বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫ ।। ৩ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ১৮ শাওয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :

রেজাল্টমুখী পড়াশোনা: একটি আত্মঘাতী প্রবণতা


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ছবি: সংগৃহীত

|| ওলিউল্লাহ মুহাম্মাদ ||

রমজানের ঈদের পরে এখন কওমি মাদ্রাসাসমূহে নতুন শিক্ষাবর্ষের ভর্তির ব্যস্ততা চলছে। এই সময়ে অনেক ছাত্র-ছাত্রী নূতন উদ্যমে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করে। লক্ষ্য থাকে একটি ভালো রেজাল্ট অর্জনের। তারা চায়—পরীক্ষায় বেশি নাম্বার পাবে, ভালো অবস্থান অর্জন করবে, উস্তাযদের প্রশংসা পাবে। এই চাওয়া ও চেষ্টা নিঃসন্দেহে স্বাভাবিক এবং ইতিবাচক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য—এই রেজাল্টমুখী দৃষ্টিভঙ্গি যখন পড়াশোনার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা ধীরে ধীরে ইলমে দীন অর্জনের আসল রূহ ও আত্মাকে ধ্বংস করে ফেলে।

বর্তমানে ছাত্রদের একটি বড় অংশ কিতাব অধ্যয়ন ও আত্মস্থ করার বদলে শর্টনোট ও গাইড নির্ভর হয়ে পড়ছে। কিতাব পড়ার মূল উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে—পরীক্ষায় কী আসবে, এবং কীভাবে বেশি নাম্বার পাওয়া যাবে। এ জন্য তারা এমনসব গাইড বই বা প্রশ্নোত্তর মুখস্থ করছে, যেগুলোর সাথে মূল কিতাবের আলোচনার গভীরতা ও তত্ত্বীয় দিকের কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে তারা পরীক্ষায় ভালো করতে পারলেও, কিতাবের আসল বক্তব্য, মৌলিক ধারণা ও চিন্তার সক্ষমতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

রেজাল্টের প্রতি অতিমাত্রায় মনোযোগের ফলে দেখা যাচ্ছে—বহু ছাত্র পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান পেলেও বাস্তব জীবনে সফল হতে পারছে না। কারণ, তার ভিতরে নেই কিতাবি এস্তে’দাদ, নেই ফাকাহাত-মালাকাতের কোনো লেশ, নেই নতুন কোনো বিষয় বোঝার মত যোগ্যতা।  সারা বছর ক্লাসে অমনোযোগী থেকে, ঠিকমতো পড়া মুখস্ত না করে, পরীক্ষার খেয়ারের সময় খেয়ে-না খেয়ে, ঘুমিয়ে-না ঘুমিয়ে রোবটের মত মুখস্থ করে ভালো রেজাল্ট করছে, সে হয়তো সনদধারী, কিন্তু সে প্রকৃত যোগ্যবান নয়।

অপরদিকে, যে ছাত্র পরীক্ষার নাম্বারের পেছনে না ছুটে বরং আত্মিক উন্নতি ও প্রকৃত যোগ্যতা অর্জনের পথে নিজেকে পরিচালিত করে, কিতাবের গভীরে প্রবেশ করে, দরসের প্রতি মনোযোগী হয়, ঠিকমতো ক্লাসের পড়া আদায় করে, উস্তাযদের সাহচর্য ও মেহনতের মাধ্যমে প্রকৃত মালাকাহ ও দ্বীনি ফাকাহাত অর্জন করে—তিনিই একজন যোগ্য ও সফল আলিম হিসেবে গড়ে ওঠেন।

এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য প্রথমত ছাত্রদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আবশ্যক। তাদের মনে রাখতে হবে—রেজাল্ট একটি বাহ্যিক মাপকাঠি মাত্র। প্রকৃত সফলতা হল আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন, এবং মানুষের মাঝে হেদায়াতের আলো ছড়িয়ে দেওয়া। সেই আলো তখনই আসবে, যখন ইলম শুধু কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না থেকে হৃদয়ে গেঁথে যাবে।

এছাড়া শিক্ষকগণের উচিত—ছাত্রদের কিতাবমুখী ও চিন্তাশীল পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে উদ্বুদ্ধ করা। মুখস্থ নির্ভরতার পরিবর্তে গভীরতা ও মৌলিকতা অর্জনের পথে পরিচালিত করা। এবং অভিভাবকরাও যেন শুধুমাত্র নাম্বার দিয়ে সন্তানের মেধা বিচার না করে, বরং তার চারিত্রিক গঠন, চিন্তার গভীরতা ও আমলি অবস্থার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখেন। 

পরিশেষে বলা যায়, কওমী মাদ্রাসার এই ঐতিহাসিক ধারাকে রক্ষা করতে হলে কেবল রেজাল্ট নির্ভরতা নয়, বরং আত্মিক ইলম, ফিকহী গভীরতা ও চিন্তাশীল পড়াশোনাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কারণ যুগকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য প্রয়োজন প্রকৃত আলিম, কেবল নাম্বারধারী ছাত্র নয়।

আসুন, আমরা ইলমে দ্বীনের মর্যাদা বুঝে পড়াশোনার মূল উদ্দেশ্য নির্ধারণ করি—রেজাল্ট নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও প্রকৃত যোগ্যতা অর্জন হোক আমাদের লক্ষ্য।

এমএম/


সম্পর্কিত খবর



সর্বশেষ সংবাদ