|| তাওহীদ আদনান ইয়াকুব ||
(সূরা মুজাদালা, সূরা হাশর, সূরা মুমতাহিনা, সূরা সফ, সূরা জুমুআ, সূরা মুনাফিকুন, সূরা তাগাবুন, সূরা তালাক, সূরা তাহরিম)
আল-কুরআন শুধু একটি ধর্মগ্রন্থ নয়, এটি মানবজাতির জন্য পরিপূর্ণ জীবনবিধান। এর প্রতিটি আয়াতেই রয়েছে হিদায়াত, নসীহত ও দিকনির্দেশনা, যা মানুষকে সত্যের পথ দেখায় এবং জুলুম, অন্যায় ও বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত করে।
২৫তম তারাবীতে তেলাওয়াত করা হবে ২৮ নম্বর পারা। এ পারায় ইসলামের নৈতিক ও সামাজিক বিধান, পারিবারিক জীবন, তাকওয়া, মুনাফিকদের প্রতারণা এবং সত্য-অসত্যের পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এই পারায় নবীদের ইতিহাস, উম্মতের দায়িত্ব ও আখিরাতের ফলাফল তুলে ধরেছেন। এছাড়া, দাম্পত্য জীবনের বিধান, তালাকের নিয়ম, জুমুআর গুরুত্ব এবং ঈমানদারদের জন্য আল্লাহর সাহায্যের প্রতিশ্রুতি উল্লেখ করা হয়েছে।
এই পর্বের শিক্ষাগুলো আমাদের জীবন পরিচালনায় এক অনন্য দিকনির্দেশনা দেয়, যা আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও পরকালীন সফলতার পথ প্রশস্ত করে।
১. সূরা মুজাদালাহ (১-২২) – নারীর অধিকার ও মুনাফিকদের অবস্থা
- মুনাফিকদের চরিত্র, তাদের ষড়যন্ত্র, এবং তাদের পরিণতি সম্পর্কে কঠোর সতর্কবাণী রয়েছে।
- সূরার শুরুতে "যিহার" প্রথা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, যা ইসলামের আগমনের আগে বিবাহ বিচ্ছেদের এক ভুল পদ্ধতি ছিল।
- এক নারী স্বামীর আচরণ নিয়ে নবীজী (সা.)-এর কাছে অভিযোগ করলে আল্লাহ তায়ালা জাহিলি যুগের তালাক ব্যবস্থা (যিহার) নাকচ করে দেন।
- যিহারের মাধ্যমে স্ত্রীর ওপর অবিচার করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এর কাফফারা নির্ধারণ করা হয়েছে।
- মুনাফিকদের চরিত্র, তাদের ধোঁকাবাজি ও আল্লাহর শাস্তির বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।
- মুসলমানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর আদেশ অমান্য না করে এবং সত্যের ওপর অবিচল থাকে।
২. সূরা হাশর (১-২৪) – বনু নাদীরের বিতাড়ন ও আল্লাহর গুণাবলি
- মদিনার ইহুদি গোত্র বনু নাদীরের বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি ও তাদের দেশান্তরিত হওয়ার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
- মুমিনদের একতা ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে।
- সূরার শেষ তিন আয়াতে আল্লাহর ১৩টি গুণাবলি বর্ণনা করা হয়েছে, যা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
- মুনাফিকদের চরিত্র উন্মোচন করা হয়েছে, যারা মুখে মুসলিম বলে দাবি করলেও অন্তরে কুফর লুকিয়ে রাখত।
- ইসলামে ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব ও মুহাজির-আনসারদের পারস্পরিক সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে।
- সূরার শেষ অংশে আল্লাহর গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, তিনিই সব কিছুর মালিক, সর্বশক্তিমান, প্রজ্ঞাময় ও পরম দয়ালু।
৩. সূরা মুমতাহিনা (১-১৩) – কাফেরদের সঙ্গে সম্পর্ক ও মুমিন নারীদের হিজরত
- মুসলিম নারীদের হিজরতের শর্তাবলি এবং তাদের বৈবাহিক বিধান বর্ণিত হয়েছে।
- কাফিরদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে।
- মুসলমানদের সতর্ক করা হয়েছে যেন তারা ইসলামবিরোধীদের বন্ধু না বানায়।
- মুসলিম নারীদের হিজরত ও ইসলামের জন্য আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
- ঈমানদারদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে।
৪. সূরা সফ (১-১৪) – জিহাদ ও সত্যের পথে অবিচল থাকার নির্দেশ
- আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করা মুমিনদের মর্যাদা এবং মুনাফিকদের প্রতারণার পরিণতি বর্ণিত হয়েছে।
- ঈসা (আ.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তাঁর পর এক নবী আসবেন, যাঁর নাম হবে আহমদ (অর্থাৎ মুহাম্মাদ সা.)।
- আল্লাহর পথে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম ও জিহাদের গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে।
- ঈসা (আ.)-এর উম্মতের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে।
- ইসলামের বিজয় এবং সত্য ধর্মকে প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
৫. সূরা জুমুআ (১-১১) – জুমার গুরুত্ব ও ইহুদিদের অবস্থান
- জুমুআ নামাজের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে বলা হয়েছে।
- জুমার দিনের ফজিলত ও মুসলমানদের জন্য একত্রিত হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
- ইহুদিদের মধ্যে যারা কিতাব বহন করেও তা অনুসরণ করেনি, তাদের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে।
- ইহুদিদের ধর্মীয় বিকৃতির ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে এবং মুসলমানদের সতর্ক করা হয়েছে যেন তারাও সেই ভুলগুলো না করে।
- ব্যবসা-বাণিজ্যের চেয়ে নামাজকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
৬. সূরা মুনাফিকুন (১-১১) – মুনাফিকদের প্রতারণা ও তাদের পরিণতি
- মুনাফিকদের প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত করা হয়েছে।
- মুনাফিকরা মুখে ঈমানের দাবি করলেও অন্তরে তারা কুফরি লুকিয়ে রাখে।
- তারা মুমিনদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়।
- তারা কিভাবে ইসলামের সাথে শত্রুতা করত এবং ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালাত তা বর্ণনা করা হয়েছে।
- মৃত্যুর আগে তওবা করার এবং আল্লাহর পথে দান করার গুরুত্ব বোঝানো হয়েছে।
৭. সূরা তাগাবুন (১-১৮) – তাকদীর, ঈমান ও দুনিয়ার পরীক্ষা
- আসমান ও জমিনের সমস্ত কিছু আল্লাহর মালিকানাধীন এবং মানুষের প্রতিটি কাজের হিসাব আল্লাহর কাছে থাকবে।
- ঈমানদারদের পরীক্ষা ও বিপদ আসবে, কিন্তু তারা ধৈর্য ধরলে আল্লাহ তাদের পুরস্কৃত করবেন।
- এই সূরায় জানানো হয়েছে যে, আখিরাতের দিন সবাই তাদের কাজের জন্য প্রতিদান পাবে।
- দুনিয়া ও আখিরাতের মাঝে পার্থক্য করা হয়েছে এবং মুমিনদের উদ্দেশ্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
- সম্পদ ও সন্তান-সন্ততির প্রতি আসক্তি থেকে দূরে থেকে আল্লাহর পথে জীবন পরিচালনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
৮. সূরা তালাক (১-১২) – তালাকের বিধান ও তাকওয়ার শিক্ষা
- সঠিকভাবে তালাক প্রদানের বিধান বর্ণিত হয়েছে এবং নারীদের প্রতি সুবিচার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
- তাকওয়া অবলম্বনের মাধ্যমে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ লাভের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
- তালাকের বিধান ও পদ্ধতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
- তালাকের পর নারীদের ইদ্দত পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
- যেসব নারীদের তালাক দেওয়া হয়েছে, তাদের প্রতি সুবিচার করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে।
- আল্লাহর প্রতি তাকওয়া রাখলে তিনি সংকট থেকে উত্তরণের পথ করে দেবেন বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
৯. সূরা তাহরিম (১-১২) – নবীজীর (সা.)-এর পারিবারিক ঘটনা ও উপদেশ
- নবীজি (সা.)-এর কিছু পারিবারিক ঘটনার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, ধর্মীয় বিষয়ে দুনিয়াবি আবেগের স্থান নেই।
- আদর্শ নারী ও অবাধ্য নারীদের উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে, যেমন ফেরাউনের স্ত্রী ও লূত (আ.)-এর স্ত্রী।
- পারিবারিক জীবনে ভারসাম্য ও স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
- নবী (সা.)-এর স্ত্রীদের প্রতি উপদেশ বর্ণনা করা হয়েছে।
- আল্লাহর আনুগত্য ও পরহেজগার জীবনের জন্য প্রেরণা দেওয়া হয়েছে।
মূল শিক্ষা ও বার্তা:
- মুনাফিকদের থেকে সাবধান থাকা এবং তাদের চরিত্র বুঝতে পারা জরুরি।
- আল্লাহর গুণাবলির প্রতি বিশ্বাস রাখা ও তাঁর ওপর ভরসা করা উচিত।
- জুমার দিনকে গুরুত্ব দেওয়া এবং দুনিয়ার লোভে পড়ে দীন থেকে বিমুখ হওয়া উচিত নয়।
- তালাক ও পারিবারিক জীবনের বিষয়ে ইসলামের বিধান অনুসরণ করতে হবে।
- তাকওয়া অবলম্বন করলে দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা লাভ করা সম্ভব।
উপসংহার:
এই পারায় মূলত ইসলামের সামাজিক, পারিবারিক ও রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মুনাফিকদের চক্রান্ত, কাফিরদের শত্রুতা এবং মুমিনদের দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। নামাজ, তাকওয়া, দান-সদকা, জিহাদ, পারিবারিক জীবন এবং সমাজ গঠনের মৌলিক নীতিমালা এখানে বর্ণিত হয়েছে। এই আয়াতগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের উচিত সত্য পথে অবিচল থাকা, আল্লাহর আনুগত্য করা এবং আখিরাতের সফলতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা। এই পারায় পারিবারিক জীবন, সামাজিক বিধান, মুনাফিকদের কৌশল, জুমার গুরুত্ব, এবং তাকওয়ার ফজিলত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা রয়েছে। আল্লাহ আমাদের এই পারার শিক্ষাগুলো উপলব্ধি করার এবং জীবনে বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন, আমিন!
লেখক : ফাযেলে দারুল উলুম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল উলামা লাখনৌ,
মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া আহলিয়া নশাসন, শরীয়তপুর
হাআমা/