শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ।। ৬ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ২১ শাওয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
কওমি মাদরাসা নিয়ে সমাজে যেসব ভুল ধারণা আছে, সত্যটা জানলে আপনি অবাক হবেন! রোববার সারা দেশে মহাসমাবেশের ঘোষণা কারিগরি শিক্ষার্থীদের রেড নোটিশের মুখে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা, তা অবশ্যই পূরণ করতে হবে : নাহিদ ইসলাম ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, আমির কি লড়বেন? এবার ‘গাজা মিলিয়ন মার্চের’ ডাক পাকিস্তান জমিয়তের বাহানা তৈরি করে হজে বিলম্ব করা যাবে না: মুফতি আবদুল মালেক আন্তঃবাহিনী আজান ও কেরাত প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন সেনাবাহিনী ৩৫ বছরের ইমামকে ‘রাজকীয় সংবর্ধনা’য় বিদায় অনলাইনে বিনা খরচে বাংলায় প্রোগ্রামিং শিখবেন যেভাবে

কওমি সিলেবাসের সংস্কার: কিছু ভাবনা


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| মাওলানা মাহবুবুল হাসান আরিফী ||

কওমি সিলেবাসের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমরা অনেকেই সিলেবাসের সংস্কার ও যুগোপযোগী করার কথা বলি। প্রশ্ন হলো- কেন সেটা সম্ভব হচ্ছে না? আর কেনই-বা আমাদের সিলেবাসের যুগোপযোগী সংস্কার সম্ভব নয়; অবশ্যই এর কিছু কারণ আছে। এই লেখায় এবিষয়ে কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করব। এরপর নেসাবের সংস্কার সংক্রান্ত মৌলিক কিছু কথা বলার প্রয়াস চালাব ইনশাআল্লাহ।

এক.

ক.
আমরা তখন মিশকাত জামাতে পড়ি। আমাদেরকে যে উসতাদে মুহতারাম ‘শরহে আকাইদ’ কিতাবটি পড়াতেন তিনি ওই কিতাবের একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থের কাজ করছেন। উসতাযে মুহতারাম একদিন ক্লাসে এসে ইনকিলাব পত্রিকা থেকে একটি লেখা বের করে বললেন, দেখোতো ‘শরহে আকাইদ’ সম্পর্কে কী যেন লিখেছে! 

আমরা পুরো লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। লেখাটি ছিল সিলেবাস থেকে ‘শরহে আকাইদ’ কিতাবটি উঠিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে। লিখেছেন জামিয়া রাহমানিয়ার ছাত্রবৃন্দ। লেখাটি পড়া শেষ হলে উসতাদের মুহতারাম আমাদেরকে বললেন, তোমরা এর জবাব দাও। 

তখন আমাদের পক্ষ থেকে এর একটি জবাবি লেখা ইনকিলাবে পাঠানো হয়েছিল। লেখাটি তৈরি করেছিলেন সহপাঠী ভাই এহতেশাম হক কাসিমী। আমাদের লেখাটিও যথাসময়ে ইনকিলাবে ছাপা হয়েছিল।

বছরখানেক পরের কথা। আমি তখন মাদানীনগর মাদরাসায় আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে পড়ি। হঠাৎ একদিন জামেয়া রাহমানিয়া থেকে ফারেগ আমার এক সহপাঠী যখন জানতে পারলেন আমি সিলেট দরগা মাদরাসায় পড়েছি, তখন তিনি বললেন আরে তোমরাই তো আমাদের আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলে! আমি আগা মাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। তখন তিনি বিস্তারিত বলতে লাগলেন।

তিনি বললেন, আমরা যখন মিশকাত জামাতে পড়তাম তখন ঢাকার বড় বড় কয়েকটি মাদরাসার ছাত্ররা মিলে একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। প্রত্যেক মাদ্রাসার ছাত্ররা একেকটি পত্রিকায় সিলেবাস সংস্কারের দাবি নিয়ে লিখবে। সে অনুযায়ী আমরাই প্রথম ‘শরহে আকাইদ’ সম্পর্কে লেখা শুরু করেছিলাম। ইনকিলাবে আমাদের লেখা ছাপা হওয়ার পরই আপনাদের জবাবি লেখা পেলাম। এদিকে আমাদের ‘শরহে আকাইদে’র উস্তাদ কিতাবটির একটি ব্যাখ্যা গ্রন্থের কাজ করছিলেন। ইনকিলাবে আমাদের লেখাটি ছাপা হওয়ার পর উসতাদে মুহতারাম ক্লাসে এসে খুব বকাঝকা করলেন। রাগারাগি করলেন। জামিয়া রাহমানিয়া যেহেতু দুটি তাই আমরা বললাম, হুজুর আমরা নই; ওই রহমানিয়ার ছাত্ররা এটি লিখেছে। হুজুর আর কিছু বলেননি।

উপরের আলোচনায় আমরা দেখতে পেলাম দুজন উস্তাদ ‘শরহে আকাইদ’ কিতাবটি সিলেবাস থেকে উঠিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করেছেন, কারণ দুজনই দুটি ব্যাখ্যা গ্রন্থের কাজ করছিলেন। 
এভাবে দেখা যাবে আমাদের সিলেবাসের অনেক গ্রন্থই এমন যেগুলোর ব্যাখ্যাগ্রন্থ তৈরি করেছেন আমাদেরই কোনো উসতাদে মুহতারাম। যারা একই সাথে বড় কোনো মাদরাসার উসতাদ আবার কোনো বোর্ডেরও দায়িত্বশীল অথবা বোর্ডের বড় দায়িত্বশীল কারো ঘনিষ্ঠ। 
ফলে যখনই সিলেবাস সংস্কারের দাবি উঠবে বিভিন্ন যুক্তি দাঁড় করে বিষয়টি তারা এড়িয়ে যাবেন। যখনই কোনো বই সিলেবাস থেকে উঠিয়ে দেওয়ার দাবি উঠবে নানান অজুহাতে তারা গ্রন্থটি সিলেবাসে রাখতে বাধ্য করবেন। বর্তমান ছাত্রদের জন্য এটি কতটুকু লাভজনক বা উপকারী, এর উত্তম কোনো বিকল্প আছে কি না, সেটি তখন বিবেচনায় থাকবে না। এভাবেই আমাদের সিলেবাস পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না।

খ.
আমার ঘনিষ্ঠ এক মাওলানার কাছে শুনলাম, এক বোর্ডের মিটিংয়ে একজন প্রস্তাব করলেন ‘রওজাতুল আদব’ কিতাবটি উঠিয়ে বোর্ডের পক্ষ থেকে এর বিকল্প আরেকটি গ্রন্থ রচনা করার জন্য। জিজ্ঞাসা করা হলো আপনি কোন যুক্তিতে কথাটি বলেছেন? তিনি বললেন কারণ বোর্ডের পক্ষ থেকে যদি এর পরিবর্তে কোনো বই লিখে ছাপানো যায়, তাহলে বোর্ডের অনেক আয় হবে। সেই বোর্ডে ‘রওযাতুল আদব’ কিতাবটি এখন নেই। এর পরিবর্তে তাদের নিজেদের তৈরি একটি বই পড়ানো হয়।

লক্ষ্য করুন, ‘রওজাতুল আদব’ কিতাবটির চমৎকার বিকল্প এখন আমাদের সামনেই আছে। কিতাবটি তখন বেশ উপযোগী ছিল যখন এর সুন্দর কোনো বিকল্প ছিল না। আজ যেহেতু এর চমৎকার বিকল্প এসে গেছে, তাই আমরাও মনে করি এই কিতাবটি বাদ দিয়ে এর পরিবর্তে ঐগুলো যুক্ত করা হোক। কিন্তু ছাত্রদের লাভ এবং উপকার কতটুকু হবে সে চিন্তায় না গিয়ে, শুধু বোর্ডের আর্থিক দিক বিবেচনা করে কোনো গ্রন্থ সিলেবসে যুক্ত করার মতো মানসিকতা যদি বোর্ডের কর্ণধারদের থাকে, তাহলে আর যাই হোক সিলেবাসের যুগোপযোগী সংস্কার আদৌ সম্ভব হবে না, এটা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে।

গ.
বৃহত্তর ময়মংসিংহের আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ একটি বোর্ড হচ্ছে ‘তানযিমুল মাদারিসিল কওমিয়া আল-আরাবিয়া’। এটি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়াহ-এর অধীনস্থ একটি বোর্ড। যেসকল ক্লাসে বেফাকের পরীক্ষা আছে, সেগুলোর প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা আর বাকিগুলোর সব পরীক্ষা এই বোর্ডের অধীনে একই প্রশ্নে সকল মাদরাসায় একসাথে হয়ে থাকে। 
ওই বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ একটি মিটিংয়ে জামিয়া ইসলামিয়ার প্রতিনিধি হিসেবে আমি উপস্থিত ছিলাম। মিটিংয়ে প্রস্তাব আসল ‘মুখতাসারুল মা'আনী’ কিতাবটির পরিবর্তে ‘আল-বালাগাতুল ওয়াযিহাহ’ কিতাবটি পড়ানোর। কিন্তু এটি তো বেফাকভুক্ত জামাতের কিতাব। বেফাক তো ‘আল-বালাগাতুল ওয়াযিহাহ’-এর প্রশ্ন দেবে না। তখন হযরত মাওলানা আব্দুল জব্বার রহ. জীবিত ছিলেন। বোর্ডের সভাপতি হযরত মাওলানা আযহার আলী আনোয়ার শাহ সাহেব তখনই তাঁর সাথে ফোনে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, অন্যান্য অনেক প্রশ্নের মতো ‘মুখতাসারুল মাআনী’ কিতাবের প্রশ্নের অপর পৃষ্ঠায়‘আল-বালাগাতুল ওয়াযিহা’র প্রশ্নও থাকবে। 

যাই হোক, আমার মূল আলোচনার বিষয় এটি নয়। বরং আলোচনার বিষয় হচ্ছে, ওই মিটিংয়ে যখন ‘আল-বালাগাতুল ওয়াযিহাহ’ কিতাবের প্রস্তাব রাখা হলো তখন অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন- কিতাবটির তো নোট নেই, তাহলে আমরা কীভাবে পড়াব?

আমার আলোচনার মূল পয়েন্ট এটিই। কথা হলো, সিলেবাসে কোনো কিতাব রাখা হবে, নাকি হবে না; বাজারে এর কী কী নোট আছে, কী কী ব্যাখ্যা গ্রন্থ আছে এর ওপর যদি নির্ভর করে; এই যদি হয় আমাদের শিক্ষকদের চিন্তাধারা, তাহলে এ বিষয়টি নির্দ্বিধায় বলা যায়, আমাদের কোনো শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে নেসাবের সময়পযোগী সংস্থার কখনোই সম্ভব নয়। যাই হোক শেষ পর্যন্ত সেই কিতাবটি আর সিলেবাসে যুক্ত হয়নি। মুখতাসারুল মাআনী কিতাবকে উঠিয়ে এর বিকল্প কী আনা যেতে পারে কিংবা বালাগাতের কী কী কিতাব নেসাবে যুক্ত হতে পারে সেটা আমার আলোচনার বিষয় নয়। আমি যে পয়েন্ট নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছি সেটা হচ্ছে আমাদের সিলেবাসে উপযোগী সংস্কার কেন সম্ভব নয়।

ঘ.
আরেকটি বোর্ডের অবস্থা জানি। বোর্ডের পক্ষ থেকে নতুন একটি কিতাব সিলেবাসে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত হলো। সিদ্ধান্ত কার্যকরও হলো। কিন্তু বছরের শুরুতে কিতাবটি পড়ানো শুরু হতে-না-হতেই সিলেবাস থেকে এটাকে উঠিয়ে দেওয়া হলো। কারণ কী? অনুসন্ধান করে জানা গেল, শিক্ষকরাই নাকি কিতাবটি বোঝেন না, ছাত্ররা কী বুঝবে। এজন্য কিতাবটি তারা উঠিয়ে দিয়েছেন। 

প্রশ্ন হলো, বাস্তবেই যদি কিতাবটি দুর্বোধ্য হয়; ভাষা কিংবা বিষয়বস্তু যদি এতো কঠিন হয় যে আসলেই সেটা আমাদের ছাত্রদের উপযোগী নয়, তাহলে এমন কিতাব কীভাবেই-বা নেসাবে সংযোজন করা হয়। আর সিদ্ধান্তটি যদি উপযোগী হয়ে থাকে, তাহলে বুঝে নিতে হবে, আমাদের শিক্ষকদের অবস্থা এমন যে তারা যুগোপযোগী কোনো কিতাব পড়াতে অক্ষম। এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে সুন্দর কোনো সংস্কারের চিন্তা করাই অনুচিত।

ঙ.
আরো সুস্পষ্ট করে বলি। সিলেবাসে সংস্কার আসমান থেকে কোনো ফেরেশতা এসে করবেন না। বোর্ডের দায়িত্বশীল যারা আছেন তারাই পারেন উপযোগী সংস্কার করতে। আর এই দায়িত্বশীলরা কিন্তু আলাদা কোনো গ্রহের লোক নন; বরং তারা বিভিন্ন মাদরাসার সাথেই সংশ্লিষ্ট। আপনি তাদের সাথে একটু আলাপ করে দেখুন, তাদের চিন্তাধারা একটু শুনুন। দেখবেন এখনো তারা সেই পুরোনো কথাগুলোই বলে যাচ্ছেন। আকাবিরদের দোহাই দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন। 

দেখুন, আমাদের মাদরাসাগুলোতে এখনও মিযানুর সরফ, পাঞ্জেগাঞ্জ ইত্যাদি ফার্সি কিতাবগুলো পড়ানো হয় এবং পরীক্ষায় কিতাবের ফার্সি ইবারতের অনুবাদ করতে বলা হয়। 
আমি উলামায়ে কেরামের এক মজলিসে -যেখানে বেফাকের প্রথম সারির এক সহ-সভাপতিও উপস্থিত ছিলেন- বলেছিলাম- ‘মিযানুস সরফ’ ‘পাঞ্জেগঞ্জ’ এর উদ্দেশ্যে তো হচ্ছে সরফ শেখা আর ‘নাহবেমীর কিতাবের উদ্দেশ্য হচ্ছে নাহব শেখা। এখন কেউ যদি এই ফার্সি কিতাবগুলোর মাধ্যম ছাড়া বাংলা কোনো বইয়ের মাধ্যমে সরফ এবং নাহবের জ্ঞান অর্জন করে ফেলে, তবু কি এই ফার্সি কিতাবগুলো পড়া তার জন্য জরুরি? তাহলে কেন ফার্সি ভাষাকে মাধ্যম বানিয়ে আমাদের সরফ এবং নাহব শিখতে হবে? কেন এই সকল ফার্সি কিতাবগুলোর ইবারত মুখস্থ করতে ছাত্রকে বাধ্য করা হবে? এই কিতাবগুলোর উদ্দেশ্য তো ফার্সি ভাষা শিক্ষা নয়; তাহলে কেনই-বা সরফ ও নাহব পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে ফার্সি ইবারতের অনুবাদ চাওয়া হবে?

ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞান লাভ করা এখনো আপনার কাছে তুলনামূলক জরুরি মনে হতে পারে, সেটা একান্তই আপনার ব্যাপার। এজন্য তো ‘ফার্সি পহলি’ ‘তাইসিরুল মুবতাদি’ ‘গুলিস্তা’ ‘বোস্তা’ এগুলো পড়াচ্ছেন; কিন্তু সরফ, নাহব ইত্যাদি অতি জরুরি ফনের কিতাব পড়ানোর জন্য কেন ফার্সি ভাষাকে মাধ্যম বানাতে হবে? কেন? 

সেদিন আমি যে উত্তর পেয়েছিলাম এটি নতুন কিছু নয়, সেই পুরোনো কথাই; এগুলো আকাবির থেকে চলে আসছে!! যেন এগুলো ওহি; এতে কোনো পরিবর্তন পরিবর্ধন করা যাবে না। 
আমি বলেছিলাম, যদি বলেন আকাবিরদের অনুসরণের জন্য ফার্সি কিতাবগুলো নেসাবে রাখতে হবে, তাহলে শুনেন ‘ইলমুস সিগাহ’ কিতাবটি ফার্সি। মুফতি শফি রহ. এর নির্দেশে মুফতি রফি উসমানি দা. বা. এটির উর্দু অনুবাদ করেছেন। কিতাবটির ভুমিকায় তিনি সুস্পষ্ট বলেছেন কেন উর্দু অনুবাদ করতে হলো। তিনি বলেছেন- 
যেহেতু ফার্সির সেই সময় শেষ হয়ে গেছে, এখন মাদরাসাগুলোতে গুরুত্ব সহকারে ফার্সি শেখানো হয় না, যার কারণে ছাত্ররা এই ফার্সি কিতাবগুলো থেকে উপকৃত না হওয়ার কারণ ‘ইলমুস সরফে’ তাদের যোগ্যতা খুবই দুর্বল হয়ে থাকে, তাই প্রয়োজন উর্দুতে অনুবাদ করা। 
কিতাবটির শুরুতে মুফতি শফি রহ. এবং ইউসুফ বানুরি রহ. যে তাকরিয দিয়েছেন, এতে তারাও একই কথাই বলেছেন।

আমার কথা হলো,. তারা যদি মাতৃভাষায় পাঠদানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ফার্সি থেকে তাদের মাতৃভাষা উর্দুতে আসতে পারেন, তাহলে আমরা কেন মাতৃভাষায় পাঠ দানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ফার্সি এবং উর্দু থেকে বাংলা ভাষায় আসতে পারব না? কেন?
এর কোন সদুত্তর নেই। শুধু আছে গায়ের জোরে চালিয়ে দেওয়ার মানসিকতা!

চ.
মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী সাহেব যখন বেফাকের দায়িত্বশীল ছিলেন তখনকার কথা। সিলেবাসের সংস্কার সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বলেছিলেন, কিছু সংখ্যক মুরব্বিদের কারণে এটা সম্ভব নয়। 
আমার এক উসতাযে মুহতারাম, দেশব্যাপী যার সুপরিচিতি রয়েছে, কথাটি উল্লেখ করে বলেছিলেন- তাহলে ঐসকল মুরব্বিদের পরে কি সম্ভব? না, তখনও সম্ভব নয়। কারণ মুরব্বিদের পরবর্তীতে তাদের চিন্তার অনুসারীরা থেকে যাচ্ছে, যারা মুরব্বিদের মতো বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং আমাদের বোর্ডসমূহের কাছে সুন্দর কোনো সংস্কারের আশা না করাই শ্রেয়। 

দুই.
অনেক ভাই সংস্কারের কথা বলেন, কিন্তু বাস্তাবতা হচ্ছে সংস্কারের বিষয়টি তাদের কাছে সুস্পষ্ট নয়। তাদের বক্তব্য এবং কর্ম থেকে অনুমিত হয়, কেন সংস্কারের প্রয়োজন, কী সংস্কারের প্রয়োজন, এটাই তাদের সামনে পরিষ্কার নয়। একারণেই তারা মনে করেন, সংস্কারের মানেই হচ্ছে, বাংলা, ইংরেজি, অংক অর্থাৎ জেনারেল লাইনের বিষয়গুলো কওমি মাদরাসায় লাগিয়ে দিলেই কাজ হয়ে যাবে। 

কেউ কেউ মনে করেন সংস্কার মানে হচ্ছে অমুক কিতাব পরিবর্তন করে এর পরিবর্তে আরেকটি কিতাব যুক্ত করে দেওয়া কিংবা নতুন কোনো কিতাব সংযোজন করে দেওয়া। এতেই কাজ হয়ে যাবে। একারণেই বিভিন্ন মাদরাসায় ব্যক্তিগতভাবে নেসাবের পরিবর্তন ও পরিবর্ধনে হাত দিয়ে নেসাবের মধ্যে জগাখিচুড়ি এবং হ-য-ব-র-ল অবস্থা সৃষ্টি করে রেখেছেন। সুতরাং নেসাবের সংস্কার ব্যক্তিগতভাবে নয়; বরং এজন্য চাই সম্মিলিত গবেষণা এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনা।

তিন.
আমাদের বেশিরভাগ ছেলেদের অবস্থা হচ্ছে তারা দাওরায়ে হাদিস পড়ে বের হয়; অথচ কোরআন হাদিসের কিছুই বুঝে না; একটি আয়াত কিংবা একটি হাদিসের বিশুদ্ধ অনুবাদটুকুও করতে পারে না! কেন এই দুরবস্থা? 
কারণ অনেক থাকতে পারে। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের বর্তমান সিলেবাসও এজন্য কোনো অংশেই কম দায়ী নয়। সুতরাং সিলেবাসকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। আর এজন্য দু’একটি কিতাব পরিবর্তন করে এর পরিবর্তে আরেকটি যুক্ত করলেই চলবে না; বরং মুতাওয়াসসিতাহ পর্যন্ত কিতাবগুলো মাতৃভাষায়ছাত্রদের উপযোগী করে তৈরি করা প্রয়োজন। 

আল্লাহর কালাম বুঝার জন্য আমরা তাফসিরের কিতাবসমূহের দ্বারস্থ হই। অথচ তাফসিরে বাইযাবির মুসান্নিফ তাঁর ইবারতের দ্বারা কী বুঝাতে চেয়েছেন, তাঁর ইবারতের মর্ম উদ্ঘাটন করতে করতেই আমাদের ছাত্রদের বছর শেষ হয়ে যায়; আল্লাহর কালামের মর্ম বুঝার তাদের সময় কোথায়!

আর তাফসিরে জালালাইন তো বলতে গেল কুরআনে কারিমের আরবি অনুবাদ। তাহলে আমাদের ছাত্ররা দুটি বছরে আল্লাহর কালামের তাফসির কী শিখলো? আর কুরআনে কারিমে বিশুদ্ধ অনুবাদ? আমাদের ছাত্ররা এতে কতটা পারঙ্গম, এটা তো মাদরাসা সমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট সবারই জানা থাকার কথা।

‘তাশহিযে আযহনে’র কথা বলে বর্তমান ছাত্রদের জন্য জটিল এবং দুর্বোধ্য কয়েকটি কিতাব নেসাবে রাখলেই তো চলবে না। দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত পড়ে শুধু কিতাব বোঝার যোগ্যতা অর্জন করলেই তো হবে না। কুরআন, হাদিস ও ফিকহের মৌলিক জ্ঞান যেন এই সময়েই অর্জন হয়ে যায় এবিষয়ের প্রতি লক্ষ রেখেই নেসাবের সংস্কার হচ্ছে সময়ের দাবি।

তিন.
আমরা সবাই নেসাবের সংস্কারের প্রবক্তা। কম বেশি সবই এই দাবিটি করে থাকি। প্রশ্ন হলো শুধু সিলেবাসে সংস্কার করলেই কি হয়ে যাবে? 
কখনো নয়; বরং এর চেয়েও বেশি প্রয়োজন পাঠদান পদ্ধতির সংস্কার। নেসাবের সংস্কার যদি নাও হয় অন্তত আমাদের পাঠদান পদ্ধতির মধ্যেও যদি কিছুটা সংস্কার হয় এবং শিক্ষকগণ সঠিক পদ্ধতিতে মেহনত করেন, তাহলেও অনেকটা সুফল পাওয়া যাবে। 
(কোন্ কিতাবের দরস কীভাবে হওয়া উচিত, সেটা স্বতন্ত্র আলোচনার দাবি রাখে। এক্ষেত্রে দারুল উলুম দেওবন্দের শায়খুল হাদিস আল্লামা সাঈদ পালনপুরী রহ. এবং শায়খুল ইসলাম তাকি উসমানি দামাত বারাকাতুহুম এর চিন্তাদ্বারা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য)
সুতরাং নেসাবে সংস্কারের প্রয়োজন, এটা নেই কেন, ওটা হচ্ছে না কেন, এগুলোর দোহাই দিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। নেসাবের সংস্কার যখন হওয়ার তখন হবে। এর আগ পর্যন্ত আমাদের উচিত সঠিক পদ্ধতিতে মেহনত চালিয়ে যাওয়া। আবুল হাসান আলী নদভী রহ. বলেন-
‘ইলমের কামাল ও যোগ্যতা লাভের বিষয়টি সিংহভাগ নির্ভর করে উসতাদের মেহনত ও আত্মনিবেদন এবং তালিবে ইলমের সাধনা ও অধ্যবসায়ের ওপর। উন্নত নেসাব অবশ্যই সহায়ক। তাই এখনো আমি নেসাব সংশোধনের প্রবক্তা, কিন্তু শুধু নেসাব সংশোধন যথেষ্ট নয়।-জীবন পথের পাথেয়, পৃষ্ঠা ১৬০]

লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া ময়মনসিংহ।

এমএম/


সম্পর্কিত খবর



সর্বশেষ সংবাদ