বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ।। ৬ ফাল্গুন ১৪৩১ ।। ২০ শাবান ১৪৪৬


জুলাই বিপ্লবে শিশুহত্যা নিয়ে উদ্বেগ, সুরক্ষা ও জবাবদিহি চায় ইউনিসেফ

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে জাতিসংঘের প্রতিবেদন প্রকাশের পর এটিকে হৃদয়বিদারক উল্লেখ করে উদ্বেগ জানিয়েছে ইউনিসেফ। এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনটির সূত্রে তিনি জানান, ১ জুলাই থেকে ১৫ই আগস্টের মধ্যে যে ১ হাজার ৪০০ ব্যাক্তি নিহত হয়েছেন, তাদের মধ্যে শতাধিক শিশু ছিল। ইউনিসেফ এইসব মৃত্যুর অনেকের বিষয়ে ইতোমধ্যে রিপোর্ট করেছে। মোট কত শিশু নিহত বা আহত হয়েছে—তা স্পষ্ট করার জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা তাদের প্রত্যেকের জন্য শোক প্রকাশ করছি।

বিবৃতিতে অভ্যুত্থানে নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতার চিত্রও তুলে ধরেন তিনি। তার ভাষ্যে, ‘এ সময় নারীদের বিক্ষোভে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখার জন্য শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণের হুমকিসহ নানাপ্রকার জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতার ঘটনার নথি পাওয়া গেছে।’ ‘শিশুরাও এই নারকীয় সহিংসতা থেকে রেহাই পায়নি; তাদের অনেককে হত্যা করা হয়, পঙ্গু করে দেওয়া হয়, নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয়, অমানবিক অবস্থায় আটক করে রাখা হয় এবং নির্যাতন করা হয়।’

বিবৃতিতে শিশুদের ওপর সহিংসতার তিনটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন ফ্লাওয়ার্স। ‘একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে ধানমণ্ডিতে, যেখানে ২০০টি ধাতব গুলিবিদ্ধ হওয়ার কারণে ১২ বছর বয়সী এক বিক্ষোভকারী অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের ফলে মারা যায়। আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে নারায়ণগঞ্জে, সেখানে ছয় বছর বয়সী এক কন্যাশিশু তার বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে সংঘর্ষ দেখার সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়। এই বিক্ষোভের সবচেয়ে ভয়ংকর দিন ৫ আগস্ট পুলিশের গুলি চালানোর বর্ণনা দিয়ে আজমপুরের ১২ বছর বয়সী একটি ছেলে বলে— সব জায়গায় বৃষ্টিপাতের মতো গুলি চলছিল। সে অন্তত এক ডজন মৃতদেহ দেখেছিল সেদিন।’

তিনি বলেন, ‘এই মর্মান্তিক ঘটনাগুলো অবশ্যই আমাদের সবাইকে সন্ত্রস্ত করে তুলছে।’

বাংলাদেশের শিশুদের সঙ্গে আর কখনোই যেন এমনটি না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে দেশের সকল মানুষকে আহ্বান জানিয়েছে ইউনিসেফ।
এসব ফলাফলের আলোকে এবং এই মর্মান্তিক ঘটনা-বিষয়ক ইউনিসেফের আগের বিবৃতিগুলোর জের ধরে বাংলাদেশের সমস্ত নীতিনির্ধারক, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও কর্মকর্তাদের বাংলাদেশের শিশু, যুবসমাজ ও পরিবারগুলোকে শারীরিক ও মানসিক ক্ষত সারিয়ে ওঠার পাশাপাশি আশা সঞ্চার করে তাদের এগিয়ে যেতে সহায়তা করতে আহ্বান জানিয়েছে ইউনিসেফ।

এজন্য বিশেষভাবে তিনটি ক্ষেত্রে কাজ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে জাতিসংঘের শিশু-বিষয়ক এই সংস্থাটি:

প্রথমত, যেসব শিশু প্রাণ হারিয়েছে, তাদের ও তাদের শোকাহত পরিবারের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করা। প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।

দ্বিতীয়ত, যারা এখনও আটক অবস্থায় আছে এবং যাদের জীবন কোনো না কোনোভাবে এই ঘটনাগুলির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে, তাদের সবার জন্য পুনর্বাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়া।

তৃতীয়ত ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রটি হলো, এই সময়টাকে ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য সার্বিকভাবে কাজে লাগানো। সব রাজনৈতিক নেতা, দল ও নীতিনির্ধারকদের পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য একজোট হতে হবে। যাতে বাংলাদেশের কোনো শিশুকে কখনও এমন নির্বিচারে ও যথাযথ প্রক্রিয়ার অভাবে আটক থাকতে না হয়। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে গিয়ে, যা তাদের অধিকার, তাদের যেন নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হতে না হয়। আর এভাবে বাংলাদেশের শিশুদের সুরক্ষা, মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের অধিকার সমুন্নত রাখা সম্ভব।

জবাবদিহি ও সংস্কারের এই আহ্বানে ইউনিসেফ যেসব কাজে সহায়তা দিতে চায় তার মধ্যে রয়েছে—

১. শিশুদের প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন ও বেআইনিভাবে আটকে রাখার ক্ষেত্রে স্বাধীন তদন্ত নিশ্চিত করা।

২. বিচার খাতের সংস্কার নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিশু সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আদলে বাংলাদেশের আইনি কাঠামোকে সাজিয়ে তোলা।

৩. ভবিষ্যতে শিশু অধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধের জন্য স্বাধীন পর্যবেক্ষণ ও নীরিক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাসহ শক্তিশালী সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

৪. আমরা সবাই শিশুদের উপযুক্ত এমন বিচার ব্যবস্থা চাই, যেটি শিশুদের অপরাধী হিসেবে দেখবে না। শিশুদের হুমকি হিসাবে বিবেচনার পরিবর্তে তাদের কথা ও ব্যাখ্যা বুঝবে; তাদের যত্ন, সুরক্ষা ও পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে সে মোতাবেক কাজ করবে।

৫. যেসব শিশু অপরাধ করেছে বলে আদালতে সাব্যস্ত হয়েছে, তাদের আটকে না রেখে এর বিকল্প ব্যবস্থা বের করতে হবে। শাস্তি যা শিশুর স্থায়ী ক্ষতি করে, তার পরিবর্তে বিভিন্ন ডাইভারশন প্রোগ্রাম, প্রবেশন ও পুনর্বাসনমুখী বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।

৬. শিশু-সংবেদনশীল আইনি প্রক্রিয়াগুলি নিশ্চিত করবে; যেখানে শিশুদের জন্য বিশেষ আদালত, আইনি সহায়তা এবং শিশু-সংবেদনশীল তদন্ত ব্যবস্থা থাকবে।

৭. শিশু ভুক্তভোগীদের রক্ষা করবে; ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে জবাবদিহির ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, যাতে ভবিষ্যতে শিশুদের অধিকার এমন লঙ্ঘন না হয়।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ এখন বড় এক পরিবর্তন, প্রত্যাশা ও রূপান্তরের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে অবস্থান করছে। সংস্কার কমিশনগুলো বর্তমানে পুলিশ, আদালত ও বিচার ব্যবস্থার পুনর্গঠনে কার্যকর উপায় খুঁজে বের করতে যেভাবে কাজ করছে, তাতে তরুণ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও আরও ন্যায়সঙ্গত পরিবেশ তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে।

এমএইচ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ