছি, তখন আমার লেখার খাতা বারান্দায় ফেলে দিতো।
আওয়ার ইসলাম : এই যে, আপনি এতোগুলো প্রেমের উপন্যাস লিখলেন। আপনার জীবনে কী প্রেম এসেছিলো?
কাসেম বিন আবু বাকার : হ্যা, এসেছিলো। কিন্তু আমি তাকে পাই নি। আমার উপন্যাস ক্রন্দসী প্রিয়াতে আমি আমার প্রেমের গল্প বলেছি।
আওয়ার ইসলাম : আপনার উপন্যাস নায়ক কাসেম বিন আবু বকরের প্রভাব কতোটা পড়েছে?
কাসেম বিন আবু বাকার : পড়েছে, অনেকটাই পড়েছে। কারণ, মানুষ তার নিজের গল্প দিয়ে শুরু করে। তারপর আশপাশ ও চারপাশের গল্প বলে। নিজেকেই দিয়েই তো মানুষ অন্যকে বিচার করে।
আওয়ার ইসলাম : আপনি বাংলাদেশের তুমুল জনপ্রিয় একজন ঔপন্যাসিক। বলা হয়, সাহিত্যমানে সস্তা হলেই নাকি তা বেশি জনপ্রিয় হয়। হুমায়ুন আহমদের ব্যাপারে এটা বলা হতো?
কাসেম বিন আবু বাকার : আমাকে কখনো কখনো কোনো কোনো বন্ধু ও সুহৃদ বলেছেন আপনার লেখার মান বৃদ্ধি করুন। আমি তাদের বলেছি, আমার পটেকে দশ টাকা আছে। আমি দশ টাকার বেশি খরচ করবো কী করে? আমার যোগ্যতা এতোটুকুই। চেয়ে বেশি পারবো না।
আওয়ার ইসলাম : এই না পারা নিয়ে, অন্য কোনো না পাওয়া নিয়ে আপনার মনে কোনো আক্ষেপ আছে?
কাসেম বিন আবু বাকার : না, জীবনের প্রতি আমার কোনো আক্ষেপ নেই। আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন তা অনেক মানুষকেই দেন নি।
আওয়ার ইসলাম : সাহিত্যের স্বীকৃতি বা পুরস্কার...
কাসেম বিন আবু বাকার : না, এসব নিয়েও আমার মনে কোনো আক্ষেপ নেই। আমি মানুষের কাছে ইসলাম পৌঁছাতে চেয়েছিলাম। তা পেরেছি। আমি অর্থ, খ্যাতি ও পুরস্কারের জন্য লিখি নি।
আওয়ার ইসলাম : মানে আপনি বাংলাদেশের মূল সাহিত্যাঙ্গণ থেকে সচেতনভাবেই দূরে থেকেছেন?
কাসেম বিন আবু বাকার : দূরে থেকেছি তা নয়। বরং আমি কখনো আপন হওয়ার চেষ্টা করি নি। আমাকে অনেক সময় বন্ধুরা পরামর্শ দিয়েছেন মিডিয়ামুখী হতে। তারা বলতেন, মিডিয়ায় না গেলে পুরস্কার পাবেন না, কেউ দাম দিবে না। ইত্যাদি অনেক কথা। কিন্তু আমি তো এগুলোর জন্য লিখি নি। তাই নাম কামানোর আগ্রহও কোনো দিন ছিলো না।
আওয়ার ইসলাম : আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া কী?
কাসেম বিন আবু বাকার : অন্য সব লেখকের মতো পাঠকের ভালোবাসা।
আওয়ার ইসলাম : যেমন...?
কাসেম বিন আবু বাকার : একবার রাজশাহীর থেকে চারটি মেয়ে একসাথে তাদের ছবি ও জীবনবৃত্তান্ত পাঠায়। তারা লেখে আমাদের যাকে আপনার পছন্দ তাকে আপনি বিয়ে করুন।
আরেকবার চট্টগ্রামের এক হিন্দু হেড মাস্টার আমাকে পেয়ে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন এবং চুমু খেতে শুরু করলেন যেনো কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বহু বছর পেয়ে জড়িয়ে ধরেছে। এমন অনেক ভালোবাসার দৃষ্টান্ত রয়েছে।
আওয়ার ইসলাম : আপনি কোনো রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী? কারো কারো ধারণা....
কাসেম বিন আবু বাকার : না, আমি কোনো রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী না। অনেক পাঠকের ধারণা আমি জামাআতের আদর্শে বিশ্বাসী।
একবার উপমহাদেশের বিখ্যাত কমিনিস্ট নেতা কমরেড মুজাফফর আহমদ আমার একটি বই পড়ে সরাসরি প্রকাশকের কাছে হাজির হন। প্রকাশকের কাছে আমার সম্পর্কে জানতে চান। প্রকাশক বলেন, একজন হুজুর মতন লেখক। মনে হয়, জামাআত করে। কমরেড মুজাফফর বলেন, জামাআতের ইসলাম ও এই লেখকের ইসলাম ভিন্ন। এ লেখক জামাআত করতে পারেন না।
দেশি মিডিয়ায় উপেক্ষিত কাসেম বিন আবু বকরকে যেভাবে মূল্যায়ন করলো বিশ্ব মিডিয়া
আরআর