সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪ ।। ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ৩০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬


মাওলানা কারী বেলায়েত হুসাইন রহ. : প্রখ্যাত তিন আকাবিরের সোহবতধন্য

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

|| শায়খুল হাদিস আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ. ||

আশরাফুল উলূম বড়কাটারা মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের প্রখ্যাত তিন আকাবির তথা হজরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ., হজরত মাওলানা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. এবং হজরত মাওলানা আবদুল ওহাব পীরজি হুজুর রহ.-এর হাত ধরে। আমাদের এই আকাবিরে সালাসাহ (তিন আকাবির) দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ফারেগ হয়ে প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়ায় খেদমত নেন। পরে এক মহান লক্ষে তাঁরা ঢাকা শহরে আগমন করেন। সে সময় ঢাকায় দেওবন্দি ধারার মাদরাসা ছিল না। যার কারণে রাজধানী ঢাকা অনেক কুসংস্কার আর বিদআতি অপকর্মে জর্জরিত ছিল। মানুষ মিলাদ-কিয়ামসহ অনেক কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করতো। কিন্তু মানুষের মূল ইসলাহ (সংশোধন) নিয়ে কোনো কাজই হতো না।

দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম হাকিমুল ইসলাম শাহ তৈয়্যেব সাহেব রহ. বলতেন,

‘কুওয়ি কওম সের দফা জিন্দেগি নে নাহ রাহ সেহতা হ্যায়

তা ওকতে ক্যাহ উসকে বাদ এগজামি ফয়লুলাহ হু সেক্যা’

‘কোনো জাতি আত্মরক্ষামূলক কর্মসূচি টিকিয়ে রাখতে পারে না,

জাতি আগে বাড়ে গঠনমূলক কর্মসূচি গ্রহণের দ্বারা।’

তাই আমাদের এই আকাবিরে সালাসা গঠনমূলক কর্মসূচি হাতে নেন। বড়কাটারা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তালিম-তরবিয়াতের কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি ঢাকার মানুষকে দীনমুখী করার চেষ্টা চালাতে থাকেন। মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টিমূলক আলোচনা না করে ঐক্য, কল্যাণ ও সংশোধনী বিষয়ে মানুষকে আগ্রহী করে তোলেন। কুসংস্কার ও বিদআতমুক্ত করতে তাঁরা কৌশল অবলম্বন করলেন। তাঁরা ছিলেন উন্নতমানের, তাই তাঁদের তালিম-তরবিয়াতও ছিল উন্নতমানের। আর এ কারণে বড়কাটারা মাদরাসা অল্প কয়েক দিনের ভেতরেই সারাদেশে প্রসিদ্ধি লাভ করে। সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা বড়কাটায় জড়ো হতে শুরু করে। এখান থেকেই একটা রেনেসাঁ তথা সংস্কারমূলক আন্দোলন শুরু হয়। ফিকরে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রচার-প্রসার এখান থেকে চলতে থাকে।

আর এই তিনজনেরই বিশেষ সম্পর্ক ছিল দারুল উলুম দেওবন্দের সূর্যসন্তান হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ.-এর সাথে। তাঁরা ছিলেন থানভী রহ.-এর বিশেষ শাগরেদ। এজন্য তিনজনেরই ইসলাহে বাতেনি হয়েছে থানভী রহ.-এর মাধ্যমে। একদিকে আকাবিরে সালাসার ইলমে জাহেরি হয়েছে, অপরদিকে ইলমে বাতেনি তথা আত্মশুদ্ধিও হয়েছে। ইলমে জাহেরিতে তাঁরা মাহের হওয়ার সাথে সাথে তাযকিয়ায়ে নফসেও তাঁরা উন্নতি লাভ করেন। এর মধ্যে অগ্রগামী ছিলেন হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ.। আমাদের এই তিন আকাবিরের মেহনত পরিশ্রমের ফলে মৌলিকভাবে ঢাকা রাজধানীতে দেওবন্দি মাদরাসা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সাধিত হয়।

যেহেতু দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্ররা তাদের স্বপ্নের মাদরাসায় পড়তে আসতো, সে সুবাধে কারী বেলায়েত সাহেব রহ.ও বড়কাটারা মাদরাসায় পড়তে এলেন। পড়াশোনার পশাপাশি আকাবিরে সালাসার কাছ থেকে ব্যক্তিগত ফায়দাও হাসিল করেন তিনি। বিশেষভাবে হজরত হাফেজ্জী হুজুরের সাথে তাঁর ইসলাহি সম্পর্ক ছিল। আর তাঁর অন্তরে কুরআনে কারিমের খেদমতের ব্যাপারে ছোটবেলা থেকেই একটা জযবা, একটা ব্যথা-বেদনা কাজ করছিল। হজরত হাফেজ্জী হুজুরের সোহবত তাঁর সে ব্যথা-বেদনাকে আরও বেগবান করে। কুরআনে কারিম বাচ্চাদেরকে কীভাবে আসানের সঙ্গে পড়ানো যায় এবং উম্মতের ঘরে ঘরে কীভাবে পৌঁছানো যায়- এ নিয়ে তিনি গবেষণা শুরু করেন। একপর্যায়ে ‘ওল্লাযিনা জাহাদু ফি-মা লানাহদিয়ান্নাহুম সুবুলানা’ হিসেবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর জেহেন খুলে দেন। এবং তিনি আসানির সাথে বাচ্চাদের অন্তরে কুরআনে কারিম প্রবেশ করানোর পদ্ধতি পেয়ে যান। যা নূরানী পদ্ধতি নামে পরিচিতি লাভ করে।

এরপর তিনি চিন্তা করলেন, শুধু কুরআনে কারিম পড়ালে এদেশের বাচ্চারা শুধু কুরআনের জ্ঞান পাবে, কিন্তু মাতৃভাষা ও পরিবেশ শিখতে পারবে না। তাই তিনি কুরআনে কারিমের সাথে বাংলা, অংক, ইংরেজিও সহজ পদ্ধতিতে পড়াতে শুরু করেন। এভাবে পড়াতে পড়াতে তিনি একপর্যায়ে সংস্কারমূলক একটা নেসাব তৈরি করে ফেলেন। নেসাবে বাংলা, অংক, ইংরেজি রাখায় সেসময় কেউ কেউ তাঁর সমালোচনায়ও করেছিল। তবে আমি মনে করি, এ ব্যাপারে তাঁর চিন্তা সঠিক ছিল।

কারী বেলায়েত সাহেব রহ.-এর এক নম্বর বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি আলেম ছিলেন। দুই নম্বর বৈশিষ্ট্য হলো- তাঁর ইসলাহি বাতেনি হয়েছে আকাবিরে সালাসা হতে। তিন নম্বর বৈশিষ্ট্য হলো- তিনি মাশ^াক কারী ছিলেন। এই তিন বৈশিষ্ট্য এক সাথে হওয়ার কারণে তাঁর কাছে যেসব মুয়াল্লিম ট্রেনিং নিতে আসতো, তাদেরকে তিনি আলেম হিসেবে আলেমের দায়িত্ব পালন করতে এলেম শিক্ষা দিতেন। আর যেহেতু হজরত হাফেজ্জী হুজুর থেকে ইসলাহে বাতেনি হয়েছিল, তাই তিনি মুয়াল্লিমদের কুরআন পড়ানোর সহজ পদ্ধতি শিক্ষা দেয়ার সাথে সাথে ইসলাহে বাতেনিও শিক্ষা দিতেন। কুরআনের আজমত, বড়ত্ব মুয়াল্লিমদের সিনায় ঢুকিয়ে দিতেন। সে সঙ্গে কুরআনে কারিম শেখানোর জন্য তাঁর অন্তরে যে ব্যথা-বেদনা ছিল সেসব ব্যথা-বেদনা মুয়াল্লিমদের অন্তরেও মুন্তাক্বিল (স্থানান্তরিত, জাগরুক) করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি আলেম হিসেবে ইলমের তরবিয়াত করেছেন, তাজকিয়ায়ে বাতেনির লাইনেও তরবিয়াত করেছেন, কুরআনে কারিম নিয়ে যে ব্যথা-বেদনা তাঁর মনে ছিল সেসব তিনি মুয়াল্লিমদের অন্তরে গাঁথতে সক্ষম হলেন। যে কারণে তাঁর কাছে যারা সরাসরি তালিম গ্রহণ করেছেন, তাদের তিন লাইনের ইসলাহই হয়েছে। ইসলাহের কারণে আলহামদুলিল্লাহ তাঁর জীবদ্দশাতেই সারাদেশে নূরানী পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশে এই পদ্ধতিতে হাজার হাজার নূরানী-মক্তব গড়ে ওঠেছে। এটা একটা সংস্কার আন্দোলনও বটে। এই আন্দোলনের ফলে দেশের অনেক বড় ফায়দা হয়েছে।

কুরআনি শিক্ষা এমন এক শিক্ষা, যার দ্বারা মানুষের ইহকাল-পরকালে শান্তি আসে। যার দ্বারা আল্লাহ পাকের মহব্বত অন্তরে সৃষ্টি হয়। যার দ্বারা অন্তরের জং দূর হয় এবং যার দ্বারা বান্দার সম্পর্ক আল্লাহ পাকের সাথে মজবুত হয়। এজন্য কুরআনের তেলাওয়াত জানা খুবই জরুরি। হজরত কারী বেলায়েত সাহেব রহ. কুরআন তেলাওয়াতের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তেলাওয়াত তাসহিহ করার গুরুত্ব দিয়েছেন। নিজে মশকও করিয়েছেন। মেহনত করেছেন প্রচুর। খাওয়া-দাওয়ারও খবর ছিল না। তিনি তাঁর কাজে ছিলেন ফানা। মুআল্লিমদের মধ্যে ব্যথা-বেদনা যাতে স্থানান্তরিত হয়, সেজন্য আল্লাহর দরবারে হাত তুলে তুলে কাঁদতেন।

আল্লাহ পাক তাঁর দ্বারা তাজদিদি কাজ নিয়েছেন। আজ শুধু বাংলাদেশ নয়, বহির্বিশে^ও বিভিন্ন জায়গায় নূরানী তরজের শিক্ষা চলছে। মোটকথা, তিনি একজন সংস্কারক ছিলেন। বিশেষভাবে আকাবিরে সালাসার সোহবত তাঁর জীবনকে অলঙ্কৃত করেছে। প্রকৃত মানুষ বানানোর উত্তম ও শক্তিশালী মাধ্যম সোহবত। আর তিনি তিনজন আকাবিরের সোহবত লাভ করেছেন। এজন্য তিনি নিজেকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়তে সক্ষম হয়েছেন। কথায় আছে, মানুষ নিজে বনে অন্যকে বানানো যায় না। তিনি বনেছেন বিধায় আল্লাহ পাক তাঁর দ্বারা অন্য মানুষ বানানোর তাওফিক দিয়েছেন।

আল্লাহ তায়ালা তাঁর ছেলেদেরকেও তাঁর মতো ফিকিরমান্দ বানিয়েছেন। তাই বর্তমানে তাঁরা তাঁদের বাবার রেখে যাওয়া আমানতের হাল ধরেছেন। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর ছেলেদের ব্যাপারে আমার জানাশোনা আছে। ফয়জুল্লাহ, কালীমুল্লাহ আমার কাছে পড়েছে। শুধু পড়া নয়, আমার সঙ্গে তারা আন্তরিক সম্পর্কও রেখেছে। কালীমুল্লাহ তো আমার খাদেমও ছিল। আমি তাদেরকে বাস্তবেই আন্তরিক মহব্বত করি। তাদের আমল আখলাক, কথাবার্তা সবকিছুতে তারা ভদ্র। দিল থেকেই তাদের মহব্বত করি। আর আহমাদ উল্লাহ আমার কাছে মাঝে মাঝে আসতো। ইসমাঈল আমার কাছে না পড়লেও ভালো সম্পর্ক রাখতো। তাদের বাবা না থাকলেও ছেলেরা এখনও আমাকে যথেষ্ট সম্মান করে। এইতো কয়েক বছর আগে উমরার সফরে তাঁর এক ছেলে কী সম্মানটাই না করলো! আমার যথেষ্ট খেদমত করেছে। আমি দোয়া করি আল্লাহ যেন তাদের হায়াতে বরকত দান করেন।

কারী বেলায়েত সাহেবের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত গভীর সম্পর্ক ছিল। তিনি মাঝে মাঝে মুশাওয়ারার জন্য আমাকে ডাকতেন। তাঁর তালিমের মধ্যে কী করলে ভালো হয় পরামর্শ চাইতেন। কোন জায়গাটা ইসলাহ করা দরকার তা জানতে চাইতেন। আমাদের বেশিরভাগ সাক্ষাৎ হতো মোহাম্মদপুরে। পরামর্শ বৈঠকে তিনি আরও অনেক আলেমকেও দাওয়াত করতেন।

আমার শ^শুরবাড়ি চাঁদপুরের খেড়িহর গ্রামের পাশে শ্যামপুর গ্রামের সরদার বাড়ি। এই সরদার বাড়ির সঙ্গে উনার আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। খুব সম্ভব কালীমুল্লাহদের মামার বাড়ি খেড়িহর। সে সুবাধে আমার শ^শুরবাড়ির সাথে তাদের আত্মীয়তার একটা সূত্র আছে।

ব্যক্তিগতভাবে তিনি অত্যন্ত চরিত্রবান, আদর্শবান লোক ছিলেন। ফিকরে আকাবিরে সালাসা ছিলেন। মুত্তাবাউস সুন্নাহ ছিলেন। কুরআনে কারিমের আশেক ছিলেন। উনার বুকে কুরআনে কারিমের তালিমের একটা ব্যথা বেদনা গালেব ছিল।

আমার মেয়ের জামাই থাকতো নবাবগঞ্জ। সেখানেও নূরানীর মেহনত চলতো। কারী বেলায়েত সাহেব সেখানে যেতেন। মুআল্লিমদের মশক করাতেন। তিন চার দিন তাঁকে থাকাও লাগতো। আমিও মাঝে মাঝে আমার জামাইয়ের কাছে যেতাম। সে সুবাধে কারী বেলায়েত সাহেবের মেহনত দেখতাম। কী আশ্চর্য! তাঁর খাওয়া-দাওয়ার কোনো ফিকির নাই। সারা দিন-রাত শুধু মুআল্লিমদের প্রশিক্ষণ আর তাদেরকে গড়ে তোলার মেহনত নিয়েই পড়ে থাকতেন। সে সময় দেখা তাঁর এই মেহনতগুলো আমার চোখে আজও ভাসছে। অন্তরের ব্যথা-বেদনাই মূলত তাঁকে এরকম ব্যতিব্যস্ত করে রাখতো। মূলত ওপর আকাবিরে সালাসার সোহবত তাঁকে সত্যিকারার্থেই একজন আদর্শ শিক্ষকে রূপান্তরিত করে।

বর্তমানে যারা নূরানীর কাজ করছেন, তাদের ব্যাপারে আমার আহ্বান থাকবে:

এক. তারা যেন কারী বেলায়েত সাহেবের মতো ইলমে কেরাতে মাহের হন।

দুই. যেকোনো আহলুল্লাহ’র কাছ থেকে তাজকিয়ায়ে বাতেন যেন হাসিল করেন।

তিন. তাঁর অন্তরে যে ব্যথা বেদনা ছিল, তা যেন মুআল্লিমরা নিজেদের অন্তরে জাগ্রত রাখেন।

তাহলে তাঁর ফিকিরটা সঠিকভাবে মুনতাক্বিল হবে এবং তাঁর সত্যিকারের উত্তরসূরি হওয়া যাবে। দুনিয়ামুখি না হয়ে আখেরাতমুখি হতে হবে। টাকা-পয়সার চিন্তা করে এ খেদমত করলে হবে না। তিনি টাকা পয়সার পেছনে দৌড়াননি। কাজেই মুআল্লিমদের এই গুণগুলো অর্জন করা চাই।

আল্লাহ পাক কারী বেলায়েত সাহেবের কবরে ভরপুর নূর দান করুক। আলোকিত করুক। আর তাঁর সন্তানদেরকে বাবার রেখে যাওয়া আমানতকে আগে বাড়ানোর তাওফিক দিন। আমিন।

লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা; সাবেক মহাসচিব, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ

নোট: আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ. ১৩ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের কয়েক মাস আগে স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি নেওয়া হয়।  

হাআমা/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ