|| আব্দুল্লাহ আল মারুফ ||
আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে মানুষকে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও সম্মান প্রদান করেছেন। মানুষের মধ্যে তিনি ভালো-মন্দ, নেকি-পাপ, আনুগত্য এবং অবাধ্যতার মতো দুই ধরনের গুণাবলি একসাথে সৃষ্টি করেছেন। তেমনি, কিছু মানুষকে তিনি অন্যদের তুলনায় উচ্চতর মর্যাদা দিয়েছেন। কিছু মানুষকে তিনি বিশেষ সম্মানিত করেছেন এবং তাদেরকে তাঁর সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য দান করেছেন।
এভাবে সৃষ্টিজগতের অন্যান্য জিনিসের মধ্যেও মর্যাদার পার্থক্য রেখেছেন। যেমন, আসমান ও জমিন, মানব ও জিনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আবার দিন ও মাসের মধ্যেও কিছু দিন ও মাসকে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী করেছেন। এই কারণে চন্দ্র মাস রজব তার নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের জন্য অন্যান্য মাসের তুলনায় বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ।
"রজব" ( (رجبনামকরণের কারণ
আল্লামা আব্দুর রউফ মুনাভি (রহ.) বলেন:
"এই মাসকে রজব বলা হয়েছে কারণ এতে শাবান ও রমজান মাসকে কেন্দ্র করে ভালো কাজের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পায়।"(ফয়যুল কাদীর, হাদীস নং,৪৭১৮)
আরবিতে "রজব" শব্দটি ব্যবহৃত হয় কাউকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করার অর্থে। এজন্য আরবেরা এই মাসের মহিমা ও পবিত্রতার কারণে একে "রজব" বলে অভিহিত করত। এ কারণেই আরবদের মধ্যে একে (رجب الأصم) "রজবুল আসম্ম" নামেও ডাকা হত, যার অর্থ হলো এই মাসের মহিমা ও পবিত্রতার কারণে অমুসলিমরাও এই মাসে যুদ্ধ ও সংঘাত থেকে নিজেকে বিরত রাখত এবং শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করত। (লিসানুল আরব: ১/৪১৩, বৈরুত)
একটি মরফু’ হাদিসে বলা হয়েছে:
"রজব আল্লাহর একটি বিশেষ মাস, এবং এটিকে 'আল আসম্ম' বলা হয়। জাহেলিয়াতের যুগে এই মাস এলে মানুষ তাদের অস্ত্র রেখে দিত। ফলে পথঘাট নিরাপদ হয়ে যেত এবং মাসের শেষ পর্যন্ত কোনো ভয় বা বিপদ থাকত না।" (শুয়াবুল ঈমান,৩৫৩২)
মাহে রজবের ফজিলত
মাহে রজব যেহেতু "আশহুরে হুরুম" (সম্মানিত মাস) এর অন্তর্ভুক্ত। তাই, এই মাসের মর্যাদা অত্যন্ত বেশি। কুরআন ও হাদিসে সাধারণভাবে আশহুরে হুরুমের ফজিলত বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু মাহে রজবের কিছু বিশেষ ফজিলতও উল্লেখ রয়েছে। তাই, কুরআন ও হাদিসের আলোকে কিছু ফজিলত এখানে উল্লেখ করা হলো:
১. সম্মানিত মাস
মাহে রজব সেই চার মাসের একটি যা কুরআনে "আশহুরে হুরুম" হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
"আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারো, যেদিন আসমান ও জমিন সৃষ্টি করা হয়েছিল। এর মধ্যে চারটি সম্মানিত মাস।" (সুরা তওবা: ৩৬)
হজরত আবু বকরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন:
"বছরের মাস বারোটি। এর মধ্যে চারটি সম্মানিত মাস: তিনটি পরপর—জিলকদ, জিলহজ ও মহররম; আর একটি হলো রজব, যা জমাদিউস সানি ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস।" (সুনানে আবু দাউদ হাদীস নং, ১৯৪৭)
২. সৎকর্মের প্রতিদান বৃদ্ধি এবং পাপের ভয়াবহতা বৃদ্ধি
উলামায়ে কেরামের মতে, এই মাসগুলোতে বিশেষভাবে পাপ থেকে বিরত থাকা এবং সৎকর্মের প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা যেমন নির্দিষ্ট কিছু সৃষ্টিকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন, তেমনই এই সময়গুলোতেও বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। এই মাসগুলোতে পাপের শাস্তি বেড়ে যায় এবং সৎকর্মের প্রতিদানও বৃদ্ধি পায়। যেমন আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন:
"فَلَا تَظْلِمُوْا فِیْھِنَّ أَنْفُسَکُمْ"
অর্থাৎ, “এই মাসগুলোতে নিজেদের উপর অত্যাচার করো না।”
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরত ইবনে আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে মরফু’ একটি বর্ণনা পাওয়া যায়:
لَا تَظْلِمُوْا أنْفُسَکُمْ فِيْ كُلِّهِنَّ، ثُمَّ اخْتَصَّ مِنْ ذٰلِکَ أرْبَعَۃَ أشْهُرٍ فَجَعَلَہُنَّ حُرُمًا، وَعَظَّمَ حُرُمَاتِهِنَّ، وَجَعَلَ الذَّنْبَ فِيهِنَّ أعْظَمَ، وَالْعَمَلَ الصَّالِحَ وَالْأجْرَ أعْظَمَ
অনুবাদ: “বছরের সকল মাসেই নিজেদের প্রতি অত্যাচার থেকে বিরত থাকো। তবে এই চারটি মাসকে আল্লাহ বিশেষ সম্মানিত করেছেন এবং এগুলোর মর্যাদাকে মহান করেছেন। এই মাসগুলোতে পাপের ভয়াবহতা বেড়ে যায় এবং সৎকর্মের প্রতিদানও অধিক বৃদ্ধি পায়।” (ইবনে কাসীর ৪/১৩০, তাফসীরে তাবারী ১৪/২৩৮)
৩. রোজা রাখার প্রতি উৎসাহ
আশহুরে হুরুমে (মর্যাদাপূর্ণ মাসগুলো) রোজার ফজিলত সম্পর্কে সাহাবায়ে কিরাম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মরফু’ কিছু হাদিস পাওয়া যায়। যেমন সুনানে আবু দাউদে একটি হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে:
এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসে বললেন:
"আমি কে, আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?"
রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: "তুমি কে? আমি তো চিনতে পারছি না।"
তিনি বললেন: "আমি বাহেলি গোত্রের সেই ব্যক্তি, যে প্রথম হিজরতের সময় আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিল।"
রাসূলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন: "তোমার কী হয়েছে? আগে তো তোমার অবস্থা ভালো ছিল।"
তিনি বললেন: "আমি রাত ছাড়া দিনের বেলা কিছু খাই না।"
রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: "তুমি কেন নিজের প্রতি এমন কঠোর আচরণ করছ?"
এরপর তিনি বললেন: "রমজানের রোজা রাখো এবং প্রতি মাসে একটি রোজা রাখো।"
তিনি বললেন: "আমার শক্তি আছে, আরও বেশি করতে চাই।"
তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: "তাহলে প্রতি মাসে দুই দিন রোজা রাখো।"
তিনি বললেন: "এতেও শক্তি আছে।"
তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: "তিন দিন রোজা রাখো।"
তিনি বললেন: "আরও বেশি করার অনুমতি দিন।"
তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: "হারাম মাসগুলোতে রোজা রাখো এবং মাঝে মাঝে বিরতি দাও।"
এই নির্দেশনা তিনবার বললেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং, ২৪২৮)
উল্লিখিত হাদীসের বাইরে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনু ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এবং তাবেঈনদের মধ্যে অন্যতম হজরত হাসান বসরি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে এ মাসে রোজা রাখার প্রমাণ পাওয়া যায়। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক- ১৭৮৫৬, মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা- ৯২২৫)
যেহেতু ‘‘আশহুরে হুরুম’’-এর মধ্যে রজব মাসও অন্তর্ভুক্ত, তাই উল্লিখিত আছারের আলোকে এ মাসে রোজা রাখার প্রতি উৎসাহ পাওয়া যায়। হাফিজ ইবনু হাজার রাহমাতুল্লাহি আলাইহি রজব মাসে রোজা রাখার সম্পর্কিত একাধিক হাদীস উপস্থাপন করেছেন এবং তার সূত্রগত অবস্থান পর্যালোচনা করে মন্তব্য করেছেন:
‘রজব মাসে রোজার ফজিলত সম্পর্কিত হাদীসগুলি সাধারণত দুই ধরনের হয়:
১. যয়ীফ হাদীস।
২. মওযু হাদীস’ (তাবয়ীনুল আজব পৃ. ৩৩)
পরবর্তীতে কয়েক লাইন পরে তিনি এই সকল হাদীসের উপর দুর্বলতার ফতোয়া দিয়েছেন। তবে মনে রাখতে হবে যে রোজা নিজেই একটি ভালো কাজ, এবং রজব মাস আশহুরে হুরুমের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এর সওয়াব আরও বৃদ্ধি পায়। তাই, এই মাসে কোনো নির্দিষ্ট বা নির্ধারিত সওয়াব বা বিশ্বাস ছাড়া রোজা রাখা অবশ্যই একটি ভালো কাজ। হজরত হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরফ আলী থানভি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এক প্রশ্নের উত্তরে লিখেছেন:
“দ্বিতীয় দৃষ্টিকোণ হলো, রজব মাস আশহুরে হুরুমের মধ্যে হওয়া, যা রজবসহ বাকি আশহুরে হুরুমের মধ্যেও রয়েছে। প্রথম দৃষ্টিকোণ ছাড়াই, শুধুমাত্র এই দ্বিতীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই রজব মাসে রোজা রাখা উত্তম ও পছন্দনীয় হিসেবে বিবেচিত হয়।’’ (ইমদাদুল ফাতওয়া ৪/১৩৪)
৪. মাসের শুরুতে বিশেষ দোয়া করা
ইমাম বায়হাকি (রহ.) তাঁর শু'আবুল ঈমান গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত:
"كان رسول الله ﷺ إذا دخل رجب قال: اللّٰهم بارك لنا في رجب وشعبان وبلغنا رمضان"
অনুবাদ: “রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অভ্যাস ছিল যে, তিনি যখন রজব মাসে উপনীত হতেন, তখন এই দোয়া করতেন:
‘হে আল্লাহ! আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাসে বরকত দিন এবং আমাদের রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।’ (শুয়াবুল ঈমান-৩৫৩৪)
ফায়েদা: এই হাদীসের সনদে এক বর্ণনাকারী "যায়েদা" সম্পর্কে কিছু ইলমে হাদীসের ইমাম আপত্তিমূলক মন্তব্য করেছেন। কেউ কেউ তাকে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্যও বলেছেন (মাজমাউয যাওয়ায়েদ- ৩/১৪০)। তবে অর্থ ও মর্মের দিক থেকে এই হাদীসটি সঠিক এবং আকাবিরগণ এর উপর আমল করেছেন। তদুপরি, ফজিলতের বিষয়ে উদারতার নীতির ভিত্তিতে এই দোয়া পাঠ করতে কোনো আপত্তি নেই। (তাযকিরাতুল মওযুআত- ১/১১৭)
ফজিলতপূর্ণ এই দোয়ার ব্যাখ্যা
মোল্লা আলী কারী (রহ.) এই দোয়ার অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন:
اللّٰهم بارك لنا: أي في طاعتنا وعبادتنا، في رجب وشعبان، وبلغنا رمضان، أي إدراكه بتمامه، والتوفيق لصيامه وقيامه
অনুবাদ: “হে আল্লাহ! আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাসে ইবাদত ও আনুগত্যে বরকত দিন। এবং আমাদের রমজান মাস পর্যন্ত পৌঁছে দিন। অর্থাৎ, রমজান পুরোপুরি লাভ করার সুযোগ দিন এবং এই মাসে রোজা ও তারাবির মাধ্যমে ইবাদত করার তৌফিক দান করুন।”(মিরকাতুল মাফাতিহ- ৩/১০২২, হাদীস নং, ১৩৬৯)
হাআমা/