শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫ ।। ৪ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ২০ শাওয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
নগদ অর্থ, মেধাতালিকা স্মারকসহ চার শতাধিক পুরস্কার বিতরণ করেছে জামিয়া গহরপুর ভারতের মুসলিমদের ‘পূর্ণ নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করার আহ্বান বাংলাদেশের সংস্কার কেন ভোটাধিকার-গণতন্ত্রের বিকল্প হবে, প্রশ্ন রিজভীর বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানি ৩ লাখের বেশি ভারতে সংশোধিত ওয়াকফ আইন স্থগিতের ঘোষণা তালেবানের ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ তকমা উঠিয়ে নিল রাশিয়া ২৫ মার্চ গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বলল বাংলাদেশ ওয়াক্ফ বিল গোটা উপমহাদেশের কষ্টের কারণ হবে: খেলাফত মজলিস ২ দিনের জন্য ঢাকা সফরে আসছেন পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী বরিশাল সিটি নির্বাচন-২০২৩ বাতিল ও হাতপাখাকে বিজয়ের দাবিতে মামলা

কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| হামিদ মীর ||

পাকিস্তানের শাসক শ্রেণি যেন ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেওয়ার এক অলিখিত শপথ নিয়েছে। দেশের ভূগোল পাল্টে গেলেও ইতিহাসকে উপলব্ধি করা বা ভুল থেকে শিখতে চাওয়াকে এখনো অপমানজনক মনে করা হয়। যখন মানচিত্র বদলায়, তখন যেন কেবল এই হিসাব রাখা হয়—কারও উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা অহংকারে যেন আঁচ না লাগে।

যারা আজ ক্ষমতার খুব কাছের মানুষ, তারাই এক দশক কিংবা পনের বছর পর দাঁড়িয়ে বলবে—তাদের কোন কোন ‘সাবেক বস’ কী ভয়ানক ক্ষতি করেছে দেশের। কিন্তু তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। সম্ভবত কোনো এক দিন, আলতাফ গওহরের মতো কোনো আমলা (ব্যুরোক্র্যাট) দাবি করবেন—তিনি তো প্রাণপণে চেষ্টা করেছিলেন যেন পাকিস্তানে প্রাদেশিক বিদ্বেষ না বাড়ে, কিন্তু কেউ তাঁর কথা শোনেনি।

আলতাফ গওহর মাত্র ৩৯ বছর বয়সে পাকিস্তানের ফেডারেল তথ্য সচিব হয়ে গিয়েছিলেন। দেশটির প্রথম সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিলেন যে, অনেকে তাঁকে পাকিস্তানের ‘ভাইস প্রেসিডেন্ট’ বলেই মনে করত।

জেনারেল আইয়ুব খানের বিখ্যাত বই Friends Not Masters–এর প্রকৃত লেখকও ছিলেন আলতাফ গওহর, যা তিনি জীবনের শেষপ্রান্তে স্বীকার করেছিলেন। তিনি যখন নিজের আত্মজীবনী লেখার কাজ শুরু করেন, তখন ক্যানসারে আক্রান্ত হন এবং সেই কাজ আর শেষ করতে পারেননি। তবে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গওহর গুজশত নামে প্রকাশিত হয় এবং এটি তাঁর মৃত্যুর পর বের হয়।

বর্তমানে অন্তত তিনজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা নিজেদের আত্মজীবনী লেখায় ব্যস্ত। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফের খুব ঘনিষ্ঠ, আর বাকি দুইজন ছিলেন নওয়াজ শরিফের অত্যন্ত কাছের মানুষ।

এই তিন অবসরপ্রাপ্ত আমলার মধ্যে একজন সম্মানিত ব্যক্তি আমাকে জানালেন, তাঁর আত্মজীবনী সম্পূর্ণ হয়েছে। তিনি কেবল অতীতের শাসকদের ভুলত্রুটির কথাই লেখেননি, নিজের ব্যক্তিগত ভুলগুলোর স্বীকারোক্তিও করেছেন।

আলতাফ গওহরও গওহর গুজশত নামক আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন যে, একবার তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালে এক বাঙালিকে আটক করে নির্মমভাবে প্রহার করেছিলেন। পরে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়, কিন্তু তিনি বিচারকের সঙ্গে গোপন সমঝোতার মাধ্যমে নিজেকে শাস্তির হাত থেকে রক্ষা করে নেন।

আলতাফ গওহর তাঁর বস, জেনারেল আইয়ুব খান সম্পর্কে যে সব তথ্য প্রকাশ করেছেন, তা ক্ষমার অযোগ্য। তবে একইসঙ্গে, আজকের পাকিস্তানের জটিল বাস্তবতাকে বুঝতে সেই তথ্যগুলো অনেক গভীর প্রেক্ষাপট সরবরাহ করে।

তিনি লেখেন, ১৯৫৪ সালে জেনারেল আইয়ুব খান সেনাবাহিনীর প্রধান হওয়ার পাশাপাশি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবেও নিয়োগ পান। যখন তিনি মন্ত্রিসভার বৈঠকে অংশ নিতে শুরু করেন, তখন তাঁর মনে হতে থাকে—তিনি যেন জাতির এক পরিত্রাতা।

এই তথাকথিত ‘উদ্ধারকর্তা’ সত্তাকে প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে তিনি একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। ১৯৫৪ সালে লেখা সেই প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল: ‘পাকিস্তানের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সমস্যার একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ।’

এই প্রবন্ধে তিনি পাকিস্তানের সব সমস্যার সমাধান হিসেবে প্রেসিডেনশিয়াল (রাষ্ট্রপতিভিত্তিক) শাসনব্যবস্থার পক্ষে মত দেন এবং সেই প্রস্তাব তিনি মন্ত্রিসভার সভাতেই উত্থাপন করেন।

মন্ত্রিসভা সেই প্রবন্ধ বা নথিপত্রকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো মনে করল না, এবং কিছুদিন পর, ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে একটি নতুন সংবিধান গৃহীত হলো। এর ফলে জেনারেল আইয়ুব খান প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদে আর থাকলেন না। তিনি ১৯৫৬ সালের যে ফেডারেল পার্লামেন্টারি সংবিধান ছিল, তার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন।

তাঁর চাকরির মেয়াদ দু’বার বাড়ানো হয়েছিল, এখন তিনি তৃতীয় বারের জন্য মেয়াদ বৃদ্ধির চেষ্টা করছিলেন। রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন। তাঁর সহযোগিতায় প্রধানমন্ত্রী মলিক ফিরোজ খান নুন ১৯৫৮ সালের জুন মাসে জেনারেল আইয়ুব খানকে আরও দুই বছরের জন্য মেয়াদ বৃদ্ধি দেন।

এই তৃতীয় বারের মেয়াদ বৃদ্ধির কয়েক মাস পরেই, অক্টোবরে, আইয়ুব খান রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে একজোট হয়ে দেশে মার্শাল ল’ জারি করেন। তিনি কেবল সেনাপ্রধানই রইলেন না, বরং প্রধানমন্ত্রীও হয়ে গেলেন। কিন্তু শিগগিরই তাঁর মনে হলো, প্রকৃত ক্ষমতা তো রাষ্ট্রপতির হাতে, সুতরাং তিনি রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করে নিজেই রাষ্ট্রপতি হয়ে বসলেন। এভাবেই ১৯৫৬ সালের সংবিধানের পরিসমাপ্তি ঘটল।

আলতাফ গওহর তাঁর লেখায় একটি বিস্ময়কর তথ্য প্রকাশ করেছেন—জানান, মার্শাল ল’ জারির বহু আগেই জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করার পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন।

এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল একজন খ্যাতনামা ধর্মতাত্ত্বিক, গোলাম আহমদ পারভেজের সঙ্গে।

১৯৫৭ সালের জুন মাসে পারভেজ সাহেব আইয়ুব খানকে বলেন যে, তাঁর উচিত এখনই ক্ষমতা গ্রহণ করা, কারণ ১৯৫৬ সালের ‘অইসলামিক’ সংবিধান বাতিল করা অত্যন্ত জরুরি।

পারভেজ সাহেব কেবল সংসদীয় ব্যবস্থার বিরোধী ছিলেন না, তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকেও ইসলামের পরিপন্থী বলে মনে করতেন। তাই তিনি একটি নতুন 'ইসলামি সংবিধান' রচনার প্রস্তাব দেন, যা একাধারে রাষ্ট্র, ধর্ম এবং প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে আনবে।

এই ইতিহাস আসলে শুধু অতীতের কাহিনি নয়, বরং আজকের দিনের রাজনৈতিক কাঠামো ও সংকটের অনেক মূল সূত্র এখানেই নিহিত।

যখন দেশে মার্শাল ল’ কার্যকর হলো, তখন ১৯৫৯ সালের ১৮ জুন, গোলাম আহমদ পারভেজ একটি চিঠির মাধ্যমে জেনারেল আইয়ুব খানকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, দেশকে একটি প্রগতিশীল ইসলামি সংবিধান দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

আরেকজন ছিলেন পীর আলী মোহাম্মদ রাশদি, যিনি সেই সময়ে ফিলিপাইনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি ১৯৬০ সালের ১৯ ডিসেম্বর একটি চিঠিতে আইয়ুব খানকে প্রস্তাব দেন—দেশে রাজতন্ত্র চালু করা হোক এবং তিনি নিজেই রাজা হিসেবে নিজের অভিষেক ঘোষণা করুন।

আইয়ুব খান এরপর ইসলাম, রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের এক অদ্ভুত মিশ্রণে ১৯৬২ সালের সংবিধান রচনা করেন, যার মাধ্যমে দেশে প্রেসিডেনশিয়াল (রাষ্ট্রপতি-ভিত্তিক) শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। তবে তাঁরই বাঙালি আইনমন্ত্রী, বিচারপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম এই সংবিধান প্রত্যাখ্যান করে পদত্যাগ করেন।

আলতাফ গওহর তাঁর বইয়ে বারবার দাবি করেছেন, তিনি অনেক চেষ্টা করেছিলেন যেন জেনারেল আইয়ুব খান ও বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে, যাতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার দূরত্ব কিছুটা হলেও কমে।

কিন্তু যখনই তিনি কোনো বাঙালি সাংবাদিক বা সাহিত্যিককে আইয়ুব খানের সঙ্গে দেখা করাতেন, তখন খানের আশপাশে থাকা বাঙালি মন্ত্রীরা সেই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কানভারী করতেন। কারণ তারা আতঙ্কে থাকতেন—যদি কোনো শিক্ষিত, প্রজ্ঞাবান বাঙালি আইয়ুব খানের পছন্দসই হয়ে ওঠে, তাহলে তারা যারা কেবল চাটুকারিতার জোরে ক্ষমতার আশপাশে টিকে ছিলেন, তাদের জায়গা হারিয়ে যাবে।

একবার আলতাফ গওহর আইয়ুব খানকে স্মরণ করিয়ে দেন—আপনি তো ১৯৬২ সালের সংবিধানে ঢাকাকে দেশের দ্বিতীয় রাজধানী ঘোষণা করেছিলেন, অথচ এখনো সেখানে কোনো ফেডারেল দপ্তর স্থানান্তরিত হয়নি।

এই কথা শুনে আইয়ুব খান ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে বলেন: ‘ইয়ার, এরা তো আমাদের সঙ্গে থাকতে চায় না। আমি ঢাকাকে দ্বিতীয় রাজধানী করেছি এই জন্যই, যাতে যখন তারা আলাদা হয়ে যায়, তখন তাদের কমপক্ষে কিছু অফিস তো থাকে।’

জেনারেল আইয়ুব খান একাধিক সিনিয়র অফিসারকে উপেক্ষা করে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন—আর সেই ইয়াহিয়াই পরে নিজের বসের (আইয়ুবের) কাছ থেকে পদত্যাগ করিয়ে আবার মার্শাল ল’ জারি করেন।

আলতাফ গওহরের কাছ থেকে তখন সেই সব বেসামরিক উপাধি ও সম্মান ফিরিয়ে নেওয়া হয়, যা তিনি তাঁর ‘বস’-এর ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে অর্জন করেছিলেন। এরপর তিনি সাংবাদিক ও লেখক হিসেবে নতুন জীবন শুরু করেন।

আগামী সময়ে আলতাফ গওহরের মতো অনেক অবসরপ্রাপ্ত আমলা তাদের বইয়ে আমাদের জানাবেন—জেনারেল জিয়াউল হক, জেনারেল পারভেজ মোশাররফ, বেনজির ভুট্টো, নওয়াজ শরিফ, ইমরান খান এবং শাহবাজ শরিফ তাদের নিজ নিজ শাসনকালে কী ভুলভ্রান্তি করেছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হলো—যখন সেই ভুলগুলো হচ্ছিল, তখনই কেন কেউ তা নিয়ে কিছু বলেনি?

কোনো কর্মরত (হাজির সার্ভিস) আমলা কি সাহস করে বলতে চান, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে, যখন ছয়টি নতুন খালের বিতর্কিত প্রকল্প গোপনে তৈরি করা হচ্ছিল, তখন কোনো সরকারি ফাইলে এই প্রকল্পের মাধ্যমে পাকিস্তানের নিরাপত্তার ওপর সম্ভাব্য হুমকির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল কি না? 

[পাকিস্তানের রোজনামায়ে জং পত্রিকা থেকে লেখাটি অনুবাদ করেছেন: সাইমুম রিদা]

এমএইচ/


সম্পর্কিত খবর



সর্বশেষ সংবাদ