টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে চলছে বিশ্ব ইজতেমার ৫৭তম আসর। দীনের তলব নিয়ে সেখানে জড়ো হয়েছেন দেশ-বিদেশের লাখো মুসলিম। আম ও খাস বয়ানে তারা পাচ্ছেন দীনের পথে চলার দিকনির্দেশনা। দাওয়াত ও তাবলিগের প্রভাব, এই কাজের সঙ্গে উলামায়ে কেরামের সম্পৃক্ততার প্রয়োজনীয়তা ও উপায়সহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলেছেন গবেষক আলেম মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- কাউসার লাবীব
ইজতেমা প্রতিদিন: আমাদের সমাজে তাবলিগ জামাতের প্রভাব কতটুকু?
মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ: দাওয়াত ও তাবলিগ নবীওয়ালা কাজ। পয়গাম্বরী কাজ। যুগে যুগে নবী-রাসুলদের এই কাজের জন্যই পাঠানো হয়েছে। আমাদের নবী পাক সা.কেও একই মেহনতের জন্য আল্লাহ পাঠিয়েছেন। রাসুল সা. জীবনের দীর্ঘ ২৩ বছর এই মিশন নিয়েই মানুষদের দাওয়াত দিয়েছেন। আর দাওয়াতের প্রভাব আমরা রাসুলের জমানা থেকেই দেখতে পাই। লাখো কাফের ইমানের দৌলত পেয়েছেন। নবীর পরশে কালেমার ছোঁয়ায় হয়েছেন শ্রেষ্ঠ উম্মত। হয়েছেন সাহাবা। নবীজি সা. এর পর দাওয়াতের জিম্মাদারি তার উম্মতের ওপর ন্যস্ত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছেÑ ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত। তোমাদের মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা মানুষদের সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অন্যায়মূলক কাজ থেকে বাধা প্রদান করবে। এবং আল্লাহ ওপর ঈমান আনবে।’ (আলে ইমরান-১১০)
শত শত বছর দাওয়াতের এই মেহনতের ফলে ক্রমান্বয়ে মানুষ ঈমান পেয়েছে, ইসলাম পেয়েছে। নানা কারণে আমাদের উপমহাদেশের সাধারণ মানুষ দীন থেকে একসময় এমনভাবে সরে গিয়েছিল যে, তারা শুধু নামেই মুসলমান ছিল। তাদের মাঝে ঈমানের নূরকে প্রজ্জ্বলিত করতে এবং ঈমানের দাওয়াতকে বেগবান করতে প্রচলিত দাওয়াত ও তাবলিগের সূচনা করেন হজরত মাওলানা ইলিয়াস রহ.। তার নিয়তের স্বচ্ছতার কারণে আল্লাহ এই মেহনতকে এমনভাবে কবুল করেছেন; কোটি কোটি মানুষ এই কাজের সঙ্গে জড়িত। লাখো পথভোলা মানুষ এর মাধ্যমে সঠিক পথের দিশা পেয়েছে। তাই এর প্রভাব প্রশংসাতুল্য। বিশেষ করে আমাদের দেশে দাওয়াত ও তাবলিগের প্রভাব সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে পড়েছে। দেশের ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে দাওয়াত ও তাবলিগের প্রভাব দৃশ্যমান। দলমত নির্বিশেষে সবাই এই কাজকে আপন করে নিয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করছি এই প্রভাব কেয়ামত পর্যন্ত বহাল থাকবে।
ইজতেমা প্রতিদিন: দাওয়াত ও তাবলিগের কাজের সঙ্গে উলামায়ে কেরামের সম্পৃক্ততা কেন জরুরি?
মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ: ক্রমেই মানুষ ইসলামের পথে আসছে। আর এর পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে দাওয়াত ও তাবলিগ। এছাড়া দাওয়াত ও তাবলিগের মাধ্যমে অনেক দীন-ভোলা মুসলমানও ইসলামকে নতুন করে চিনছে। পৃথিবীব্যাপী যারা দাওয়াত ও তাবলিগের ছোঁয়ায় ইসলাম চিনছে, এর মধ্যে নওমুসলিম হতে পারে বা পথভোলা মানুষও হতে পারে, তারা সবসময় নিজেকে তাবলিগের সঙ্গে যুক্ত রাখছে। কিন্তু এরা তো ইসলাম সম্পর্কে বলা যায় কিছুই জানে না। তাই তাবলিগের সাধারণ মানুষকে কিন্তু রাহনুমায়ি করতে হবে আলেমদের। আমি বলবো, অন্যকিছুর জন্য নয়, তাবলিগের সঙ্গে যুক্ত থাকা সাধারণ মানুষ যেন কোনো কারণে গোমরাহির পথে না যায় সেই কারণে।
ইজতেমা প্রতিদিন: ইলমি খেদমতে নিয়োজিতরা কীভাবে দাওয়াতি কাজে সময় দিতে পারেন বলে আপনি মনে করেন?
মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ: উলামায়ে কেরামের মূল দায়িত্ব হলো নবীওয়ালা দাওয়াত মানুষের মাঝে বিস্তারের জন্য কাজ করা। এখন এর পদ্ধতি নানাভাবে হতে পারে। বর্তমান উলামায়ে কেরাম বেশিরভাগ তাদের সময় ব্যয় করছেন পড়ালেখা, তাসনিফাত, গবেষণা ও ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে। এছাড়া অল্পকিছু আলেম প্রচলিত দাওয়াত ও তাবলিগের সঙ্গে যুক্ত আছেন। আমি মনে করি এই সংখ্যাটা আরও বাড়ানো দরকার। উলামায়ে কেরাম যদি তাবলিগকে তাদের নিজেদের কাজ মনে করে সাল, চিল্লায় আরও বেশি যুক্ত হয় তাহলে এই মেহনত আরও জৌলস ছড়াবে। আর তাবলিগে থাকা সাধারণ মানুষও বেশ উপকৃত হবে। তাই ইলমের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার পাশাপাশি তাবলিগের কাজকেও তারা আপন করে।
যে যতটুকু সময় বের করতে পারবে সে যেন ততটুকু সময়ই এই মেহনতে দেয়। যেমন, একটু চেষ্টার মাধ্যমে একটা সালের জন্য সময় বের করা। রমজানের ছুটি কাজে লাগিয়ে চিল্লায় সময় দেওয়া। পরীক্ষা বা অন্যান্য বন্ধের সময় এক সপ্তাহ, তিন দিন বা চব্বিশ ঘণ্টার জন্য তাবলিগের যাওয়া। এছাড়া সিনিয়র পর্যায়ের আলেম যারা আছেন বা ইলমি ব্যস্ততায় যারা ব্যাপকভাবে জড়িয়ে গেছেন তারা তাবলিগের সাথীভাইদের নানা পরামর্শ দেওয়ার মাধ্যমে, রাহনুমায়ি করার মাধ্যমেও তাবলিগের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন। এছাড়া ফজরের পর যখন মসজিদে মাশওয়ারা হয়, মাগরিবের পর যখন তালিম হয় তখন একটু সময় বের করে তাদের সঙ্গে বসা, তাদের কথা শোনা, তালিম শোনা কিন্তু খুব প্রয়োজন। তারা যেন অজ্ঞতাবশত কুরআন হাদিসের বাইরে কিছু বলে বা করে না বসেন সে বিষয়ে খেয়াল রাখার জন্য এসব অত্যন্ত জরুরি।
ইজতেমা প্রতিদিন: বিশ্ব ইজতেমা থেকে আমরা কী শিক্ষা গ্রহণ করবো?
মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ: দীন প্রতিষ্ঠায় প্রিয়নবীজীর মেহনত-মুজাহাদা, সাহাবায়ে কেরামের কোরবান ও আকাবারি-আসলাফদের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা শিক্ষা দেওয়া হয় ইজতেমায়। এই শিক্ষাকে হৃদয়ে গ্রহণ করে সেই অনুযায়ী চলতে হবে। এছাড়া ইজতেমা আমাদের দীনের জন্য নিজেকে কোরবান করা, দীনি ফিকির নিয়ে জীবন পরিচালনা করা, ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে দীনি মেজাজ তৈরি করা, নিজের চেয়ে অন্য মুসলিম ভাইকে প্রাধান্য দেওয়া, নিজেকে আলেমদের আরও কাছাকাছি নেওয়া ও আলেমদের পরামর্শ মেনে চলার শিক্ষা দেয়। কোনো মুসলমান যদি ইজতেমার এই শিক্ষাগুলো নিজের জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে পারে তাহলে তার জীবন হবে সুন্দর ও সুবিন্যস্ত।
কেএল/