তামীম রায়হান : প্রথম যখন সংবাদমাধ্যমে দেখলাম, মক্কা-মদিনার ইমামগণ বাংলাদেশে আসছেন, তখন থেকেই ভাবছিলাম, যেহেতু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের উদ্যোগে ইসলামি ফাউন্ডেশন এ আয়োজনের হর্তাকর্তা, কাজেই আওয়ামী লীগ যাদের অপছন্দের দল, তারা এ উদ্যোগ বা আয়োজন সম্পর্কে কী প্রতিক্রিয়া দেখান- সেটির খোঁজখবর রাখবো।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিরোধিতা ও দলীয় সংকীর্ণতা এতোটাই নিচু পর্যায়ে নেমেছে যে, অপছন্দের দল ক্ষমতায় থাকলে তারা যাকিছু করবেন, সবই দেশের জন্য অমঙ্গলজনক, এটাই যেন বিরোধীদের বিশ্বাস ও মূলমন্ত্রে পরিণত হয়। আমার সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক বা আদর্শিক দলের সখ্যতা নেই বলে দু পক্ষের এসব কাণ্ডকারাখানায় আমার কিছুই যায়-আসে না। কিন্তু মক্কা-মদিনার সম্মানিত অতিথি বলে কথা!
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনুষ্ঠানে মক্কা ও মদিনার ইমাম-খতিবদের আমন্ত্রণ জানানোর ব্যাপারটা শুরু থেকে আমরা কাছে ভালো লেগেছে। মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম জায়গা মসজিদুল হারাম ও মসজিদুন নববীর যারা ইমাম বা খতিব অথবা যারা প্রশাসনকি কর্মকান্ডে যুক্ত, তারা নিশ্চয়ই জ্ঞান, যোগ্যতা ও সততায় হাজারো মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। সৌদিআরব তো আর বাংলাদেশ নয় যে, স্বজনপ্রীতি বা দলীয় আনুগত্যের ফলে যাকে তাকে যেখানে সেখানে বসিয়ে দেয়া যায়।
মক্কা-মদিনার সম্মানিত অতিথিদের আগমনে যে আনন্দময় উচ্ছাস আমাদের সর্বত্র ছড়িয়ে যাওয়ার কথা, সেটির বড় অভাব আমাকে ব্যথিত করেছে। যারা ইসলামের বার্তাবাহক হিসেবে ফেসবুকে নিয়মিত সক্রিয়, তারাও যেন এ অতিথিদের আগমনে খুশি হতে পারছেন না। কারণ, আওয়ামী লীগ সরকারের আমন্ত্রণে তারা আসছেন। কাজেই এই শ্রেণির অনেকেই নিজেদের মেধা ও শ্রম ব্যয় করছেন, যদি কোনোভাবে এ দুজন অতিথিকে ভুয়া প্রমাণ করা যায়। অনেকে স্ট্যাটাস দিয়ে জানতে চাচ্ছেন, আদৌ কি আগত অতিথিদ্বয় মক্কা-মদিনার কেউ! এদের স্পর্ধা ও মানসিক দীনতা কদ্দূর গড়িয়েছে, ভাবা যায়!
সৌদিআরবের বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজ যাদের অনুমোদন দিয়েছেন, তাদের নিয়ে সৌদিআরবের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসেছে। এঁদের মধ্যে দুজন অতিথি ডক্টর, একজন ড. আব্দুল মুহসিন আলকাসিম মদিনার বিচারক এবং মসজিদে নববির ইমাম। আরেকজন মসজিদুল হারামের প্রশাসনিক দফতরের উপপ্রধান ড. মুহাম্মদ বিন নাসের আলখুজাইম।
আমাদের উচিত ছিল, লাখো মানুষ ফুল হাতে বিমানবন্দরে গিয়ে তাদের বরণ করে নেওয়া। কারণ, তাঁরা আমাদের প্রাণের নগরী মক্কা-মদিনার অতিথি। এসবের কিছু তো নেই, বরং ফেসবুকপোকাদের মধ্যে যারা ইসলামকে ব্যবহার করে লাইক শেয়ারের ধান্দা করেন, তাদের অনেকেই মুখে কুলুপ এঁটেছেন। আরা যারা চুপ করে থাকতে পারছেন না, তারা নানা উপায়ে এ দুজন অতিথির মানহানিতে মেধা ও শ্রম ব্যয় করছেন। কেউ লিখছেন, ইনি তো মসজিদে নববির মূল ইমাম না। আরেকজন লিখেছেন, উনি তো মসজিদে হারামের অফিসে কাজ করেন, ইত্যাদি। আমরা তাদের নিয়ে উচ্ছাস বা আনন্দ প্রকাশ করিনি বলে অতিথিদের সম্মানে বিন্দুমাত্র যোগ-বিয়োগ হয়নি সত্য, কিন্তু এর মাধ্যমে আমাদের ক্ষুদ্রতার হিংসাত্মক মনোভাব প্রকটভাবে উন্মোচিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার জঙ্গিবাদ ঠেকাতে মক্কা-মদিনার ইমামদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের বক্তৃতা শোনার সুযোগ করে দিয়েছে দেশবাসীকে, এটা আওয়ামী লীগের ভালো কাজগুলোর একটি হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তবে সরকারের ছত্রছায়ায় দলবাজি বা অন্য কোনো যোগ্যতায় প্রশাসনে যে অযোগ্যরা ছড়িয়ে আছে, এর প্রমাণ মিলল আজকের সমাবেশে। দুজন অতিথির ভাষণ অনুবাদের জন্য যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তাকে নিয়ে দু কথা না বললেই নয়।
ভাষণের মূল বিষয়বস্তু থেকে অনুবাদক কয়েক’শ হাত দূরে ছিলেন। অতিথি বলছেন এক কথা, অনুবাদক বলছেন আরেক কথা। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা অনুবাদক ছেড়ে চলে গেছেন। আবার অনেক কথার উল্টো অনুবাদও করেছেন। একটি-দুটি উদাহরণ দিয়ে এর প্রমাণ দিয়ে শেষ করার মতো নয়। অতিথি যতই শান্ত ভঙ্গিমায় ভাষণ দিয়েছেন, অনুবাদক ততই উত্তেজিত হয়ে হাত নেড়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে কথা বলেছেন। মনে হচ্ছিল, তিনি নিজেই আরেকজন বক্তা। অনুবাদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। সন্দেহ নেই, অতিথিদের জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শোনার সুযোগ থেকে উপস্থিত সবাই এবং টেলিভিশনের পর্দায় দেখা লাখো মানুষ বঞ্চিত হয়েছেন, এ দায় অনুবাদকের।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন নিশ্চয়ই এ অনুবাদককে দায়িত্ব দেওয়ার বেলায় স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিয়েছে, নইলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। লিখিত ভাষণটি অতিথিদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আগেই অনুবাদ করে রাখা যেত, সেটিও করা হলো না কেন- অথবা যাচাই বাছাই করে কেন অনুবাদককে দায়িত্ব দেওয়া হলো না- এসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে!!
এমনই কিছু কিছু অপেশাদারী আচরণের জন্য সরকারের ভালো ভালো উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আমি রাজনীতিক বা বিশ্লেষক নই বলে এসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। কিন্তু এ দুজন প্রাজ্ঞ অতিথির ভাষণের প্রকৃত অনুবাদ শোনা হলো না দেশবাসীর, এ দুঃখ রয়ে গেল।
বাংলাদেশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশ। এই দেশের সঙ্গে সৌদিআরবসহ পুরো আরব ও মুসলিমবিশ্বের যোগাযোগ যতই বহুমুখী ও সুদৃঢ় হবে, ততই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। মক্কা-মদিনার অতিথিদের আগমনের মধ্য দিয়ে যে সুন্দর ধারার সূচনা হলো, বাংলাদেশ যেন এই ধারা অব্যাহত রাখে, সেই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের কাছে।
সুদূর মক্কা ও মদিনা থেকে দুজন সম্মানিত অতিথিসহ যে প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসেছিলেন, তাদের পদধূলিতে ধন্য হয়েছে বাংলাদেশ। তাঁদের কল্যাণে শুদ্ধতা ও সুন্দরের চর্চা আবারও জেগে উঠুক আমাদের মনমানসে, এই প্রার্থনা করুণাময়ের কাছে।
লেখক : গণমাধ্যম গবেষক, মানবাধিকার বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কাতার
পবিত্র ধর্মের সম্মান রক্ষার্তে সৌদির সঙ্গে একত্রে কাজ করবো’