|| শরীফ মুহাম্মদ ||
সতের বছর বয়স তখন। ফরিদাবাদ মাদরাসায় পড়ি। শরহে বেকায়া জামাতে। এ বছরেই এক সময় হঠাৎ বন্যার পদধ্বনি শোনা যেতে লাগল। একেকদিন একেক জেলা বন্যার পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। খবর আসছে পত্র-পত্রিকায়। ঢাকার চারপাশে বন্যা। দেখতে দেখতে বুড়িগঙ্গাও যৌবন পেয়ে গেছে। ফুঁসে উঠে ড্রেন-নালা, খাল-ক্যানেল দিয়ে ঢাকা ঢুকে পড়ছে তার পানি।
একদিন ফজরের পর মাদরাসার ভেতরের ড্রেন দিয়ে দেখলাম একটু একটু পানি উঠছে মাঠে। উদ্বেগ ও আতঙ্কের চেয়ে উত্তেজনা ও চাঞ্চল্য বোধ করলাম বেশি। কম বয়সের কারণে ও মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা হলে ছুটি প্রাপ্তির ঘোরে বন্যার ক্ষতিকর দিকটি মাথাতেই এলো না প্রথমে। ওই দিনই সকাল দশটার দিকে মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা করা হলো। বলা হলো, যারা তাবলিগে যাবে, তারা যেন নাম লিখিয়ে দেয়। বুঝে না বুঝেই নাম দিয়ে দিলাম। এরপর দুপুরের আগে কাকরাইল ও বিকেলের মধ্যে আদমজী জুট মিলে।
তাবলিগ জামাতে সময় লাগানোর আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। তিন দিনের জামাত। কাকরাইল থেকে পাঁচ-ছয়জন যুক্ত হলেন। বাকিরা ছিলাম এক মাদরাসারই বিভিন্ন ক্লাসের ছাত্র। এ ছিল অন্য রকম নিমগ্নতায় কৈশোরের শেষবেলা। আদমজী জুট মিলে থাকতে থাকতেই খবর পেলাম বন্যায় ডুবে যাচ্ছে সারাদেশ। উদ্বেগ চেপে বসল। নিজেদের বিপন্নতার আশঙ্কার পাশাপাশি অন্যদের দুর্ভোগ ও অসহায়ত্ব নিয়েও মন খারাপ হতে লাগল। তিন দিন শেষ হওয়ার পর যখন জামাতসহ বাসে ফিরছি তখন যাত্রাবাড়ীতে এসে আমাদের মাদরাসার দলটি নেমে পড়লাম। নেমেই দেখলাম, চারদিকে পায়ে হাঁটা মানুষের স্রোত। ফরিদাবাদ পর্যন্ত যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। রাস্তাই নাকি নেই। চমকে উঠলাম। সেটি ছিল সেই আটাশির বন্যা।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবাই পোস্তগোলার দিকে গাট্টি-বোঁচকা মাথায় নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। জায়গায় জায়গায় দেখলাম, বালি ও সিমেন্টের বস্তা এনে সাধারণ মানুষ রাস্তার উপর ফেলছেন। উপরের অংশের পানি যেন এই নিম্নাঞ্চলে চলে না আসে সেজন্য রাস্তা এক পর্যায়ে আটকে দিয়ে হাজার হাজার মানুষ খাঁটাখাঁটুনি করছেন। পোস্তগোলায় যাওয়ার সময় রাস্তা থেকে বায়ে নেমে ম্যাচ ফ্যাক্টরির সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে গেলাম। দলবদ্ধ মানুষের স্রোতের সঙ্গে। এরপর পোস্তগোলা থেকে ফরিদাবাদে গেলাম কোমর সমান পানিতে ডুবে। একটি ভ্যানে সামানা তুলে তার চারপাশে ছিলাম আমরা। মাদরাসায় পৌঁছলাম সন্ধ্যার আগে। এরপর চারদিক ভুতুড়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। দুর্ঘটনা এড়াতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ফাঁকা মাদরাসায় সারারাত আমরা ক’জন ভয়ে ভয়ে কাটালাম। প্রাণভরে দোয়া করলাম। নিজেদের বাড়িঘর ডুবে যাওয়া, বাসা বাড়িতে যেতে না পারার দুশ্চিন্তা নিয়ে অস্থির হয়ে আল্লাহর দরবারে কাঁদলাম।
পরদিন সকালে প্রথমে সদরঘাট ও পরে কমলাপুরে গিয়ে হাজির হলাম। একটা ট্রেন পেতে পেতে দুপুর ও ময়মনসিংহে গিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত আটটা। ট্রেন থেকে নেমে বাসায় যাওয়ার পথে দেখলাম ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল মহাসড়কের প্রান্ত ছুঁয়ে আছে ব্রহ্মপুত্রের পানি। কোনো কোনো জায়গায় রাস্তা কিছুটা ভেঙে ভেঙে আছে। রিকশাচালককে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, গত দুই দিন একটু একটু করে পানি চুয়ে চুয়ে শহরে ঢুকছিল। আজ বন্ধ। আজ থেকে বরং পানি একটু একটু কমছে। বাসায় গিয়ে পৌঁছার আগেই প্রশান্তি এসে ঠাঁই পেল মনে।
এরপর যখন বাসায় পৌঁছলাম তখন মনে হলো, বড় কোনো বিপর্যয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর আবার যেন পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া গেছে। আল্লাহ তায়ালার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায় হৃদয়-মন আপ্লত হয়ে গেল। জীবনে প্রথম তাবলিগের সফরের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল গভীর উৎকণ্ঠার ঘটনা। আবার সফর শেষের সঙ্গে ছিল প্রশান্তির অভূতপূর্ব অনুভূতি। এ উদ্বেগ ও প্রশান্তির কলকাঠি আমার হাতে ছিল না। ছিলাম কেবল ফলভোগী। আল্লাহ তায়ালার কাছে আত্মসমর্পণ ও সাহায্য চাওয়ার সবক শেখায় তার দীনের মেহনত। এই মেহনতে নিমগ্নতার একটি প্রধান উপায় তাবলিগ জামাত। এ জামাতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করার সৌভাগ্য আল্লাহ তায়ালা সবাইকে দান করুন। আমিন।
লেখক : আলেম, সাংবাদিক ও লেখক
কেএল/