সোমবার, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫ ।। ১৩ মাঘ ১৪৩১ ।। ২৭ রজব ১৪৪৬


ফাজায়েলে আমালে শিরকের অভিযোগ : বিভ্রান্তির নিরসন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুফতি লুৎফুর রহমান ফরায়েজী

শাইখুল হাদিস আল্লামা শায়েখ জাকারিয়া রহ. এর লিখা “ফাযায়েলে আমাল” কিতাবটিতে তিনি ফাযায়েল সম্পর্কিত বেশ কিছু হাদিস বিভিন্ন হাদীসের কিতাব থেকে একত্র করেছেন। সেই সাথে বুযুর্গানে দীনের জীবনে ঘটে যাওয়া ঈমান উদ্দীপক কিছু ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন।
ঘটনা মূলত ঘটনাই। এর দ্বারা কোন বিধান সাব্যস্ত হয়না। আর বুযুর্গানে দীন থেকে ঘটিত আশ্চর্য ঘটনাবলী কোন শরয়ী দলিল নয়, কিন্তু ঈমান উদ্দীপক। যার মাধ্যমে আমলের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এগুলোতে অযথা শিরক খোঁজাটা বোকামীর শামিল। সেই সাথে শিরকের অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক। কারণ শিরক শব্দের আভিধানিক অর্থ হল শরিক করা, কাউকে একিভূত করা, অংশিদার করা। আর পরিভাষায় শিরক বলা হয়- “আল্লাহ তায়ালার সত্ত্বা বা তার গুণাবলীর সমতূল্য কাউকে সাব্যস্ত করার নাম”।


যারা বলে, বুযুর্গানে দীনের থেকে ঘটা আশ্চর্য ঘটনাগুলো শিরক, ওরা মূলত শিরকের সংজ্ঞাই জানে না। আশ্চর্য ঘটনাবলী বা বুযুর্গানে দীনের কারামাত বুযুর্গানে দীনের নিজের ইচ্ছাধীন নয়। বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। যদি কেউ মনে করে যে, কারামাত বা আশ্চর্য ঘটনাবলীর ঘটানোর মূল ক্ষমতা বুযুর্গের তাহলে এটা শিরক হবে, এতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু একথাতো ফাযায়েলে আমালের কোথাও লিপিবদ্ধ নাই যে, কারামাতগুলো ঘটানোর ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট বুযুর্গের। তাহলে এসব ঘটনা শিরক হল কিভাবে?


স্বাভাবিক রীতির উল্টো কাজ প্রকাশ করার ক্ষমতা আল্লাহ তায়া’লার রয়েছে, এটা আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এটাই আমাদের ঈমান। আল্লাহ তায়ালা যেমন বাতাসের উপর ভর করে হযরত সুলাইমান আ. কে গোটা পৃথিবী ভ্রমণ করার সুযোগ দিয়েছেন, তেমনি নবী না হলেও হযরত বিবি মরিয়মকে স্বামী সঙ্গ ছাড়াই তার পেটে সন্তান দিয়েছেন। ঈসা আ. এর হাতে মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতা দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালাই। সাপকে লাঠিতে পরিণত করেছেন মুসা আ. এর হাতে একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই। সেই আল্লাহ তায়ালাই হযরত ওমর রা. এর সামনে সুদূরে থাকা জিহাদরত মুজাহিদ বাহিনীর অবস্থা পরিস্কার করে দিলেন, ফলে তিনি মদিনার মসজিদে জুমআর খুতবাদানকালেও যুদ্ধরত মুজাহিদদের সতর্ক করে বললেন- অর্থাৎ  হে সারিয়া! পাহাড়! এই কথা শুনে সুদূরে যুদ্ধরত মুজাহিদরা পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে সেই যুদ্ধে বিজয় লাভ করে (কানযুল উম্মাল ফি সুনানিল আক্বওয়াল ওয়াল আফআল, হাদিস নং-৩৫৭৮৮, ৩৫৭৮৯)


তেমনি বুযুর্গানে দীন থেকে আল্লাহ তায়ালা নিজেই আশ্চর্যজনক ঘটনা শিক্ষা দেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে প্রকাশ করেন। যেমন নবী পাগল কোন বুযুর্গ মদীনায় গিয়ে নবীর রওজায় হাত বাড়িয়ে মুসাফাহা করেছেন। ঘুমের মাঝে নবিজি সা. এর দেয়া রুটি খেতে খেতে ঘুম থেকে জেগে হাতে অর্ধেক রুটি পেয়েছেন কোন কোন নবির আশেকিন। এই সকল ঘটনা স্বাভাবিক রীতি বিরুদ্ধ। যা আল্লাহ তায়ালা নিজ কুদরাতে প্রকাশ করেছেন। এতে সংশ্লিষ্ট বুযুর্গের কোন হাত নেই। এসব বিষয়কে শিরক বলাটা দীন সম্পর্কে আর শিরকের সংজ্ঞা সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক।


নবিদের মুজিজা, আর বুযুর্গদের কারামাত আল্লাহ তায়ালার কুদরত। তিনি ইচ্ছে করলেই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেন। যেটা থেকে যা হওয়া সম্ভব নয়, তা থেকে তা করে দেখানোর ক্ষমতা আল্লাহর আছে, এটা আমাদের ঈমান।
গায়রে মুকাল্লিদরা কি আল্লাহ তায়ালা অসম্ভবকে সম্ভব করার ক্ষমতা রাখেন এই বিশ্বাস আল্লাহর প্রতি রাখেনা? ওরা কি আল্লাহ তায়ালাকে ওদের মতই দুর্বল আর কমজোর মনে করে?  না হলে বুযুর্গানে দীন থেকে প্রকাশিত আশ্চর্য ঘটনা সম্বলিত কারামাতকে অস্বীকার করে কেন?


আশ্চর্য ঘটনা বর্ণনা করে মানুষের মাঝে ঈমান উদ্দীপ্ত করার প্রতি রাসূল সা. নিজেই উদ্ভুদ্ধ করেছেন। হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রা. থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন যে, আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও পৌঁছে দাও। আর বনি ইসরাঈলের বিষয় বর্ণনা কর, কোন সমস্যা নাই। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৩২৭৪, সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং-৬২৫৬, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৩৬৬৪, সুনানে নাসায়ি, হাদিস নং-৫৮৪৮)


বনি ইসরাঈল হল হযরত মুসা আ. ও হযরত ঈসা আ. এর উম্মত বা জাতি। যদি হযরত মুসা ও ঈসা আ. এর জাতির ঘটনা বর্ণনা করাতে কোন সমস্যা না থাকে, তাহলে শ্রেষ্ঠ, সর্বোত্তম উম্মত, উম্মতে মুহাম্মদীর বুযুর্গানে দীনের ঈমানদীপ্ত ঘটনা বর্ণনা করা শিরক বা দোষণীয় হয় কি করে?
কিছু মানুষ বর্তমানে কেবল মুসলমানদের মাঝে ধর্মীয় বিভক্তি আর কোন্দল সৃষ্টি করার জন্যই ফাজায়েলের বিষয়ে নাক গলানো শুরু করেছে। আমলের দিকে ছুটা মানুষের মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে আমল থেকে বিরত রাখার হীন চক্রান্তে লিপ্ত এই গ্রুপটি। নতুবা যেই ফাযায়েলে আমাল যেই এলাকায় ঢুকছে সেই এলাকার দাড়িহীন মানুষ দাড়ি রাখছে, বেনামাজি নামাজি হচ্ছে, সুদখোর সুদ ছাড়ছে, শরিয়ত অমান্যকারী শরিয়তের পাবন্দ হবার চেষ্টা করছে, সেই ঈমান জিন্দাকারী কিতাবের পিছেনে লেগে একে কলুষিত করার ষড়যন্ত্র করার মানে কি? বেনামাজিকে নামাজি বানানোর কোন ফিকির ওদের নাই, নামাজির মনে ওয়াসওয়াসা প্রবিষ্ট করানোই ওদের কাজ।ওরা আমলকারীদের মনে ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি করে দিচ্ছে সহীহ হওয়া না হওয়ার।


এই ওয়াসওয়া থেকেই আল্লাহ তায়ালা আশ্রয় চাইতে সূরা নাসে শিক্ষা দিয়েছেন যে, অর্থাৎ যারা মানুষের মনে ওয়াসওয়াসা তথা সন্দেহ সৃষ্টি করে দেয় মানুষ ও জিন জাতির মধ্য থেকে তাদের থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। (সূরা নাস-৫-৬)


ওরা আমলের মাঝে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। কুরআনের মাঝে ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি করে, হাদিসের মাঝে ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি করে। নামাযের মাঝে ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি করে। ওরাই কুরআনে বর্ণিত সেই ওয়াসওয়াসা সৃষ্টিকারী দল। যাদের থেকে আশ্রয় চাওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা।


তাই ওদের প্রপাগা-ায় বিভ্রান্ত হবেন না। আল্লাহ তায়ালা আমাদের আহলে হাদীসের এই নব্য ফিতনা থেকে জাতিকে হিফাযত করুন।

লেখক: পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

হুআ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ