বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ।। ২২ মাঘ ১৪৩১ ।। ৬ শাবান ১৪৪৬


রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকার পক্ষে একটি যৌক্তিক পর্যালোচনা : মুহাম্মাদ শোয়াইব


নিউজ ডেস্ক

নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

বাংলাদেশের সংবিধানে ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংযোজন করা হয়, যা পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যেও বহাল থেকেছে। সাম্প্রতিক সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বহাল রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পক্ষে বেশ কিছু যৌক্তিক দিক রয়েছে, যা ইতিহাস, সামাজিক বাস্তবতা, আন্তর্জাতিক তুলনা এবং জনমতের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

১. ইতিহাস ও সংবিধানগত প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের সংবিধানের মূল চারটি নীতির একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, যা ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে, ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হলে সংবিধানে একটি মিশ্র চরিত্র দেখা যায়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই একাধিকবার ক্ষমতায় এসেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল করার উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি ২০১১ সালের পঞ্চদশ সংশোধনীর পরেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখা হয়েছে, যা নির্দেশ করে যে এটি দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত।

২. জনমত ও গণতান্ত্রিক স্বীকৃতি

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রীয়াজের মতে, কমিশন ৫০,০০০-এরও বেশি মতামত সংগ্রহ করেছে, যার মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যেহেতু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম এবং তারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখার পক্ষে, তাই গণতান্ত্রিক চেতনার স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত যৌক্তিক।

৩. আন্তর্জাতিক তুলনামূলক বিশ্লেষণ

বিশ্বের অনেক দেশেই একটি নির্দিষ্ট ধর্ম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃত। পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা অনুযায়ী, ৮০টিরও বেশি দেশে একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমর্থন করা হয়। ১৯৯টি দেশের মধ্যে ২২ শতাংশ দেশের রাষ্ট্রধর্ম রয়েছে, এবং ২০ শতাংশ দেশ একটি ধর্মকে অগ্রাধিকার দেয়। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যে ইংল্যান্ডের চার্চ রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত, আবার ইরানে ইসলামী শাসনব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম থাকলেও রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় ধর্মের ভূমিকা তুলনামূলকভাবে সীমিত, যা একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান সৃষ্টি করে।

৪. সামাজিক স্থিতিশীলতা ও বহুত্ববাদ

রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা মানেই যে রাষ্ট্রের আচরণ কট্টর ধর্মীয় হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বরং, এটি ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। বহুত্ববাদী সমাজে ধর্মীয় পরিচিতি স্বীকৃতি পাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে প্রতিটি সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব ধর্ম পালনের স্বাধীনতা উপভোগ করতে পারে। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে অন্য ধর্মের চর্চার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব।

৫. আইন ও নীতিগত দিক

বাংলাদেশের সংবিধান ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সাম্যের নীতিতে অটল রয়েছে। হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয়েছে যে, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে রাখা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। তাই এটি আইনি ভিত্তিতেও বৈধ ও টেকসই সিদ্ধান্ত।

রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা বাংলাদেশের ঐতিহাসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এটি রাষ্ট্রীয় নীতির কোনো মৌলিক পরিবর্তন সৃষ্টি না করলেও জনগণের বৃহৎ অংশের অনুভূতিকে প্রতিফলিত করে। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি একটি স্বীকৃত নীতি, যা সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তবে, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখা হলেও অন্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকার সংরক্ষণ করা এবং ধর্মীয় সহাবস্থান নিশ্চিত করাই হবে বাংলাদেশকে একটি উদার ও সহনশীল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার মূল চাবিকাঠি।

আরএইচ/


সম্পর্কিত খবর