রবিবার, ০৯ মার্চ ২০২৫ ।। ২৪ ফাল্গুন ১৪৩১ ।। ৯ রমজান ১৪৪৬


বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলার ২০ মিনিটের মধ্যে শহীদ হন হাফেজ মানিক

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

২০২৪-এর ৯ জুলাই সহিসংতার মাঝে পড়েন মাদ্রাসা শিক্ষক হাফেজ মাসুদুর রহমান মানিক (৪১) । তখন ঢাকায় ঝামেলা হচ্ছে বলে মোবাইল ফোনে বাবাকে গোলাগুলির শব্দ শোনান। এ অবস্থায় শেষবারের মতো বাবার কাছে দোয়া চান এবং বাবাকে সাবধানে থাকতে বলেন। এর ২০ মিনিট পরই খবর আসে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন মানিক।

মানিকের বৃদ্ধ বাবার চোখে-মুখে এখন বিষাদের ছাপ। তিন মেয়েকে নিয়ে অসহায় অবস্থায় স্ত্রী তাসনিম আক্তার (৩০) আশ্রয় নিয়েছেন শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে।

জানা যায়, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন মানিক। রাজধানীর বাড্ডায় মাদরাসাতুর রহমান আল ইসলামিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন তিনি। পরিবার নিয়ে থাকতেন বাড্ডার বাগানবাড়ী এলাকায়। ১৯ জুলাই দুপুরে নামাজ শেষে বের হন তিনি। হাতিরঝিল গুধারাঘাট এলাকা থেকে বের হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি মিছিলে যোগ দেন। সে মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন হাফেজ মাসুদুর রহমান মানিক। পরদিন ২০ জুলাই তাকে দাফন করা হয় গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার বরুড়া পৌর এলাকার অর্জুনতলা গ্রামে।

শহীদ মানিকের পিতা মাওলানা মো. অলিউল্লাহ (৭৫) বলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী বৃদ্ধ হয়ে গেছি। আমার একমাত্র ছেলে মানিকের তিন মেয়ে। কোনো ছেলে নাই। মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে মাহমুদা রহমান (১৪) কুমিল্লায় আয়েশা সিদ্দিকা মহিলা মাদ্রাসায় জালালাইন কিতাবে পড়ে। মেঝ মেয়ে মাহবুবা রহমান (১১) বরুড়া দারুল উলম মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে এবং ছোট মেয়ে মাইমুনা রহমান (০৯) ঢাকায় তার ফুফুর বাসায় থেকে একটি মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে।

মো. অলিউল্লাহ আরও বলেন, সংসারে সব দায়িত্ব ছিলে ছেলে মানিকের ওপর। আমরা সবাই তার উপার্জনে চলতাম। এখন এ দায়িত্ব বৃদ্ধ বয়সে আমার ওপর এসে পড়েছে।

তিনি বলেন, 'এ বয়সে আমি ক্যামনে কী করব। আমি বা কতদিন বাঁচব। নাতনিদের লেখাপড়া ও সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।' কিছুদিন আগে বরুড়া উপজেলা যুবদলের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

শহীদ মানিকের বৃদ্ধ মা আনোয়ারা বেগম বলেন, 'আমার একটা মাত্র পুত, আরেকটা থাকলে তার দিকে চেয়ে দিন কাটাতাম। মারার আগে আমার পুতে কইছিল একবারে গ্রামে চলে আসবে। গ্রামে এসে মাদ্রাসা দিবে। মেয়েদের মাওলানা বানাবে। পুত তো একবারেই চলে আইছে। আইসা বাশ ঝাঁড়ের নিচে (কবরে) শুয়ে আছে। পুতরে মাইরা আমার তিনটা নাতিরে এতিম কইরা দিল। আল্লাহ তাদের বিচার করব।'

শহীদ মানিকের স্ত্রী তাসনিম আক্তার বলেন, আমি তিন মেয়ে নিয়ে ঢাকায় থাকতাম। ১৫ জুলাই বিকালে স্বামী গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে আছে  খবর পেয়ে বড় মেয়েকে নিয়ে মেরুল বাড্ডায় এইমস হাসপাতালে যাই। সেখানে গিয়ে স্বামীকে মৃত দেখতে পাই। তখন একটি 
ভ্যানগাড়িতে করে লাশ মাদ্রাসায় নিয়ে আসি। পরে কুমিল্লা থেকে স্বজনরা গেলে মাদ্রাসায় জানাজা শেষে কুমিল্লায় আনি।

তিনি বলেন, ওরা গুলি করে সহজেই আমার স্বামীকে মেরে ফেলেছে। কিন্তু আমার স্বামী না থাকায় কতগুলো মানুষ পথে বসার মত অবস্থা হয়েছে। তিন মেয়ে ও শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে অনিশ্চিয়তার মাঝে দিন কাটাচ্ছি।

তিনি বলেন, আমি স্বামীর হত্যার বিচার চাই, পাশাপাশি আমার এতিম তিন মেয়ের লেখাপড়ার জন্য সরকারের সহযোহিতা চাই। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা বনশ্রী শাখা থেকে এক লাখ টাকা সহযোগিতা করেছিল। সে টাকা দিয়ে তিন মেয়েকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়েছি।

প্রতিবেশী মিলন, শাহ আলম, শফিকসহ অনেকে জানান,  মাওলানা অলিউল্লাহর একমাত্র ছেলে হাফেজ মানিক। মানিকের চার বোনের বিয়ে হয়েছে। মানিক মা-বাবাসহ সবার দেখাশোনা করতেন। তিনি মারা যাওয়ায় পুরো পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়েছে।
তারা বলেন, আমরা এলাকবাসীও মর্মাহত। আমাদের দাবি তার পরিবারটি যাতে চলতে পারে, তার অসহায় স্ত্রী ও  মেয়েদের কথা চিন্তা করে  সরকারি-বেরকারি প্রতিষ্ঠান যেন তাদের পাশে দাঁড়ায়, তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে।

বরুড়া উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক ও সাবেক পৌর মেয়র জসিম উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বরুড়া উপজেলায় চারজন শহীদ হয়েছেন। এর মধ্যে তিনজন তালিকাভূক্ত হয়েছেন।

তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা আমাদের সাবেক এমপি জাকারিয়া তাহের সমুন আহত ও নিহতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমরা যুবদলও তার নির্দেশে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমরা এ অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়াতে সরকারসহ বরুড়ার সকল বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানাই।

বরুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নু-এমং মারমা মং বাসসকে বলেন, এ উপজেলা চারজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে আমাদের যাচাই-বাছাই কমিটি ওই সময় তিনজন পেয়েছিল। তাদের তালিকা হয়েছে। বাদপড়া একজনকে আমরা আবেদন করতে বলেছি। আর বাকি তিন জনের পরিবারের খোঁজ-খবর রাখা হচ্ছে। কোনো সহযোগিতা এলে আমরা তাদের জন্য ব্যবস্থা করব। আর শহীদ হাফেজ মানিকের তিন মেয়ের লেখাপড়ার বিষয়ে আমাদের জানালে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা হবে। সূত্র: বাসস

হাআমা/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ