বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫ ।। ১১ চৈত্র ১৪৩১ ।। ২৬ রমজান ১৪৪৬


ফকিহুল মিল্লাত হযরতওয়ালা মুফতি আব্দুর রহমান রাহিমাহুল্লাহ -এর  গুরুত্বপূর্ণ কিছু মালফুযাত

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

[হযরত ফকীহুল মিল্লাত রহ. এর একজন খলীফা ছিলেন হযরত মাও. আবু সাঈদ এখলাশপুরী রহ.। যিনি নোয়াখালীর জামিয়া ইসলামিয়া মাইজদী -এর নায়েবে মুহতামিম ছিলেন। হযরত ফকীহুল মিল্লাত রহ. এর জন্য ফিদা ছিলেন। নিজ শায়খের প্রতি অগাধ আস্থা থেকেই হযরতের বয়ানকে গুরুত্ব দিতেন এবং যতেœর সাথে সেগুলোকে লিখে রাখতেন আপন ডায়রীতে। কখনো কখনো তারিখ এবং স্থানসহ লিখে রেখেছেন। আবার সব ডায়রীর বিক্ষিপ্ত মালফুযাতকে একটি ডায়রীতে সংখ্যা দিয়ে ধারাবাহিকভাবে জমা করেছেন। হযরতের মৃত্যুর পর তাঁর কয়েকটি ডায়রী মুফতী নূর হুসাইন হাফিজাহুল্লাহ মারফতে হস্তগত হয়েছে। অনেক মালফুয নিজেও হযরত ওয়ালা রহ. থেকে শুনেছি।  সেখান থেকে অতি মূল্যবান কিছু মালফুয পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হল।]
   
১. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, সালাম দ্বারা ঘরের মধ্যে বরকত অবতীর্ণ হয়, পরিবারের সদস্যদের মাঝে মহব্বত ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। অন্যথায় শয়তান আপসে বিবাদ সৃষ্টি করতে থাকে। 

২. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, মাআরিফুল কুরআন কিতাবে মুফতী শফী রহ. লিখেন, ইলম -এর কাজে লিপ্ত থাকা সুন্নাতে গায়রে মুকাররারা থেকে উত্তম। আর সুন্নতে মুকাররারা অর্থাৎ আওয়াবীন, চাশতের নামাজ ইত্যাদি ইলমের কাজে মশগুল থাকা থেকে উত্তম। (১-১১-১৯৯৮ইং স্থান: জামিয়া ইসলামিয়া মাইজদী)

৩. হযরতওয়ালা রহ. বলেন হাকীমুল উম্মত শাহ আশরাফ আলী থানভী রহ. বলতেন, বর্তমানে আল্লাহওয়ালা হওয়ার জন্য সেই পরিমাণ মুজাহাদার প্রয়োজন নেই যে পরিমাণ পূর্বযুগে প্রয়োজন ছিল। এই যুগে যদি কোন ব্যক্তি হিম্মত করে তিনটি কাজে গুরুত্ব দেয় আল্লাহ চাহে তো সে যুগের অলীআল্লাহ হয়ে যাবে। 
‍এক. اجتناب عن معصیۃ اللہ অর্থাৎ আল্লাহর অবাধ্যতা পরিহার করা। দুই. دوام ذکر اللہ অর্থাৎ সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করা। তিন. صحبة اهل الله অর্থাৎ আল্লাহওয়ালাদের সুহবত অর্জন করা। 
অতঃপর হযরতওয়ালা রহ. বলেন, আল্লাহর নাফরমানী তিন প্রকার: ১. حیوانی معصیت অথাৎ বান্দার হক নষ্ট করা। ২. شھوتی معصیت অর্থাৎ কু-দৃষ্টি,  ব্যাবিচার ইত্যাদি। ৩. نفسانی معصیت অর্থাৎ গীবত, অহংকার ও হিংসা ইত্যাদি। আর আল্লাহ তায়ালার জিকির তিন প্রকার: ১. জিকরে যবানী তথা মৌখিক জিকির। ২. যিকরে কলবী তথা আন্তরিক জিকির ৩. যিকরে আমলী তথা আমলী জিকির অর্থাৎ খাওয়া, পান করা, ঘুমানো, ঘুম থেকে উঠা, চলাফেরা ইত্যাদি সুন্নত অনুযায়ী করা। তিনি আরো বলেন, আল্লাহওয়ালাদের সুহবত পূর্বের দুই প্রকারের জন্য সহায়ক । আর উক্ত তিনটি কাজ হল বাতেনী। এগুলোর সাথে সাথে আরো চারটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক. লেনদেন সঠিক হওয়া. দুই. আচার-ব্যবহার সঠিক হওয়া তিন. তেলাওয়াত শুদ্ধ হওয়া। চার. সুন্নতের অনুসরণ করা। (২৯-১১-২০০০ইং)

৪. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, সালেক তথা আল্লাহর পথের যাত্রীদের জন্য উচিত নফল ইবাদতের ইহতিমাম করা। যদি কখনো কোন নফল আমল ছুটে যায় তাহলে তা কাযা করে নিবে। যদিও নফস বলবে  যে, নফলের তো কাযা করতে হয় না। কথা সঠিক, তবে এই কাযা দ্বারা তো উদ্দেশ্য হচ্ছে নফসকে সাজা দেওয়া। (অর্থাৎ এতে নফস সামান্য অজুহাতে পরবর্তীতে নকল আমল ছেড়ে দেওয়ার সাহস করবে না।)

৫. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, পেসাব করার পর মানুষের সামনে পেসাব শুকানোর জন্য ঢিলা নিয়ে পায়চারি করা শিষ্টাচার পরিপন্থী ।

৬. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, হযরত আবরারুল হক হারদূয়ী রহ. বলেন, চারটি কাজ সকল গুনাহের মূল। দুটি যাহেরী তথা বাহ্যিক। ১. بدگمانى (কু-ধারণা) ২. بد نظری (কু-দৃষ্টি)  আর দুটি বাতেনী তথা আন্তরীক। ১. حسد وبغض (হিংসা-বিদ্বেষ) ২. کبر وعجب (অহংকার ও অহমিকা)

৭. হযরতওয়ালা রহ. উলামাদের জন্য নিজের নেযামুল আওকাত তৈরীর গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে বলেন, হযরত থানভী রহ. বলেছেন, যে ব্যক্তি নিজের নেযামুল আওকাত বানায়নি এবং নিজের সময়ের হিসাব রাখেনা যে, কোথায় সময় খরচ হচ্ছে; সে মূলত মানুষই নয়। 

৮. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, এক ব্যক্তি হযরত হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী রহ. এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে মুসিবতের শেকায়ত করল এবং দুয়া চাইল। তো হযরত তার জন্য দুয়া করলেন। কিন্তু পরে বললেন, এই লোকটি عارف وسالک নয়। কারণ আরেফের শান হবে تفویض অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যে হালতে রাখে তাতে সন্তুষ্ট থাকা। আর تصوف এর সারকথায় হচ্ছে- تفویض। বিবি-বাচ্চাদের পক্ষ থেকে অসন্তুষ্টি হবে, প্রতিবেশীর পক্ষ থেকে জুলুম-নির্যাতন হবে, এভাবে যত হালাতই তার আসবে তাতে সবর করবে এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে পরীক্ষা বলে জ্ঞান করবে।  ہرچہ آید ترا أزظلمات وغم * آں زبےباکی وگستاخی ست ہم ۔ 

৯. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, হযরত হাফিজ্জী হুযুর রহ. বলতেন, সিলসিলার মধ্যে আমি ছোট এবং অযোগ্য। কিন্তু আমার উপরের সকলেই কামিল-মুকাম্মাল। আর সিলসিলার মধ্যে ফুয়ূযাত উপরওয়ালাদের থেকে আসে। তিনি আরো বলতেন, সুন্নাতের অনুসারী হও। কারণ যে যত বেশী সুন্নাতের পাবন্দ হবে সে ততোই কামেল হতে পারবে। বরং ফুয়ূযাতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে। (৯-৯-১৯৯৮ইং)

১০. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, রমযান শরীফে বিশেষভাবে একাগ্রতা/নির্জনতা অবলম্বন করুন। আর  একাগ্রতার জন্য সবচে’ উত্তম স্থান হচ্ছে- মক্কা ও মদিনা। হযরত থানভী রহ. বলেন, দুনিয়া ওয়ালাগণ নিজে গুমরাহ হওয়া সত্ত্বেও অন্যের ফিকিরে থাকে। মুহতামিম মুদাররিসদের বেতনের  জন্য পেরেশান। মুআল্লিম ছাত্রদের সংশোধনের জন্য চিন্তায় বিভোর। এভাবে প্রত্যেক লোক বিবি বাচ্চাদের জীবন-জীবিকার চিন্তায় জীবন শেষ করে দিচ্ছে। বিবি-বাচ্চাদের হক তো অতটুকু যা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- ومتِّعوھنّ علی الموسع قدرہ وعلی المقتر قدرہ  অর্থাৎ ধনি ব্যক্তির উপর তার সামর্থ অনুযায়ী আর দরিদ্রের উপর তার সামর্থ অনুযায়ী। (সূরা বাকারা-২৩৬) সুতরাং আমাদেরকে নিজের উন্নতির ফিকিরে নির্জনতা অবলম্বন করতে হবে। হাটহাজারী মাদরাসার মুফতী আহমাদুল হক রহ. এর যখন নিজের সংশোধনের ফিকির অনুভব হল, তো তিনি মাদরাসা থেকে ছুটি নিয়ে নিয়েছেন এবং বিবিকে বলে দিয়েছেন, আমি তো চলে যাচ্ছি, তুমি থাকতে চাইলে থাকতে পার আর না হয় নিজের উপর তালাক অর্পণ করে চলেও যেতে পার। এই বলে তিনি শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. এর সান্নিদ্ধে চলে গেলেন এবং সেখানে এক বছর ছিলেন। 

১১. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, নির্জনতা অলম্বন কর। দুনিয়ার আশেক হয়ো না বরং দুনিয়ার মাশুক হও। আর দুনিয়ার মাশুক হওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলার আশেক হওয়া জরুরী। যদি তুমি আল্লাহ তাআলার আশেক হয়ে যাও এবং দুনিয়া বিমূখ হয়ে যাও তো দুনিয়া তোমার আশেক হয়ে যাবে। 

১২. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, হযরতওয়ালা হারদূয়ী রহ. আমাকে একটি মুরাকাবা দিয়েছেন। যে, اللہ حاکم بھی ہے اورحکیم بھی ہے ۔ حاکم ہونے کی حیثیت سے جوبھی حکم کرنا چاھتاہے کرسکتاہے ۔ اور حکیم ہونے کی حیثیت سے اسکے ہرہر حکم میں کچھ نہ کچھ حکمت ہوتاہے 
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা হাকিম (বিচারক)। এবং তিনি হাকীম (প্রজ্ঞাময়)। কাজেই হাকিম হওয়ার দৃষ্টিতে তিনি যে বিচারই করতে চান করতে পারেন। আর হাকীম হওয়ার দৃষ্টিতে তার প্রতিটি বিচার এর মধ্য কোন না কোন প্রজ্ঞা এবং রহস্য অবশ্যই আছে। ) মানুষের জীবনে দৈনিক অনেক নামোয়াফেক ঘটনা ঘটে থাকে আর এই মুরাকাবা তার সকল নামোয়াফেক ঘটনাকে তার মোয়াফেক বানিয়ে দিবে এবং দুঃশ্চিন্তা দূর করে দিবে। 

১৩. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, সালেকদের জন্য সর্বদা ওযুর সাথে থাকা উচিত। হযরত মাও. মসিহুল্লাহ খান রহ. এক রাত্রে জরুরত সারার জন্য উঠলেন এবং ওযু ছাড়া শুয়ে পড়ার ইচ্ছা করলেন। কিন্তু সাথে সাথেই এই খেয়াল আসল যে, যদি আমি ওযু ছাড়া শুয়ে যায় আর এ অবস্থায় আমার মৃত্যু এসে যায় তো আমার এই  মৃত্যু সুন্নাত পরিপন্থি হবে। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা পেসাব করার পর ওযু করতেন। কোন কোন বুযুর্গের জীবনীতে লেখা আছে -এক রাত ওযুর সাথে ঘুমানোর জন্য তাকে চৌদ্দ বার ওযু করতে হয়েছে। আর প্রত্যেক বারই আনন্দের সাথে ওযু করতেন যাতে তার ঘুমানো সুন্নাতের সাথে হয়।

১৪. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, আমি আমার শায়খ হযরতওয়ালা হারদূয়ী রহ.কে বললাম যে, হযরত আমার মধ্যে একটা রোগ আছেÑ আমার কাছে যদি কোন জেনারেল শিক্ষিত লোক বাইআতের আবেদন করে তো অন্তর তার প্রতি আকৃষ্ট হয় না। আর যদি কোন আলেম আসে তো অন্তর খুশি হয়। এই রোগের চিকিৎসা কি? হযরতওয়ালা রহ. জবাবে বললেন, এটা রোগ নয়। আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দুই প্রকারের ইলম দিয়েছেন। একটির বর্ণনা দিয়েছেনÑ یتلوعلیھم آیاته  দ্বারা। আর দ্বিতীয়টির বর্ণনা দিয়েছেন- ویعلمھم الکتاب والحکمة দ্বারা। আর এই দ্বিতীয় প্রকারের ইলমের হকদার শুধু উলামায়ে কেরামই। 

১৫. হযরতওয়ালা রহ. বলেন,  হযরত হাসান বসরী রহ. যিনি একশত বিশ জন সাহাবীর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। তিনি একটি গোলাম ক্রয় করেছেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে গোলাম তোমার নাম কি? গোলাম জবাব দিল, গোলামদের কোন নির্দিষ্ট নাম থাকে না।  বরং মুনিব যে নামে তাকে ডাকে তাই তার নাম হয়। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি খাও? উত্তর দিল, মনিব যা খাওয়ায় তাই খাই। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেমন পোষাক পরিধান করতে ভালবাস ? উত্তর দিল, মনিব আমাকে যে ধরণের পোষাক দেয় তাই পরিধান করি। গোলামের এমন উত্তর শুনে হাসান বসরী রহ. কেঁদে ফেললেন। অবস্থা দেখে গোলাম জিজ্ঞেস করল, আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি উত্তর দিলেন, এত দিন আমি গাফলতের ঘুমে বিভোর ছিলাম, আজ তুমি আমাকে সজাগ করে দিয়েছ। অর্থাৎ তোমার কথায় আমি বাস্তব আবদিয়্যাত এর শিক্ষা লাভ করেছি। 

১৬. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, আমাদের মধ্য হতে সকলেই ময়দানে কাজ করা উচিত। যেমন আমরা কেউ পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করে দরস-তাদরীসের কাজ করি না। এভাবে পূর্ণ যোগ্যতা না হওয়া সত্ত্বেও ইসলাহী কাজ শুরু করা উচিত। হয়ত কাজ করতে করতে একদিন আল্লাহ তাআলার পক্ষ্য থেকে যোগ্যতা দিয়ে দেওয়া হবে। যেমন এক ডাকাতের সর্দারের ঘটনা প্রসিদ্ধ আছে- সে যৌবনে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত ডাকাতি করেছে। যখন বৃদ্ধ হল, দূর্বল হয়ে গেল তখন এক বসে আল্লাহ আল্লাহ করতে আরম্ভ করল। কিছু দিন পর মানুষেরা তাকে বুযুর্গ মনে করে তার কাছে আসতে আরম্ভ করল। আর সেও পীরের মত যিকির-আযকারের ওযীফা দিতে আরম্ভ করল। মুরিদেরা নিজের এখলাসের বদৌলতে আমল করে উন্নতি হতে হতে ওলীর স্তরে পৌঁছতে সক্ষম হয়ে গেছে। তখন মুরিদেরা একদিন মুরাকাবা মাধ্যমে নিজেদের স্তর দেখতে চাইল। পরে সকলে সিদ্ধান্ত নিল নিজেদের পীর সাহেবের স্তর দেখবে। কিন্তু মুরাকাবা করে কিছুই তারা দেখছিল না। তারা ভাল ধারণাবশত ভাবল হয়ত আমাদের শায়খের মর্যাদা এতো উপরে যেখান পর্যন্ত আমরা পৌঁছতে পারব না তাই আমরা দেখছিনা। একদিন সাহস করে তার নিজেদেও শায়খকে সব খুলে বলল এবং এও জানালো যে, আমরা আপনার মাকাম দেখতে পাচ্ছিলাম না। ঘটনা শুনে ঐ পীরসাজা ডাকাতের সর্দার কেঁদে ফেলল এবং বাধ্য হয়ে তাদেরকে নিজের আসল পরিচয় বলল। তার মুরীদরা ছিল নেককার ও ভালো। তারা পীরের উপর ক্ষুব্দ হয়নি বরং ভাবল, ডাকাত হোক আর যাই হোক এই লোকের উছিলায় আমরা আল্লাহর সন্দান পেয়েছে, তাই আমরাও আল্লাহর কাছে তাঁর জন্য দোয়া করা আমাদের কর্তব্য। তারা এখলাস ও রোনাযারীর মাধ্যমে দোয়া শুরু করল। আল্লাহ তাআলা তাদের দোয়া কবুল করলেন এবং তাদের পীরকেও ওয়ালায়াতের মাকাম দান করলেন।  

১৭. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, এক চিঠির জবাবে শায়খুল হাদিস যাকারিয়া রহ. বলেন,
تمام سنتوں کو خواہ مؤکدہ ہو خواہ زائدہ ہو دل سے محبت رکھنا لیکن بعض سنتوں پر عمل نہ کرنا جیسے کم کھانا، کم سونا اورچھٹائی پر سونا ۔
অর্থাৎ সকল প্রকার সুন্নাতকে চাই মুআক্কাদা হোক বা যায়েদা হোক আন্তরীকভাবে মুহাব্বত করবে তবে, কিছু সুন্নাতের উপর আমল করবে না। যেমন, কম খাওয়া, কম ঘুমানো এবং চাটাইয়ের উপর শোয়া। 

১৮. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, স্কুল-কলেজ এবং বার্সিটির ছাত্রদেরকে সার্টিপিকেট দেওয়া হয় যাকে আরবীতে الشھادۃ বলে আর দেওবন্দী ধারার ফারেগ ছাত্রদেরকেও একটি সার্টিপিকেট দেওয়া হয় যাকে আরবীতে বলে السند । শাহাদাহ এবং সনদের মাঝে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। এদুই প্রকারের সার্টিপিকেট কখনো এক হতে পারে না। 
چہ نسبت خاک را باعالم پاک * کجا عیسی کجا دجال ناپاک ۔
শাহাদাহ তো হল- কি পড়েছে তার প্রমাণ। আর সনদ হচ্ছেÑ কার কাছে পড়েছে তার প্রমাণ।  

১৯. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, দাওয়াতুল হক কি? সকল জাহেরী ও বাতেনী আমলকে প্রত্যেক শাখায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত অনুযায়ী করে দেওয়া।  ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জিবনকে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত মত করে নেওয়া। 

২০. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, যখন কেউ নিজের যাহেরকে ঠিক করে তো আল্লাহ তাআলা তার বাতেনকেও ঠিক করে দেন। যেমন মূসা আ. এর যুগে যাদুকরেরা যখন মূসা আ. এর যাহেরী লেবাস অবলম্বন করেছে তো আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তরকে ঈমানের নূর দ্বারা পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে ফেরআউনের কিন্তু ঈমান নসীব হয়নি। 

২১. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, হযরত মাও. শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রহ. বলেন, বর্তমানে মাদারেসে দ্বীনিয়ার মধ্যে যে ফেৎনার তুফান বয়ে যাচ্ছে তা থেকে পরিত্রাণের ব্যবস্থা হল প্রতিটি মাদরাসায় যিকিরের হালকা কায়েম করা। 
(এ বিষয়ে শায়খুল হাদিস যাকারিয়্যাহ রহ. এর সাহেবজাদা  মাও. ত্বলহা রহ. ছোট্ট একটি পুস্তিকাও রচনা করেছেন مدارس میں مجالس ذکر کے قیام کی ضرورت وأہمیت   নামে। যার মধ্যে উক্ত বিষয়ে শায়খুল হাদিস রহ., মুফতী আযম শফী রহ. ও মাও. ইউসুফ বিন্নুরী রহ. তিন জন আকাবিরের ঐক্যমত বর্ণিত হয়েছে। মীযান)

২২. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, কোন মানুষই মুক্তমনা নয় বরং প্রত্যেকেই কারো না কারো দ্বারা প্রভাবিত যাকে সে অনুসরণ করছে। যদি কেউ বড়কে মান্য না করে তো সে ছোটকে মান্য করতে হয়। যদি উস্তাদ ও শায়খের অনুসরণ না করে তো নফস ও শয়তানের অনুসরণ করতে হয়। এই নফস ও শয়তানের গোলামীর চেয়ে উস্তাদ ও শায়খের অনুসরণ নেহাত উত্তম হবে। 

২৩. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, লুঙ্গী ও পায়জামার ক্ষেত্রে সুন্নাত হচ্ছে নিসফে সাক (হাঁটু এবং গোড়ালীর মাঝখান)। ফাতহুল বারীতে হাদিস বর্ণিত আছে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ارفع إزارک إلی نصف الساق   অর্থ: তোমার কাপড় হাঁটু এবং গোড়ালীর মাঝখান পর্যন্ত উঠিয়ে নাও। (এটি একটি লম্বা হাদিসের অংশ যা আবুদাউদ শরীফেও আছে। وَارْفَعْ إِزَارَكَ إِلَى نِصْفِ السَّاقِ، فَإِنْ أَبَيْتَ فَإِلَى الْكَعْبَيْنِ، وَإِيَّاكَ وَإِسْبَالَ الْإِزَارِ  فَإِنَّهَا مِنَ الْمَخِيلَةِ ، وَإِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ الْمَخِيلَة অর্থ: তোমার কাপড় হাঁটু এবং গোড়ালীর মাঝখান পর্যন্ত উঠিয়ে নাও। যদি তুমি তা না কর তবে টাখনুর উপর পর্যন্ত নামিয়ে পরিধান করতে পারবে। আর অবশ্যই টাখনু ঢাকা পরিমান কাপড় ঝুলিয়ে পরিধান করবে না। কেননা এটি অহংকারের আলামত আর আল্লাহ অহংকারকে পছন্দ করেন না। হাদিস নং- ৪০৮৪) 

২৪. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, মানুষ কয়েক ভাগে বিভক্ত। ১. কাফের, যার মধ্যে শুধু অমঙ্গলই পাওয়া যায় এবং কোন মঙ্গল তার মধ্যে নেই। ২. নবীগণ, যাদের মধ্যে শুধু মঙ্গল আর মঙ্গলই থাকে এবং কোন অমঙ্গলই তাদের মধ্যে নেই। ৩. ফাসেক-ফাজির, যার মধ্যে মঙ্গল আছে তবে অমঙ্গলই তার মধ্যে বেশী। ৪. মুমিন, যার মধ্যে কিছু অমঙ্গলও আছে তবে মঙ্গলই বেশী। ৫. ওলী, যার মধ্যে অমঙ্গলের সংখ্যা একে বারেই কম এবং মঙ্গলের সংখ্যা খুব বেশী। বিশেষত বর্তমান যামানায় এমন কোন ওলী নেই যার মধ্যে কোন না কোন ত্রুটি বা দোষ নেই। কাজেই (ছোট-খাটো দু-একটি) দোষ-ত্রুটি দেখে বুযুর্গদের থেকে দূরে সরে যাওয়া উচিত নয়। 
 
২৫. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, ১. ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাতের ইহতিমাম করা। ২. আল্লাহর নাফরমানী ছেড়ে দেওয়া। ৩. সকল কাজে সুন্নাত তালাশ করে আমল করার চেষ্টা করা। ৪. বিভিন্ন সময় ও স্থানের দুয়াগুলো আদায় করা। ৫. বারো  তাসবীহ আদায় করা (সালেকের জন্য একটু জেহরীভাবে)। এ কয়েকটি বিষয়ই আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার জন্য যথেষ্ট। 

২৬. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, দাওরায়ে হাদিস পর্যন্ত পড়া মুসলমানদের একটি দলের উপর ফরজ। কিন্তু কুরআন কারীম তাসহীহ করা মুসলমানদের সকল ব্যক্তির উপর ফরজে আইন। এভাবে যাহের ও বাতেনের ইসলাহ করাও সকল মুসলমানের উপর ফরজ আইন। আর ইসলাহের জন্য কোন শায়খের অনুসরণ করা জরুরী। আল্লামা রুমী রহ. বলেন,   
نفس نتواں کشت الا ظلّ پیر ۔ دامن آں نفس کش را سخت گیر
خود بخود کامل نہ شد ملائے روم ۔ تاغلام شمس تبریزی نہ شد ۔
মুরীদ হওয়া দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মসংশোধন। বাইআত কোন আসল উদ্দেশ্য নয়। যদি কেউ বাইআত হল কিন্তু তার আত্মার ইসলাহ হলো না তো দুনিয়া আখিরাত উভয় ধ্বংশ হবে। আর যদি কোন পীরের হাতে বাইআত হয়নি কিন্তু আত্মার ইসলাহ করতে পেরেছে তো কামিয়াব। বাইআত হওয়া তো বরকতের জন্য। বাইআতের দ্বারা লাভ হল সিলসিলার মাশায়েখে কেরামের ফুয়ুয এবং তাদের রূহানী দোয়া লাভ করা যায়।

২৭. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, শায়খের সুহবত দ্বারা নিশ্চিত উপকার আছে। যখন আসহাবে কাহাফের কুকুর সুহবতের বরকতে কুরআনে আলোচিত হওয়ার মর্যদা লাভ করতে ফেরেছে তো মানুষ কেন সুহবত দ্বারা উপকৃত হবে না। 

২৮. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, সালেকের জন্য উচিত তাবীজ-তুমারের পেশা অবলম্বন যেন না করে। যদি মানুষের উপকার হয় তো নিজের মধ্যে عجب আত্মগরিমা সৃষ্টি হবে। এছাড়া থানভী রহ. তাবীজের বিনিময়কে হায়েজের রক্তের সাথে তুলনা করেছেন। 

২৯. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, হক্কানী ওলামায়ে কেরামের চারটি সিফাত : এক. التقوی بینه وبین اللہ  দুই. التواضع بینه وبین الناس তিন. الزھد بینه وبین الدنیا চার. المجاھدۃ بینه وبین النفس

৩০. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, দ্বীনের অনুসরণ করা না করার স্তর তিনটি: ১. عزیمت অর্থাৎ ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব সব ইহতিমামের সাথে আদায় করা। এটি হলো ওলামায়ে কেরামের স্তর। ২. رخصت অর্থাৎ মোটামুটিভাবে শুধু ফরজ-ওয়াজিবগুলো আদায় করা। এটি সাধারণ মুসলমানদের স্তর। ৩. ترک অর্থাৎ ফরজ-ওয়াজিবও ঠিকমত আদায় না করা। (এ স্তরে কোন মুসলমান থাকা উচিত নয়) । কিন্তু আফসোস! বর্তমানে আমরা উলামায়ে কিরামগণ নিজেদের আযীমতের স্তর থেকে জনসাধারণের রুখসতের স্তরে অবতরণ করে গেছি এবং তা দখল করে ফেলেছি। এদিকে জনসাধারণ যখন তাদের রুখসতের স্তর খালী পেল না তো  তারা তরকের স্তরে নেমে গিয়েছে এবং ফরজ-ওয়াজিবও ছেড়ে দিতে শুরু করেছে। যা কোন মুসলমানের জন্য উচিত ছিল না। 

৩১. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, সুহবতের মধ্যে কিছু ব্যাখ্যা আছে। সুহবত অর্থ বিশ্বাস ও মুহাব্বতের সাথে সুহবত তথা সর্বদা নজরে থাকাটাই কাম্য। আর নজরে থাকার তিন সুরত হতে পারে। ১. খেদমতে কিছু সময় থাকা। ২. চিঠি ইত্যাদির মাধ্যমে যোগাযোগ রাখা। ৩. কমপক্ষে শায়খের কিতাবসমূহে বা মালফুযাত অধ্যায়ন করা। আর এটি সর্বশেষ স্তর। 

৩২. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, আল্লাহওয়ালাদের সুহবতে আশ্চর্য তাচির (প্রভাব) আছে। খাজা বাকী বিল্লাহ রহ. বলেন, যদি কোন ব্যক্তি আমার সংশ্রবে বসে এবং আমার চুপ থাকা থেকে ফায়দা অর্জন করতে পারে না, সে আমার আলোচনা দ্বারা কি উপকৃত হবে। উদ্দেশ্য হল, শায়খের সুহবত শায়খ চুপ থাকলেও উপকারী। খাজা আযীযুল হাসান মাজযুব রহ. একথায় বলেছেন তার কবিতায়Ñ 
جو آگ کی ہے خاصیت وہ عشق کی ہے خاصیت * ایک خانہ بخانہ ہے ایک سینہ بسینہ ۔
অর্থ: আগুনের যে স্বভাব মারিফাতেরও সে প্রভাব * একটি ঘর থেকে ঘরে লাগে আর একটি অন্তর থেকে অন্তরে। 

৩৩. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, দ্বীনি মাদরাসা দুই প্রকার: এক. সরকারী মাদরাসা। দুই. দরকারী মাদরাসা (বেসরকারী মাদরাসা)। বেসরকারী মাদরাসা আবার দুই প্রকার: ১. কাসেম নানুতুবী রহ. এর মূলনীতির মাদরাসা। ২. এমন মাদরাসা যা উক্ত মূলনীতির উপর চলে না। বেসরকারী মাদরাসা আবার দুই প্রকার: ১. কওমী মাদরাসা। ২. ব্যক্তি কেন্দ্রিক মাদরাসা। এখন বুঝার ও স্মরণ রাখার বিষয় হল- কাসেম নানুতবীর মাদরাসা কি?  কাসেম নানুতুবীর মাদরাসা হল যা উসূলে হাস্তেগানার উপর প্রতিষ্ঠিত। আর উসূলে হাস্তেগানার সারকথা হল তিনটি বিষয়। এক. অন্তর কুরআন-হাদিসের সাথে লেগে থাকবে। দুই. দৃষ্টি কবর তথা আখীরাত মুখী হবে। তিন. পেট (খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা) আল্লাহর উপর হাওয়ালা করবে। 

৩৪. হযরত ওয়ালা রহ. বলেন, সরকারী মাদরাসায় শুধু শিক্ষা আছে। আর কাওমী মাদরাসা তথা দেওবন্দী ধারার মাদরাসায় শিক্ষার সাথে দিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এক সময় ছিল যে, কোন মাদরাসায় শিক্ষকের প্রয়োজন হলে কোন খানকায় গিয়ে তালাশ করত। আর বর্তমানে এটিও দেখা হয় না যে, শিক্ষক তাহাজ্জুদ-ইশরাকের ইহতেমাম করে কি না। তার কুরআন তেলাওয়াত শুদ্ধ আছে কিনা? যদি একজন মুআল্লিম এসব গুণে গুণাণি¦ত না হয় তাহলে তার কাছে ছাত্ররা কি শিখবে। এই কারণে বর্তমানে কওমী মাদরাসাগুলোতে শিক্ষা-দিক্ষার অবস্থা খুব সুচনীয়। হযরতওয়ালা হারদূয়ী রহ. বলেন, ہم قرآن مجید غلط نہیں پڑھتے تو صحیح بھی نہیں پڑھتے ہیں আমরা উলামা-তালাবারা কুরআন মাজীদ ভুল পড়িনা ঠিক তবে শুদ্ধও পড়ি না। হযরতওয়ালা ফকীহুল মিল্লাত রহ. বলেন, আমি দারুল উলূম দেওবন্দ পড়াকালীন মাদরাসা মসজিদের ইমাম ছিলাম। কেউ কোন দিন আমার তেলাওয়াতের উপর আপত্ত্বি করে নি। কিন্তু আমি হারদূয়ী হযরত রহ. এর সাথে এসলাহী তাআল্লুক করার পর কুরআন তাসহীহ করতে হয়েছে। 

৩৫. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, শায়খের পক্ষ থেকে সালেককে যে সকল ওযীফা দেওয়া হয় তা যদিও ফরয ওয়াজিব কিছইু নয়, তবে সেগুলোকে চিকিৎসা মনে করতে হবে। যদি সে চিকিৎসা গ্রহণ না করা হয় তাহলে সুস্থতা অর্জন হবে না। যেমন রুগী ছিল তেমন রুগীই থেকে যাবে কখনো তারাক্কী হবে না। 

৩৬. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, কোন শায়খ যদি কাউকে খেলাফত প্রদান করে তো এটা মনে করবে না যে, আমি বুযুর্গ হয়ে গেছি এই জন্য আমাকে খেলাফত দেওয়া হয়েছে। বরং খেলাফত দ্বারা মানুষের মাঝে আহকামে শরিয়তের দিকে এবং সুন্নাতের দিকে দাওয়াত দেওয়ার এক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যাকে খেলাফত দেওয়া হয় নাই হতে পারে সে খলীফার চেয়েও বেশী কামেল এবং সে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসাবাদ থেকে বেচে যাবে। আর খলিফা যদি নিজ দায়িত্ব আদায় না করে তো কখনো তার থেকে নেয়ামত চিনিয়ে নেওয়া হয়। আর যদি চিনিয়ে নেওয়া নাও হয় তবে কিয়ামত দিবসে তো অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে।

৩৭. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত পড়া এক দল লোকের জন্য ফরয আর শুদ্ধভাবে কুরআন পড়া সকল মুসলমানের উপর ফরয। এভাবে এসলাহে বাতেন তথা আত্মশুদ্ধিও সকল মানুষের জন্য ফরজ। শায়খের সুহবত ছাড়া এসলাহ সম্ভব নয়। শায়খ ধরার উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মসংশোধন। বাইআত কোন জরুরী বিষয় নয়। যদি বাইআত হল কিন্তু এসলাহ হল না তো দুনিয়া আখেরাত উভয় ধ্বংস। আর যদি বাইআত হয়নি তবে এসলাহ তথা আত্মসংশোধন করেছে তাহলে সফলকাম। 

৩৮. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, তাহাজ্জুদ নামায খুবই সহজ। প্রত্যেক মানুষই পড়তে পারে। কেননা তাহাজ্জুদের সময় এশার নামাযের পর থেকে শুরু হয়ে যায় চাই এশার নামায যখনই পড়া হোক। তবে শেষ পড়া উত্তম। কাজেই যদি কেউ শেষ রাতে জাগ্রত হওয়ার ব্যাপারে সন্দিহান হয় তাহলে এশার নামাযের পর চার রাকাত নামায তাহাজ্জুদের নিয়তে পড়ে নিবে। 
তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে কোন বিশেষ নামাযের আলোচনা করেননি। কিন্তু তাহাজ্জুদের কথা আলোচনা করেছেন (সূরা ইসরা-৭৯)। যা তাহাজ্জুদের বিশেষ মর্যাদার আলামত। 

৩৯. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, হযরত থানভী রহ. এমদাদুল ফাতওয়ার মধ্যে, আল্লামা মাহমুদ আলূসী রহ. তাফসীরে রুহুল মাআনীতে, আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনে আবেদীন শামী রহ. ফাতওয়ায়ে শামীতে, আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনে কাসীর রহ. তাফসীরে ইবনে কাসীরের মধ্যে এবং মুফতী শফী রহ. তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন এর মধ্যে লিখেছেন, এশার নামাযের পর দুই রাকাত সুন্নাত পড়ে বিতির নামাযের পূর্বে চার রাকাত নামায তাহাজ্জুদের নিয়্যতে পড়লে তাহাজ্জুদের সওয়াব লাভ করা যায় এবং সে তাহাজ্জুদগুযারদের মধ্যে গণ্য হয়। সুবহানাল্লাহ। 

৪০. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, হযরত আবরারুল হক হারদূয়ী রহ. ১৯৯৫ ইং সনে ঢাকা সফরে এসেছেন। ঐ সফরে হযরত রহ. প্রায় সকল মজলিশে তিনটি কথা বার বার বলেছেন, ১. সালাম দেওয়ার সময় হামযাকে তাহকীকের সাথে স্পষ্ট করে উচ্চারণ করা উচিত। ২. কুরআন কারীম তাসহীহের ইহতেমাম করা উচিত। আমরা উলামা-তালাবাগণ কুরআন ভুল পড়িনা ঠিক তবে শুদ্ধও পড়িনা। ৩. উলামাদের ঘরেও শরয়ী পর্দার অভাব। কাজেই এর জন্য আমাদেরকে আগে নিজে তৈরী হতে হবে এবং নিজেদের পরিবার-পরিজন ছেলে-মেয়েদের মাঝে শরয়ী পর্দার প্রচলন করার চেষ্টা করতে হবে।

৪১. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, আমাদের এ ফিকির করতে হবে যে, বাইআত হওয়ার আগে আমাদের অবস্থা কেমন ছিল আর বাইআত হওয়ার পর অবস্থা কেমন?  যদি উন্নতি হয় তাহলে আলহামদুলিল্লাহ। আর যদি কোন পরিবর্তন না হয় তাহলে বাইআতের কোন ফলাফল পাওয়া গেলনা। এভাবে যাদেরকে এজাযত দেওয়া হয় তাদের চিন্তা করা উচিত- এজাযতের পূর্বে আমাদের অবস্থা কেমন ছিল আর এজাযতের পর আমাদের অবস্থা কেমন হল। প্রত্যেকেই উন্নতির পথ তালাশ করা উচিত। 
ইত্বেবায়ে সুন্নাত তথা সুন্নাতের অনুসরণ কিতাব দ্বারা হয় না বরং সুন্নাতের প্রকৃত অনুসারীর সুহবত দ্বারা অর্জন হয়। এই জন্য মাজাযীন (মুরীদগণ) সকলে হারদূয়ী যাওয়া উচিত। আর আমিও দুআ করতে থাকব। ইনশাআল্লাহ তারাক্কীর পথ খুলে যাবে। 
এক মাদরাসার কথা বলেন, ঐ মাদরাসার মুহতামিম সাহেব বলেছেন, আমরা সাপ্তাহে একদিন সকল উস্তাদ আপসে মুযাকারা করি যে, গত সাপ্তাহে আমাদের নামায অর্থাৎ তাকবীরে উলা, তাহাজ্জুদ, ইশরাক, আওয়াবীন ইত্যাদির কতটুকু পালন করা হয়েছে। সুন্নাতের মধ্যে কি কি ত্রুটি হয়েছে। মোটকথা, সব আমলের মুযাকারা হওয়া উচিত এবং সামনের জন্য আযম করা উচিত। 

৪২. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, সালেক যে হবে সে নিজ শায়খের কথা কোন প্রকার চুচেরা ছাড়া, কোন প্রকার ছিদ্রাম্বেষণ ছাড়াই মেনে নিবে এবং অনুসরণ করবে। আমাদের সকল আকাবীরে দেওবন্দের এই পদ্ধতিই ছিল। আমি যখন মারকাযুল ফিকরিল  ইসলামী বসুন্ধরার জন্য হযরতওয়ালা হারদূয়ী রহ. কে উপদেষ্ঠা বানালাম হযরত আমাকে শর্ত দিলেন কালেকশান করা যাবে না। যদি কালেকশান করা হয় তাহলে আমি উপদেষ্ঠা থাকব না। আমি নিঃসংকোচে মেনে নিয়েছি।

৪৩. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, মুআমালা-মুআশারা (লেনদেন ও আচার ব্যবহার) সঠিক হওয়া সকল মুসলমানের জন্য জরুরী। আর উলামায়ে কেরামের জন্য তো অতীব প্রয়োজন। এর চেয়ে বেশী প্রয়োজন সালেকের জন্য। কেউ সালেক Ñযারা নিজেদের ইসলাহ করে আল্লাহওয়ালা হতে চায়Ñ হবে আবার মুআমালা দুরস্ত হবে না তা হতেই পারে না। এবার আমাদের অবস্থার উপর চিন্তা করা দরকার যে আমরা মাদরাসার তালাবাদেরকে চাকর মনে করছি। চাকরের মত তাদের থেকে কাজ নিচ্ছি। না-বালেগ শিশুদের থেকে খেদমত নেওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ যদিও আত্মিয় হয়। আর বালেগ ছাত্র যদি নিজ খুশিতে খেদমত করতে চায় তাহলে তো জায়েয আছে কিন্তু হুকুম দিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেহমান দ্বারা খেদমত নেওয়া উচিত নয়। 

৪৪. হযরত ওয়ালা রহ. বলেন, হাঁচি দেওয়ার পর জোরে আলহামদুলিল্লাহ বলা حسن معاشرہ (উত্তম চরিত্র) পরিপন্থি। কারণ আলহামদুলিল্লাহ বলা মুস্তাহাব। জোরে বলার কোন প্রয়োজন নেই। আলহামদুলিল্লাহ যে শুনবে তার জন্য জবাবে یرحمک اللہ বলা ওয়াজিব। সে যদি অবহেলা বা না জানার কারণে یرحمک اللہ না বলে তাহলে গুনাহগার হবে।    

৪৫. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, হযরত থানভী রহ. কে এক লোক গালী দিয়েছে। পরে যখন তার বুঝে এসেছে তখন সে হযরতের কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে। হযরত তাকে বললেন, আমি তোমাকে বিগত গালির জন্য ক্ষমা করে দিলাম। সামনে যদি কখনো গালি দাও তাও ক্ষমা করে দিলাম। আমার জীবদ্দশায় যে গালি দিবে তাও ক্ষমা করলাম এবং আমার মৃত্যুর পর যে গালি দিবে তাও ক্ষমা করে দিলাম। হযরত ফকীহুল মিল্লাত রহ. বলেন, আল্লাহওয়ালা হওয়ার জন্য এই ধরণের চরিত্রবাণ হতে হবে। 

৪৬. হযরতওয়ালা রহ. বলেন, আমি নিজে স্বয়ং দেখেছি যে, শায়খুল হাদিস মাও. যাকারিয়া রহ. রমযানের দু’দিন আগেই মসজিদে চলে যেতেন এবং সর্বপ্রকার ব্যাস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে দৈনিক এক খতম কুরআন মাজিদ তেলাওয়াত করতেন। কিছু যমযমের পানি আর একটি খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন আর একটি ডিম দ্বারা সেহরী খেতেন।   


জমাকরণ- মীযানুর রহমান এখলাশপুরী,

শিক্ষক, জামিয়া মুহাম্মাদিয়া হাজিরহাট নোয়াখালী।

এমএম/


সম্পর্কিত খবর



সর্বশেষ সংবাদ