|| মুহাম্মাদ বিন ইয়ামিন ||
শিক্ষা সফর। শব্দটির সঙ্গে কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত। শিক্ষাবর্ষের মাঝে বা শেষে শিক্ষামূলক ভ্রমণ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত হয়। এতে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে থাকে। প্রতিবছরই এমন শিক্ষা সফর হয় আমাদের মাদরাসায়।
ইংরেজি বর্ষপঞ্জির গণনায় তখন ২০১২ খ্রিস্টাব্দ। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার বন্ধে আমাদের মাদরাসায় শিক্ষা সফরের আয়োজন করা হয়। ভ্রমণ হবে নদীপথে। বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে বেড়ে উঠলেও কখনো নৌ-ভ্রমণ হয়নি। তাই সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না। নাম লিখিয়ে ফেললাম। শুরু করলাম মানসিক প্রস্তুতি।
হেমন্তের শেষ বিকেলের সূর্যাস্ত হলো জিকিরের ধ্বনিতে। সদরঘাটের টার্মিনাল তখন শুভ্রতায় ঢাকা। সাদা টুপি ও জুব্বা পরিহিত মানুষের উপচে পড়া ভীড়। কিশোর মন কৌতুহলী- শহরের এতো মানুষ যাবে শিক্ষা সফরে! বয়সের ভারে ন্যুব্জ সফেদ মুরব্বিটাও কি ছাত্র?
লঞ্চের পাটাতনে সম্মিলিতভাবে মাগরিবের জামাত আদায় হলো। কিছুক্ষণ পর জিকিরের ‘হালকা’। খেয়াল করে দেখালাম আশপাশ থেকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ জিকিরের ধ্বনি লঞ্চ ইঞ্জিনের বিরক্তিকর শব্দকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে। এমন সব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে-করতে পরদিন ভোরে পৌঁছলাম কীর্তনখোলা নদীর এক চরে। আব্বু ছাদে উঠিয়ে পুরো মাঠের বর্ণনা দিলেন এক-এক করে। জিকিরের স্নিগ্ধ আওয়াজ তোলে আরেকটি লঞ্চ এসে থামলো।
আমরা যথা সময়ে লঞ্চ থেকে নেমে অবস্থান করলাম ‘এক নাম্বার’ মাঠে। বিশাল বড়ো মাঠ। এমন আরও তিনটে মায়দান প্রস্তুত করা আছে আগত মুসল্লীদের জন্য। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের এ এক প্রীতি সম্মেলন। সামনেই অনাড়ম্বর একখানা প্যান্ডেল দেখা যাচ্ছিল। উত্তরে ছোট কবরস্থান। আমাদের সঙ্গে বেশ ক’জন প্রতিষ্ঠিত ও সফল ব্যবসায়ী ছিলেন। অবাক চোখে দেখলাম, চাটাইয়ের উপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে শুয়ে পড়লেন একজন শিল্পপতি! কত অর্থ বৈভব তার! কিন্তু এখানে তিনি প্রভূর ক্ষমার ভিখারি।
বাদ জোহর উদ্বোধনী বয়ানের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা সফরের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানলাম।
এভাবেও কী শিক্ষা সফর হয়! নিজেকে আবিষ্কার করলাম শুভ্রতা ও শুদ্ধতার এক বাগানে। এমন এক ময়দানে আসতে পেরে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলাম। দোয়া করলাম মন থেকে আব্বুর জন্য। তপ্তাশ্রু গড়িয়ে নামল গাল বেয়ে।
দেখলাম, সকাল-সন্ধ্যার বয়ানে নতুন করে উজ্জীবিত হয় শ্রোতারা। এক সামিয়ানার নিচে লক্ষাধিক মানুষের সম্মিলিত নামাজ আদায়। দলবদ্ধ জিকির। তাহাজ্জুদের ওজুতে পানি এগিয়ে দেয়াসহ বিভিন্ন আমল ও মুজাকারা চলে। চলে কুরআন মশক ও নামাজের প্রায়োগিক অনুশীলন। শেখানো হয় প্রাত্যহিক জীবনে পালনীয় প্রয়োজনীয় মাসায়েল।
এভাবে এক এক করে গত হলো তিনটি দিন। আখেরি মুনাজাতের মাধ্যমে সমাপ্তি টানা হলো পবিত্র এই আয়োজনের। নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবকরা সামিয়ানা খুলতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। সারিবদ্ধ লঞ্চগুলো ফেরার পথ ধরলো ধীরগতিতে। মানুষ, লঞ্চ, বাতাস ও ঢেউ চললো জিকিরের ছন্দে; যে ছন্দে হাজারো মুসাফির খুঁজে পায় গন্তব্য। তপ্ত মরুতে পায় সজীবতার সন্ধান। যে সুরা পিয়ে খোদায়ী প্রেমে মানুষ হয় অমর। আমি সে সুরায় অবগাহন করার বাসনা নিয়ে মাওলার ইশকে মত্ত রই।
রুহানিয়্যাতের এ প্রদীপ বাংলার প্রতিটি সিনায় জ্বলে ওঠুক। সবক হোক আত্মশুদ্ধির।
কেএল/