বুধবার, ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ ।। ১৪ মাঘ ১৪৩১ ।। ২৯ রজব ১৪৪৬


ট্রাম্পের শান্তির দোহাই: বাস্তবতা কত দূর?

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মাদ শোয়াইব আস-সফাদী

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারি, বলেন যে, "রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যদি ইউক্রেনের সাথে আলোচনা করে যুদ্ধ শেষ করার চুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়, তবে তিনি রাশিয়ার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বিবেচনা করবেন।"

ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের আগে ও পরে তাঁর বক্তব্য পর্যালোচনা করলে অনেকেই বিস্মিত হতে পারেন। বিশেষত যখন তিনি পুতিনকে একজন "চতুর ব্যক্তি" হিসেবে প্রশংসা করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে ইউক্রেন যুদ্ধ কখনো হতো না যদি তিনি থাকতেন এবং এটি তিনি দ্রুত সমাধান করবেন।

কিন্তু তাঁর এই বক্তব্যগুলো তাঁর কাজের সাথে মিল খায় না। তার কথা স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যে ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পূর্ণরূপে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এর উপরে বর্তায়। যা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে উস্কে দেয় এবং এই সংকটকে আরও জটিল করে তোলে।

বিশেষত, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি যখন তার বৈধ মেয়াদকালে একটি ডিক্রিতে স্বাক্ষর করেছিলেন যাতে কিয়েভের পক্ষে মস্কোর সাথে কোনো আলোচনা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তখন কেন ট্রাম্প সমস্যাটি জেলেনস্কির ওপর না চাপিয়ে রাশিয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন?

রাশিয়া মনে করে যে ট্রাম্প তাদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করার জন্য ফাঁদ পাতছেন। বিশেষত, যখন তিনি তার দেশের নিষেধাজ্ঞাগুলোর প্রভাব সম্পর্কে কথা বলেন, যা রাশিয়ার অর্থনীতিকে দুর্বল করেছে, এবং তিনি কিয়েভকে অস্ত্র সরবরাহ করতে প্রস্তুত। এদিকে, ট্রাম্পের প্রধান সমর্থকদের একজন, ইলন মাস্ক, জেলেনস্কিকে "শতকের চোর" বলে আখ্যা দিয়েছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের যুদ্ধগুলো শেষ করতে চান—এটা সঠিক নয়। কারণ তিনি কোনো শান্তির দূত নন যে, যুদ্ধ শেষ করবেন। তাঁর সেই উক্তি, "শান্তি জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠা করব," এ কথার মাধ্যমে এটি স্পষ্ট হয়। তবে প্রশ্নটি হলো: ট্রাম্প ঠিক কোন ধরনের শান্তি বিশ্বের উপর চাপিয়ে দিতে চান? আর সেই "জোরপূর্বক" মানে কি অস্ত্রের ব্যবহার?

ইউক্রেনের শান্তি ট্রাম্পের কাছে কেবল একটি কল্পনা হতে পারে। কারণ ইউক্রেনের যুদ্ধ অত্যন্ত জটিল ও পরস্পর সংযুক্ত। 

অন্যদিকে চীনের প্রতি তাঁর "উদারনীতি" হয়তো স্রেফ মিডিয়ার সামনে কিছু বলার জন্য, যদিও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সঙ্গে তাঁর একটি সংলাপ হয়েছে। যেখানে বৈশ্বিক উন্নয়নের জন্য সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে।

তবে দুই দেশের শত্রুতা গ্রিক ঐতিহাসিক থুসিডিডিসের তথাকথিত "থুসিডিডিস ফাঁদ" ভিত্তিক, যেখানে একটি শক্তি (চীন) উত্থানশীল এবং আরেকটি শক্তি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) প্রভাবশালী, যা সংঘর্ষকে অনিবার্য করে তোলে।

চীনের সঙ্গে কোনো শান্তি সম্ভব নয়। ট্রাম্প যে চীনা আমদানির ওপর কর ১০% বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন, সেটাই এর প্রমাণ। আরও প্রমাণ হল, ট্রাম্পের সেই দাবি যে, চীনা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম "টিকটক"-কে মার্কিন বাজারে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হলে তাদের ৫০% শেয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হস্তান্তর করতে হবে। এর আগে একটি মার্কিন আদালত "টিকটক"-এর সম্প্রচার নিষিদ্ধ করার রায় দিয়েছিল।

পরিষ্কার যে ট্রাম্প যা করছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক আধিপত্য বজায় রাখারই অংশ, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে।

ট্রাম্পের "আমেরিকা ফার্স্ট" স্লোগান শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানের জন্য।

 তিনি কেবল "মনরো নীতিতে" থেমে থাকবেন বলে মনে হচ্ছে না। বরং আরও আগ বাড়িয়ে তাঁর আমলে ১৮২৩ সাল থেকে কার্যকর এই নীতির আরও দৃশ্যমান বাস্তবায়ন দেখা যাবে। এই নীতির আওতায়, পশ্চিম গোলার্ধের দুই মহাদেশ—উত্তর আমেরিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার- বিদেশি দেশের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখা হবে।

ট্রাম্প চায় যে তার দেশের জিওপলিটিক্যাল প্রতিদ্বন্দ্বীরা, রাশিয়া ও চীন, তাদের গতিবিধি রোধ করা হোক, যেমন গ্রীনল্যান্ড দ্বীপের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, যা রাশিয়ার সাথে উত্তরের মেরু অঞ্চলে একটি "মুখোমুখি অবস্থান" হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া, পানামা খালকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়, কারণ চীনা কোম্পানিগুলো সেখানে দুটি বন্দরের মাধ্যমে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেছে, যা মার্কিন নৌ চলাচলের জন্য বাধা সৃষ্টি করছে।

ট্রাম্প শুধু এই দেশগুলোর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রকাশেই থেমে থাকেননি, তিনি আরও একটি কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন: একটি নির্বাহী আদেশে কিউবা-কে আবার "সন্ত্রাসী দেশ" হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের তালিকায় পুনঃস্থাপন করেছেন, যা তার পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সময়ে দেয়া অব্যাহতি বাতিল করেছে।

ট্রাম্পের দৃষ্টি "মনরো ডকট্রিন"-এর দিকে, কারণ অভ্যন্তরীণ সংকট এখন যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো প্রশাসনের জন্য একটি বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, গত নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের পরাজয় শুধু কমলা হ্যারিসের দুর্বল ব্যক্তিত্বের কারণে নয়, বরং কারণ আগামী সময়ের জন্য একজন সাহসী নেতা দরকার, এমন একজন নেতা যার সিদ্ধান্তগুলো "পাগলামি"র পর্যায়ে হয়। 

আর এর জন্য, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই সবচেয়ে উপযুক্ত, যিনি এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুদের সাথে সংঘর্ষে পরিণত হতে পারে, যেমন ইরানকে আঘাত করার সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে মার্কিন ও ইসরায়েলি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের মধ্যে "পাকা" হয়ে উঠেছে এবং এখন শুধু সঠিক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে।

আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না যে ট্রাম্পের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেবে। এটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই যে, ওয়াশিংটন চীনের জন্য বৈশ্বিক নেতৃত্বের আসন ছেড়ে দেবে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেসব ঘোষণা দিয়েছে, সেগুলো আসলে একটি আমেরিকান কৌশলেরই অংশ। চীন বলছে যে তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (WHO) সহায়তা করবে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই WHO থেকে বেরিয়ে গেছে। তিনি ২০ জানুয়ারি এক বক্তব্যে বলেছিলেন, "এই সংস্থা আমাদের ঠকাচ্ছে।" এটি স্পষ্ট করে যে, ট্রাম্প প্রশাসন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি আস্থাহীন এবং বৈশ্বিক নেতৃত্ব ধরে রাখার জন্য বিকল্প কৌশল অবলম্বন করছে। চীনের বক্তব্য শুধুমাত্র একটি ছলনার আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এবং অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করার প্রয়াস।

ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনোই চান না যে তার দেশ বৈশ্বিক নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াক বা সেই আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাক, যা যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরে গড়ে উঠেছে। বরং তার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক হুমকিগুলোকে নির্মূল করা।
ট্রাম্পের শাসনামলে রাশিয়া ও চীন এমন একটি অবস্থানে পৌঁছেছে, যেখানে তারা মনে করছে, বৈশ্বিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে তারা খুবই নিকটবর্তী। এমন প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প কি নিরব থাকতে পারেন? উত্তর হলো—না। তিনি এমন একজন নেতা, যিনি সংকটময় পরিস্থিতিতে আক্রমণাত্মক কৌশল গ্রহণে দ্বিধা করেন না।

তাঁর নীতির মূল লক্ষ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করা এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রভাব খর্ব করা। এটি স্পষ্ট যে, ট্রাম্প বৈশ্বিক নেতৃত্ব ধরে রাখার লড়াইয়ে কখনো পিছু হটবেন না। বরং, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাবেন, এমনকি যদি সেটি সংঘাত বা দ্বন্দ্বের মাধ্যমে হয়।

তবে প্রশ্ন থেকে যায়: এই সবকিছুর পরিণতি কী? ট্রাম্পের কৌশল হয়তো যুক্তরাষ্ট্রকে সাময়িকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে রাখবে, কিন্তু এটি বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে নতুন সংঘাতের জন্ম দিতে পারে। তাঁর সিদ্ধান্তগুলো শুধু বর্তমান বিশ্বের অস্থিরতা বাড়াচ্ছে না, বরং ভবিষ্যৎ শান্তির জন্য আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি করছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো একজন "সাহসী নেতা" হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, কিন্তু তাঁর কর্মকৌশল মূলত সংঘাতমুখী। তাই বিশ্বকে শান্তি উপহার দেওয়ার জন্য নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্যই ট্রাম্পের প্রতিটি পদক্ষেপ। শান্তির নামে নতুন যুদ্ধ তৈরি করা এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন করার এই নীতি এক অর্থে "শান্তির নামে অশান্তি"র দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

আল জাজিরা অ্যারাবিকের জীরার দীব এর কলাম অবলম্বনে


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ