ভাঙছে ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমার আসর। এরপর তাবলিগের লাখো সাথী ফিরে যাবেন আপন আলয়ে। কী শিক্ষা নিয়ে তারা ফিরবেন, ইজতেমার মাহাত্ম্য, দীনের প্রতি দাওয়াতের প্রয়োজনীয়তা, দাওয়াত ও তাবলিগের রাহবারিতে আলেমদের কেন প্রয়োজন এবং সাধারণ মানুষের রাহবারিতে কী ক্ষতি পারেÑ এসব বিষয়ে মতামত দিয়েছেন দেশের বিদগ্ধ ফকিহ, বহুগ্রন্থপ্রণেতা, মুফতি হিফজুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- হাসান আল মাহমুদ
ইজতেমা প্রতিদিন: প্রতি বছর দেশে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ইজতেমা। এর তাৎপর্য ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে কিছু বলুন।
মুফতি হিফজুর রহমান: ইসলামে ইত্তেফাক-ইত্তিহাদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে পড়তে হয়। শুক্রবার আরও বৃহত্তর পরিসরে একত্র হওয়ার জন্য জামে মসজিদে জুমা আদায় হয়। আবার দুই ঈদে আরও ব্যাপক পরিসরে ঈদগাহে একত্র হয়। এর থেকে আরও ব্যাপক ও সর্ববৃহৎ পরিসরে হজের মৌসুমে মক্কা-মদিনায় গিয়ে সারা পৃথিবীর মুসলিমরা একত্র হয়। দাওয়াত ও তাবলিগে সারা বছর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় মহল্লাভিত্তিক। ছোট পরিসরে প্রশিক্ষণ শেষে মাঠে নিয়ে আসা হয় সাথীদের। সে মাঠে বড় বড় দাঈ-আলেমরা বিশে^র বিভিন্ন মহল থেকে এসে দীনের দাওয়াতি আলোচনা করেন। দাওয়াত দেওয়ার জযবা তৈরি করেন। ব্যক্তি নিজ, তার পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববান হওয়ার শিক্ষা তুলে ধরা হয়। সেই শিক্ষা নিয়ে ইজতেমা থেকে ব্যাপকভাবে দাওয়াত দেওয়ার জন্য চিল্লা-সালে বের হয়ে যায়।
ইজতেমা প্রতিদিন: ইজতেমা থেকে উম্মতের ফায়দা ও শিক্ষা কী?
মুফতি হিফজুর রহমান: উম্মত ইজতেমা থেকে দীনের বিশাল একটা জযবা নিয়ে নিজ এলাকায় ফিরে। যারা ইজতেমায় যায় সেখানেও পরিশ্রম হয়, ইজতেমার আগেও পরিশ্রম হয়। এ পরিশ্রম করতে গিয়ে ঈমানি হালত যেন আরও মজবুত হয় সেজন্য ইজতেমার আয়োজন। ইঞ্জিনের তেল-গ্যাস শেষ হয়ে গেলে গাড়িকে যেমন কোনো সিলিং স্টেশনে নিয়ে তেল-গ্যাস নিতে হয়, ফলে এ গাড়ি আরও একশ বা দুশো মাইল যেতে পারে। ইজতেমা থেকে এরকমভাবে দীনের একটা জযবা নিয়ে বের হয়, যাতে অন্তত তিন-চার মাস এই জযবার ওপর অবিচল থাকা যায়। এই জযবায় নিজেও দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে থাকা যায় এবং অন্যকেও দীনের প্রতি দাওয়াত দেওয়া যায়। এতে করে উম্মতের বিশাল ফায়দা অর্জিত হয়। উম্মত হালাল-হারাম বেছে চলতে শিখে। নিজে ও পরিবারকে দীনের পরিবেশে রাখতে শিখে। নিজ মহল্লায় দাওয়াতি কাজে শরিক হয়ে দীনের সাথে বাঁচতে শিখে।
ইজতেমা প্রতিদিন: দীনের প্রতি দাওয়াত কেন দিতে হবে?
মুফতি হিফজুর রহমান: আল্লাহ তায়ালা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বানিয়েছেন। ‘আলাছতু বিরাব্বিকুম’ এর সেই অঙ্গীকার মজলিসে মানুষের কাছ থেকে আল্লাহ অঙ্গীকার নিয়েছেন। অতঃপর সে অঙ্গীকার স্মরণ করানোর জন্য আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। নবী-রাসুলগণ কালেমার দাওয়াতকে মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছিয়েছেন। সর্বশেষ নবী আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম এসে চলে যাবার আগে বলে গেছেনÑ ‘আমার পক্ষ থেকে একটি আয়াত হলেও একে অপরের কাছে পৌঁছাও।’ [বুখারি-৩৪৬১] এ সিলসিলা বজায় রাখতে দাওয়াত দিতে হয় দীনের পতি। অপরকে দীনের দিকে দাওয়াত করার দ্বারা নিজেরও ফায়দা হয়। নবীওয়ালা কাজের সওয়াব অর্জিত হয়।
ইজতেমা প্রতিদিন: দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনতে উলামায়ে কেরামের রাহবারি কেন প্রয়োজন?
মুফতি হিফজুর রহমান: যুগে যুগে দাওয়াতের কাজের চালিকাশক্তি মূলত উলামায়ে কেরাম। কারণ, দাওয়াত দেবে কুরআন-হাদিসের। আর এর চালিকা শক্তি হলো ইলম। ইলম না থাকলে দাওয়াত দেবে কীভাবে! অগাধ ও সহিহ-শুদ্ধ ইলম দরকার একজন দাঈর। তাহলে দাওয়াত সহিহভাবে পৌঁছবে জনগণের কাছে। আর ইলম না থাকলে গলত-ফলত পৌঁছবে। মানুষ ইসলাম সম্পর্কে ভুল বার্তা পাবে। বিপথে পরিচালিত হবে।
ইজতেমা প্রতিদিন: দাওয়াত ও তাবলিগের রাহবারি গাইরে আলেমের কাছে থাকলে কী কী ক্ষতি হতে পারে বলে মনে করেন?
মুফতি হিফজুর রহমান: তাহলে বহুত ক্ষতি হতে পারে। চতুর্দিকে গুমরাহি সম্প্রসারিত হবে। বাতিলের ডালপালা বিস্তার করবে। কারণ, উলামা হজরগণ হলেন ইঞ্জিন। আর সাধারণ মানুষ হলো বগি। বগি ইঞ্জিন ছাড়া একটা ইঞ্চিও সামনে অগ্রসর হতে পারে না। এজন্য, হজরত মাওলানা ইলিয়াস সাহেব রহ. বলে গেছেন, ‘যতদিন উলামায়ে কেরাম এই দাওয়াত ও তাবলিগের সামনে থাকবেন, ততদিন এ কাজ সহিভাবে চলবে। আর উলামায়ে কেরাম সামনে না থাকলে পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে মারাত্মক গোমরাহ দলে পরিণত হয়ে যাবে।’
কেএল/