|| আব্দুল্লাহ আল মারুফ ||
রজব মাস আল্লাহ তাআলার বিশেষ রহমত ও বরকতের মাস। এটি চারটি আশহুরে হুরুমের (মর্যাদাপূর্ণ মাস) অন্যতম, যা আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারিমে উল্লেখ করেছেন। এ মাস আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক অপূর্ব সুযোগ। সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহিন এ মাসে বেশি বেশি ইবাদত করতেন, ফরজ আমলগুলোতে যত্নবান হতেন এবং নফল ইবাদত দ্বারা নিজের জীবনকে আলোকিত করতেন।
আশহুরে হুরুমের এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, এসব মাসে ইবাদতের প্রতি যত্নবান হলে বাকি মাসগুলোতে ইবাদতের তাওফীক হয়। আর আশহুরে হুরুমে কষ্ট করে গুনাহ থেকে বিরত থাকতে পারলে অন্যান্য মাসেও গুনাহ পরিহার করা সহজ হয়।-আহকামুল কুরআন, জাসসাস ৩/১১১; মাআরিফুল কুরআন ৪/৩৭২
তাই আশহুরে হুরুমের অন্তর্গত রজব মাসের মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট হওয়া উচিত।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বর্তমান সময়ে রজব মাসের কিছু মনগড়া প্রথা ও কুসংস্কার সমাজে প্রচলিত হয়ে গেছে, যা শরীয়তসম্মত নয়। বিশেষ ইবাদত ও নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের যে প্রচেষ্টা দেখা যায়, তা কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য নয়। বিদআত ও ভিত্তিহীন প্রথা পালনের মাধ্যমে আমরা বরং ইসলামি আদর্শ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। তাই বাজারের অনির্ভরযোগ্য বই-পুস্তকে রজব মাস উপলক্ষে বিশেষ নামায ও রোযার যেসব কথা পাওয়া যায় তা সবই ভিত্তিহীন। এ ধরনের মনগড়া আমল দ্বারা এ মাসের ফযীলত লাভ করা সম্ভব নয়। রজব মাসের বরকত ও ফযীলত হাসিল করার জন্য অন্যান্য মাসে পালনীয় ফরয ইবাদতগুলো যথাযথভাবে পালন করতে হবে এবং নফল ইবাদত বেশি বেশি করতে হবে।
এখন সময় এসেছে, রজব মাসের প্রকৃত গুরুত্ব ও মর্যাদা উপলব্ধি করে সহিহ পদ্ধতিতে আমল করার। আসুন, এ মাসে বিদআত ও ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের জীবনকে আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্যের মাধ্যমে পূত-পবিত্র করি। নিচে মাহে রজবের সাথে সম্পর্কিত কিছু প্রচলিত ভুল এবং সেগুলোর সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো।
১. ইসরা ও মেরাজের নির্দিষ্ট তারিখ
বর্তমানে সাধারণ মানুষের মধ্যে এটি খুবই প্রচলিত যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে ইসরা ও মেরাজের ঐশ্বরিক সফরে (যেখানে তিনি জান্নাত ও জাহান্নামের দর্শন লাভ করেন, আল্লাহর সান্নিধ্য পান, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধানসহ বড় বড় নিদর্শন প্রত্যক্ষ করেন) ২৭শে রজব রাতে নেওয়া হয়েছিল। অথচ ইসরা ও মেরাজের তারিখ সম্পর্কে কোনো সহিহ হাদিসে নির্দিষ্ট দিনের উল্লেখ নেই।
মিরাজের রাত নিঃসন্দেহে একটি বরকতময় রাত ছিল কিন্তু এই রাতে যেহেতু বিশেষ কোনো আমল বা ইবাদত উম্মতের জন্য বিধিবদ্ধ হয়নি তাই এর দিন-তারিখ সুনির্দিষ্টভাবে সংরক্ষিত থাকেনি। -আলমাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়াহ ও শরহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যাহ ৮/১৮-১৯; আলবিদায়া ওয়াননিহায়া, ইমাম ইবনে কাছীর ২/৪৭১; লাতাইফুল মাআরিফ, ইমাম ইবনে রজব ১৩৪।
সাধারণত এই দিনটি উপলক্ষে বিভিন্ন মাহফিল ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়, যা প্রায়শই বিদআতের শামিল। পরিতাপের বিষয়, এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন এমন লোকজনের মাধ্যমে হয়, যাদেরকে ধার্মিক বলে মনে করা হয় এবং তারা এতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
ইসরা ও মেরাজ কবে, কোন মাসে এবং কোন দিনে ঘটেছিল, তা নিয়ে সীরাত বিশারদদের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ রয়েছে। তবে এটি সর্বসম্মত যে, এটি নবুওয়াত লাভের পরে হিজরতের পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল। মাস নির্ধারণে পাঁচটি মত পাওয়া যায়:
১. রবিউল আউয়াল
২. রবিউস সানি
৩. রজব
৪. রমজান
৫. শাওয়াল। ( শরহুয যারকানি ২/৬৭)
এখানে লক্ষণীয় যে, মহান সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.)-এর একটি বড় দল, যাদের সংখ্যা প্রায় ৪৫ জন, এই ঘটনাকে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এই রাতে বিশেষ ইবাদতের উল্লেখ তো দূরের কথা, মেরাজের নির্দিষ্ট তারিখও উল্লেখ করেননি।
২. ২৭ শে রজবের রোজা
কোনো সহিহ সনদে এই দিনের জন্য নির্ধারিত কোনো বিশেষ নফল ইবাদতের উল্লেখ নেই। অতএব, ২৭শে রজবে বিশেষ সওয়াবের উদ্দেশ্যে রোজা রাখা সঠিক নয়। দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়ায় মাওলানা মুফতি আজিজুর রহমান (রহ.) উল্লেখ করেছেন: “২৭শে রজব, যা সাধারণ মানুষ ‘হাজারার রোজা’ বলে থাকে এবং এর সওয়াবকে হাজার রোজার সমান মনে করে, এর কোনো ভিত্তি নেই।” (ফতোয়ায় দারুল উলূম দেওবন্দ ৬/৪০৬)
৩. সালাতুর রাগায়েব
সাধারণ মানুষ মনে করে যে, ২৭শে রজব রাতে মাগরিবের পর ১২ রাকাত ৬ সালামের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সুরা ও বিশেষ দোয়ার মাধ্যমে একটি নামাজ আদায় করা সুন্নত। এটি প্রমাণের জন্য একটি বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করা হয়:
“হজরত আনাস (রাযি.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: ‘রজব মাসে একটি রাত রয়েছে, যেখানে আমল করলে ১০০ বছরের সওয়াব পাওয়া যায়। আর সেই রাতটি হলো রজব মাসের ২৭শে এর রাত। যে ব্যক্তি এই রাতে ১২ রাকাত নামাজ পড়বে এবং প্রতি রাকাতে সূরা ফাতিহা ও একটি সূরা তেলাওয়াত করবে, প্রত্যেক দুই রাকাত শেষে তাশাহুদ পাঠ করে সালাম ফিরাবে এবং পরে ১০০ বার সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আল্লাহু আকবার পড়বে, ১০০ বার দরুদ শরিফ পাঠ করবে এবং সকালে রোজা রাখবে সে ব্যক্তির সব দোয়া আল্লাহ তায়ালা কবুল করবেন। তবে, গুনাহের জন্য যে দোয়া করবে সেটা ছাড়া।”(শুআবুল ঈমান- ৩৫৩১)
হাফিজ ইবনে হাজার (রহ.) ও ইবনে জাওজি (রহ.) এই হাদিসকে ‘মওজু’ (বানোয়াট) বলেছেন এবং এর সব রাবিকে মজহুল (অজ্ঞাত) বলেছেন। (তাবয়িনুল আজব-৫৫) এভাবেই আল্লামা নববী রহমতুল্লাহি আলাইহি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে এটি বিদআত এবং জাহালতের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং, এই ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। (শরহুন নববী হাদিস নং-২৪৮২)
রজব মাস মর্যাদাপূর্ণ হলেও এ মাসে নির্দিষ্ট কোনো ইবাদত শরীয়তে নির্ধারিত নেই। বিদআত ও মনগড়া আমল পরিহার করে সহিহ পদ্ধতিতে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট হওয়া উচিত।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন এবং নবী ﷺ-এর অনুসৃত পথের অনুসারী হওয়ার তৌফিক দিন। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী- ইফতা ২য় বর্ষ, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ, ঢাকা
হাআমা/