প্রতিবার নামাজের সময় হলেই নিজের অজান্তেই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে পড়েন কুহিনুর বেগম। আজও তার মনে হয়, নামাজ শেষে মসজিদ থেকে ফিরে ছেলেটা দরজায় কড়া নাড়বে। ১৭ বছরের মো. জিহাদ হাসান কুহিনুর বেগমের তিন সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। নিয়মিত মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ত। কিন্তু গত ৫ আগস্ট, দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনের পতনের পর বিজয় মিছিলে যোগ দিতে গিয়ে যাত্রাবাড়ী থানা ভবনের সামনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়। তবু মা কুহিনুর বেগমের এখনও মনে হয়, ছেলেটা যেন তার আশপাশেই আছে।
তিনি বলেন, ‘আমি এখনও আমার ছেলের উপস্থিতি অনুভব করি। ও নামাজ পড়ত অনেক মনোযোগ দিয়ে, সময় নিয়ে। এখনও মনে হয়, সে আমার সামনেই নামাজ পড়ছে। ‘মনে হয়, ছেলে ফিরে আসবে। তাই আগের মতোই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। কোথাও যেতে পারি না, এই ভেবে যে, ও আসবে।
’ মধ্য চল্লিশের এই মা অনন্ত অপেক্ষা আর গভীর শোক নিয়ে এসব কথ বলেন। মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী জিহাদের মা কুহিনুর বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ছেলেটার কথা বললেই বুকটা ধুক করে ওঠে।’
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর শনিরআখড়া এলাকার শেখদী এলাকার ভাড়া বাড়িতে প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে এসব স্মৃতি তুলে ধরেন তিনি। জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছিল জিহাদ। কুহিনুর ভয়ের কারণে বারবার তাকে আন্দোলনে না যেতে অনুরোধ করেন। কুহিনুর বেগম একবার, ১৭ জুলাই, ছেলে যেন আর রাস্তায় না নামে, সে আশায় তাকে বকেছিলেন, এমনকি শাস্তিও দিয়েছিলেন। কিন্তু জিহাদের জবাব ছিল: ‘যখন রাস্তায় আমার ভাইয়েরা মারা যাচ্ছে, তাদের রক্ত ঝরছে, তখন আমরা ঘরে বসে থাকব?’ মায়ের শত আপত্তি সত্ত্বেও ১৮ জুলাই রাস্তায় নামে জিহাদ এবং সেখানে রাবার বুলেটের আঘাতে আহত হয়।
শহীদ হওয়ার আগের দিন, ৪ আগস্ট, জিহাদ মাকে কথা দিয়েছিল ‘আর একদিন’ আন্দোলনে যাবে। কে জানত, সেটাই হবে তার জীবনের শেষ দিন? সেদিন সকালে, ১০টা ৩০ মিনিটের দিকে ঘুম থেকে উঠে মুড়ি আর আম দিয়ে নাশতা করেছিল জিহাদ। তারপর ছোট ভাই ৯ম শ্রেণির ছাত্র তাহনিন হাসান হামিমের সঙ্গে হাসি-তামাশায় মেতে ওঠে। মা বলেন, ‘আমার ছেলে খুব চুপচাপ ছিল। হাসলেও শব্দ করত না। কিন্তু ৫ আগস্ট সে এক অদ্ভুতভাবে হাসছিল, যা আমরা আগে দেখিনি।’
সেদিন জোহরের নামাজে যাওয়ার আগে মাকে বলেছিল—একটা ডিম সিদ্ধ করে রাখতে। ফোনটাও রেখে গিয়েছিল ঘরে। কে জানত, সেটাই তার নীরব বিদায়! পরিবার জানায়, নামাজ শেষে বিজয় মিছিলে অংশ নেয় জিহাদ। প্রত্যক্ষদর্শী শান্তর বরাতে জানা যায়, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে মিছিলে সে সামনে ছিল। সেখানেই খুব কাছ থেকে পুলিশ গুলি ছোড়ে। একটি গুলি জিহাদের কপাল ভেদ করে তার প্রাণ কেড়ে নেয়।
জিহাদের মা বলেন, আমার ছেলে ছিল ধর্মভীরু। মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ত, কুরআন তেলাওয়াত করত, নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করত। মসজিদেই যেন তার শান্তি ছিল। চুপচাপ স্বভাবের হলেও জিহাদ ছিলেন অত্যন্ত উদার। মায়ের ভাষায় 'ওর পকেট মানি জমিয়ে পথশিশুদের জন্য খরচ করত, আত্মীয়দের সাহায্য করত, এমনকি রোজায় নিজের টাকায় মসজিদে ইফতার করাত।’
কুহিনুর বলেন, ‘আমার ছোট বোন খুব গরিব। আমি যখন ভালো কিছু রান্না করতাম, জিহাদ বলত—মা, ওদের একটু দাও। চাকরি পেলে খালার দায়িত্ব নেবে বলত।’ পিতা মো. আলম মিয়া (৫০), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) একজন লাইনম্যান। তিনি বলেন, ছেলের স্বপ্ন ছিল পরিবারকে এগিয়ে নেওয়ার। ‘আমি ওকে বলেছিলাম, তুই যদি প্রশাসনে যাস, খুশি হব। ও বলেছিল, এইচএসসি পাস করে আমার স্বপ্ন পূরণ করবে।’
আলম বলেন, ৭ জুলাই তিনি ও জিহাদ লন্ডন থেকে আসা এক আত্মীয়ের সঙ্গে জিহাদের পড়াশোনা নিয়ে কথা বলেন। ছেলের স্বপ্ন ছিল মায়ের জন্য ছাদবাগানসহ একটি বাড়ি বানানো, বাবার জন্য গাড়ি কেনা, আর বাবার কষ্টের জীবন থেকে অবসর এনে দেওয়া। জিহাদের বড় বোন আফরিন বিনতে আলম, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, বলেন, ‘ভাইয়া আমার খুব কাছের ছিল। সব কথা আমার সঙ্গে শেয়ার করত। বিদেশে পড়তে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল আমাদের দুজনের। ভাইয়া বলত, তুই বিদেশে গেলে আমার প্রিয় খাবার রান্না করে দিবি।’ কান্নাজড়ানো কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘সোমবার মারা যাওয়ার আগে বলেছিল, শুক্রবার তোর হাতের প্রিয় খাবার খেতে চাই। শুক্রবার তো এসেছিল, কিন্তু ভাইয়া ছিল না।’ আজও ভাইয়ের ঘরে ঢুকলে যেন তার সঙ্গেই কথা বলেন আফরিন, ‘ভাইয়া, আমি তোর রুমে আসছি। কিন্তু রুমটা এখন খালি।’
মৃত্যুর ১০ দিন আগে একবার স্বপ্ন দেখেছিল জিহাদ, সে মারা যাচ্ছে। বোনকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমি কি সত্যিই মারা যাব?’ আফরিন তখন বলেছিল, ‘না, না, তুই মরবি কেন?’ আফরিনের স্বামী তানভির আহমেদ বলেন, ‘জিহাদ ছিল ছাত্র আন্দোলন নিয়ে খুব আশাবাদী। একদিন বলেছিল, এই আন্দোলন সফল হবেই।’ কিন্তু হতাশার কথা হলো, আন্দোলন সফল হলেও জিহাদ তার বিজয় দেখে যেতে পারেনি। ৫ আগস্ট বিকেলে জোহরের নামাজের পরেও জিহাদ বাসায় না ফেরায় পরিবার ভেবেছিল সে হয়তো শাহবাগ বা গণভবনে গেছে।
তানভির বলেন, ‘মাগরিব নামাজের পরও না ফেরায় আমরা উদ্বিগ্ন হই। খোঁজাখুঁজি শুরু করি। রাত ৯টা ৩০ মিনিটে জিহাদের বন্ধু নাঈম ফেসবুকে দেখে—একটি মৃতদেহের ছবি দিয়ে লেখা 'এ যুবকের পরিচয় জানা যায়নি, লাশ রাখা হয়েছে দনিয়া বড় মসজিদের সামনে।' নাঈম তখনই পরিবারকে জানায়।
‘পরে আমরা দনিয়া মসজিদে যাই। দেখলাম গোসলের জন্য প্রস্তুতি চলছে। টর্চলাইটের আলোয় ভাইয়ের মুখ দেখে চিনতে পারি।’ কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন তানভির। রাত ১১টার দিকে গাড়ি না পেয়ে কাঁধে করে লাশ বাড়িতে নিয়ে আসেন পরিবারের সদস্যরা। সেখানে প্রথম জানাজা শেষে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। ৬ আগস্ট সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে দ্বিতীয় জানাজা শেষে চিরশান্তির ঘুমে শায়িত করা হয় জিহাদকে। জিহাদের পরিবার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে। জিহাদের শোকার্ত মা বলেন, ‘আমি চাই, যারা আমার ছেলেকে মেরেছে, তাদের ফাঁসি হোক। আমি বিচার দেখে যেতে চাই।
’সূত্র: বাসস
এনএইচ/