শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪ ।। ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিরোনাম :
বাংলাদেশের কোনো সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেনি : ভিপি নুর আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.) কে যেমন দেখেছি মাত্র ৯ মাসে কোরআনের হাফেজা হলেন ৬ বছরের সাফিয়্যা ভারতীয় চক্রান্তের প্রতিবাদে সাভারে হেফাজতের বিক্ষোভ সমাবেশে জনতার ঢল বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে সাদপন্থিদের বর্বর হামলার বিচার চেয়ে বিক্ষোভ, স্মারকলিপি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক সাহসী কণ্ঠ ছিলেন হেলাল হাফিজ: ড. ইউনূস কবি হেলাল হাফিজের ইন্তেকাল সরকারের প্রতি যে আহ্বান জানালেন মির্জা ফখরুল মাহফিলে যেতে না পেরে হেলিকপ্টারের ৪ লাখ টাকা ফেরত দিলেন মাওলানা এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী মুসলিম সমাজে অমুসলিমদের ধর্ম পালনে বাধা নেই: বায়তুল মোকাররমের খতিব

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.) কে যেমন দেখেছি

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ছবি: আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ. ও মুনির আহমদ

|| মুনির আহমদ ||

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রাহ.) এর সান্নিধ্যে তিন বছর থাকার সুযোগ হয়েছিল আমার। সময়গুলো ছিল আমার জীবনের অন্যতম সেরা সময়। একজন মানুষের মাঝে এতো গুণের উপস্থিতি থাকতে পারে, তাঁর সান্নিধ্যে সময় না কাটালে বুঝতাম না। হযরতের জ্ঞানের গভীরতা, বিচক্ষণতা, সবর, আত্মত্যাগ, মানবিকতাবোধ, তাকওয়া, দেশপ্রেম, নীতি-আদর্শে অবিচলতা এবং পরিচ্ছন্ন ও সুশৃঙ্খল জীবন-যাপন ছিল অভিভুত হওয়ার মতো। আর আমার মূল্যবান অর্জন ছিল, এমন একজন উঁচুমাপের ব্যক্তিত্বের পরম মমতা ও গভীর আস্থা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমানভাবে ধরে রাখতে পারা.....।

বার্ধক্যের দুর্বলতা ছাড়াও হযরতের এক পা একটু খাটো ছিল। যে কারণে হযরত (রহ.) দশ কদমও হুইল চেয়ার, লাঠি বা কারো সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারতেন না। অথচ এই তিন বছরে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাবসহ কোন নামাযই হযরতকে বসে পড়তে দেখিনি। আরো অভিভুত হওয়ার বিষয় ছিল যে, পূর্ণ মাহে রমযান তথা ৩০ দিনই ইতিকাফ করতেন। মাদ্রাসার মসজিদে ইশা ও খতমে তারাবীহ শেষ হতে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যেতো। হযরত (রহ.) এই দীর্ঘ সময়ের তারাবীহও সর্বদা দাঁড়িয়ে পড়তেন, কখনোই বসে পড়তে দেখিনি। মাহে রমযানে ইতিকাফকালীন এই ৩০ দিনে মসজিদে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সাথে দ্বীনি বিষয় ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে কথা বলতেন না। ইতিকাফে প্রবেশের আগে বলে যেতেন, মসজিদে তাঁর সাথে যেনো বারিধারা মাদ্রাসার প্রশাসনিক বিষয় বা হেফাজতে ইসলাম ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাংগঠনিক কোন পরিকল্পনার বিষয়েও কেউ কথা বলতে না যায়। এসব বিষয়ে মাদ্রাসার ভাইসপ্রিন্সিপাল বা দল ও সংগঠনের অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত যিম্মাদারগণ পরামর্শ করে কাজ আঞ্জাম দিবেন। মাদ্রাসায় থাকা অবস্থায় অন্যান্য ওয়াক্তের তো আছেই, ফজরের জামাতেও হযরতকে সামনের কাতারে মেহরাব বরাবরই সবসময় দেখতাম। এমনকি, মাদ্রাসা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের বাসায় কখনো রাত্রি যাপন করলেও ফজরের নামাযে প্রথম কাতারে ইমামের পেছনেই তাকবীরে ঊলার সাথে নামায আদায় করতে দেখতাম।

হযরত (রহ.) আরেকটা বিশেষ গুণ দেখেছি, তিনি গীবত বা দোষ চর্চার বিষয়ে সবসময় কঠোর সতর্কতা বজায় রাখতেন। নিজে তো কখনোই গীবত/পরনিন্দায় সামান্যতমও জড়িত হতেন না, হযরতের সামনে অন্য কারো পক্ষেও গীবত বা দোষ চর্চার একদম সুযোগ ছিল না। কখনো কখনো এমনটা দেখতাম, নতুন কোন সাক্ষাৎপ্রার্থী গীবতের বিষয়ে হযরতের এমন কঠোরতা জানা না থাকার কারণে সন্তুষ্টি বা সুদৃষ্টি অর্জনের লক্ষে হযরতের সাথে রাজনৈতিক ভিন্নমত আছে এমন কারো সমালোচনামূলক বা নেতিবাচক কোন আলাপ তুলতে চাইতেন। হযরত (রহ.) সাথে সাথেই বিরক্তির সাথে বলে ওঠতেন, “ভাই, গীবত রাখুন তো! গীবত রাখুন তো!”

হযরত (রাহ.) দিন-রাত এতো বেশি কুরআন তিলাওয়াত করতেন, কিতাব মুতালায়া করতেন, ইতিহাস, রাজনীতি ও গবেষণামূলক বই পড়তেন, বলে বুঝানো যাবে না। হযরত কখনোই বেহুদা বা অহেতুক আলাপে জড়াতেন না। দল, সংগঠন বা মাদ্রাসার প্রশাসনিক বিষয়ে কোন আলাপ-আলোচনা বা পরামর্শের সময় মাদ্রাসার কোন ছাত্র বা ব্যক্তিগত খাদেমকে থাকতে দিতেন না। ইন্তিকালের দুই মাস আগেও আমাকে দিয়ে- উসমানী খিলাফতের উত্থানকাল ও পতনের কারণ, মোগল সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতনকাল এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস, শান্তিচুক্তি বিষয়ে ৭০০০ টাকার বই কিনিয়েছিলেন নিজের জন্য। হযরত যে কোন বৈঠক বা পরামর্শ সভায় সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে, অহেতুক কথা বলতেন না; দরকারী বিষয়ে অল্প কথায় প্রকাশ করতেন। সময়ের খুব গুরুত্ব দিতেন। যেকোন সভা, বৈঠক বা সেমিনারে নির্ধারিত সময়ের আগে আগে উপস্থিত হয়ে যেতেন। সবসময় মুচকি হাসি চেহারায় লেগে থাকতো। কোন অভিষ্ট বিষয়ে সফলতা না এসে তিনি হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিতেন না। নীতি-আদর্শে হযরত ছিলেন পাহাড়ের মতো অবিচল ও দৃঢ়।

আত্মসম্মান ও আর্তমর্যাদার বিষয়ে হযরত সবসময় সতর্ক থাকতেন। যে কোন প্রয়োজন সামনে আসলে আল্লাহর কাছে চাইতেন, বার বার দোয়া করতেন। কিন্তু কোন ব্যক্তিবিশেষের কাছে কখনোই হযরত কিছু চাইতেন না। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিচ্ছি, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার বাৎসরিক খতমে বুখারীতে আমার পরিচিত দুই জন শিল্পপতিকে দাওয়াত দেওয়ার বিষয়ে হযরতের অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি আমাকে বললেন, অবশ্যই সম্মানের সাথে দাওয়াত দিবেন। তবে আকারে-ইঙ্গিতেও তাদেরকে মাদ্রাসার কোন প্রয়োজনের কথা বলবেন না। এটা তাদেরকে অসম্মানী করা হবে। বরং তারা মাদ্রাসায় আসলে  মাদ্রাসার হালত দেখে নিজে থেকেই কোন সহযোগিতা করতে চাইলে সেটা ভিন্ন কথা।

আল্লামা নূর হুসাইন কাসেমী (রাহ.) ছিলেন একজন আদর্শ ও দক্ষ মুহতামিম, দাওয়াতের ময়দানে একজন দরদী দায়ী, সমাজসেবার ময়দানে ছিলেন জনদরদী সেবক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিলেন প্রজ্ঞাসম্পন্ন আপোষহীন ও স্পষ্ট ভাষী নিবেদিতপ্রাণ এক দেশপ্রেমিক।

শাহবাগী নাস্তিক্যবাদের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার আন্দোলনের সূচনাকালীন সময়ে তিনি বেশ সক্রিয় নেতৃত্বের ভূমিকা ছিলেন। তখন আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.)এর রাজনৈতিক ও নেতৃত্বসূলভ বিচক্ষণতা কাছে থেকে অবলোকন করেছি। তিনি সবসময় হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় থাকতেন। প্রয়োজনের বাইরে কথা বলতেন না। মনোযোগ দিয়ে অন্য সবার কথা শুনতেন। আলোচনা সভা ও বৈঠকে নিজের মতামত দেওয়ার সময় অত্যন্ত নরম, তবে দৃঢ়ভাবে নিজের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতেন। উলামায়ে কেরামের বৈঠকে তিনি কখনোই কারো সাথে বিতর্কে জড়াতেন না। তিনি কখনোই সত্য ও হকের প্রশ্নে কারো সাথে আপোষ করেননি। অত্যন্ত সাদাসিধে, মার্জিত ও পরিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করতেন। কথা বলতেন মেপে মেপে। তাঁর কোন বক্তব্য থেকে প্রতিপক্ষ কখনো ভুল বের করতে পারেনি। এতেই তার বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা ফুটে ওঠে।

সেই ২০১৩ সাল থেকে ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত দেখেছি, আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.) দারুল উলূম হাটহাজারীর প্রতি এবং শায়খুল ইসলাম হযরত আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)এর প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও আস্থা বজায় রেখে চলতেন। তাঁকে কখনো কারো পেছনে সমালোচনামূলক কথা বলতে দেখিনি। জাতীয় স্তরে ঈমান-আক্বিদার উপর যেকোন আঘাত আসলে তিনি কোনরূপ ডর-ভয়ের দ্বিধা করতেন না। এক দৃঢ়চেতা ও আপোষহীন নেতার রূপ নিয়ে আবির্ভুত হতেন। তাঁর দৃঢ়চেতা ও অবিচল নেতৃত্বে তরুণরা প্রেরণার খোরাক খুঁজে পেতো।

যখন যে কোনোভাবেই বাতিল মাথা উঁচু করতে চেয়েছে, আল্লামা কাসেমী (রহ.) মজবুতভাবে তার জবাব দেওয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে যেতেন। জাতির নেতৃত্বের ক্ষেত্রে হযরত (রহ.)এর প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল অত্যন্ত সুচিন্তিত ও সচেতন বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। জীবনের এই দীর্ঘ সময়ে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্যে তাঁর সব কীর্তিকে পরখ করলে বলতে হয়, হিন্দুস্তানে হযরত মাদানী (রহ.) যেমন আজীবন ইংরেজদের বিরুদ্ধে আপোসহীনভাবে লড়ে গেছেন এবং মুসলমানদের জাতীয় অভিভাবকত্বের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে গেছেন, হযরত মাদানী (রহ.) ও মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী (রহ.)এর নকশে কদমের উপর চলা হযরত আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.)এর বাংলাদেশের সমসাময়িক সময়ে অবদানও ঠিক পূর্বসুরী আকাবিগণের নির্দেশিত পথে ছিল। ফতোয়াবিরোধী ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ দেওয়ার উদ্যোগ বিরোধী, স্কুল পাঠ্যবইয়ে হিন্দুত্ববাদি লেখা বাদ দেওয়া ও ইসলামী ভাবধারার লেখা পুনঃস্থাপন, হাইকোর্ট প্রাঙ্গন থেকে থেমিস দেবি উৎখাত, ঢালাওভাবে আলেম-উলামাকে জঙ্গিবাদের তকমা দেওয়া, আল্লাহ ও রাসূলের অবমাননা বিরোধী, ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী ও কাদিয়ানীবিরোধী আন্দোলনে শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বের পাশে থেকে আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রহ.) নিরলস ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে গেছেন। ইতিহাসে তাঁর গৌরবময় এসব ভূমিকা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

এতো তাড়াতাড়ি হযরতকে হারিয়ে ফেলবো, কখনো ভাবিনি। তাঁর ইন্তিকালে দেশ, জাতি ও উম্মাহর যে ক্ষতি হয়েছে, তা সহজে পুরণ হবার নয়।

দয়াময় আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা, হযরতকে মাগফিরাত ও জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।।

(প্রসঙ্গত, আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ. আজকের এই (১৩ ডিসেম্বর ২০২০ ইংরেজি) দিনে ইন্তেকাল করেছেন।-চীফ রিপোর্টার।)

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক-মাসিক মুঈনুল ইসলাম এবং শিক্ষক-দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।

হাআমা/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ